সংবাদপত্রের হুমকি বাস্তবতা ও হিকির জেল

নঈম নিজাম

সংবাদপত্রের হুমকি বাস্তবতা ও হিকির জেল

Other

দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। ১১ বছর শেষ হলো। আজ এক যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বাংলাদেশ প্রতিদিন করোনাকালকে জয় করতে পেরেছে।

 

১১ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এই কঠিনতম সময়েও প্রচারসংখ্যার অবস্থান ধরে রেখেছে সবার শীর্ষে। সংবাদপত্রে তৈরি করেছে এক নতুন ইতিহাস, নতুন অধ্যায়। এ অধ্যায় স্বপ্ন জয় করে সৃষ্টিশীলতার সাফল্যকে এগিয়ে নেওয়ার। আগামী দিনের মিডিয়াকে পথ দেখানোর।

১২ বছরে পা রাখার এই দিনে সব পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ী, সংবাদকর্মী সবাইকে জানাচ্ছি অভিবাদন।  

আপনাদের ভালোবাসায় আমরা চ্যালেঞ্জ জয় করতে সক্ষম হয়েছি। এগিয়ে চলেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে সমাজের অগ্রসর ও অনগ্রসর সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখে।  

সর্বস্তরের পাঠকই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বেছে নিয়েছেন তাদের প্রিয় পত্রিকা হিসেবে। এমনকি করোনাকালেও। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তৈরি হয়েছে আলাদা অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ব্রিটেনের লন্ডন থেকে প্রিন্ট ভার্সন সপ্তাহে এক দিন প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ প্রতিদিন। আর অনলাইন ভার্সনের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বের ১৭৬টি দেশে।  
আজকের এই দিনে সবার কাছে কৃতজ্ঞতা করোনাকালের কঠিন সময়সহ ১১টি বছর পাশে থাকার জন্য। করোনা সারা দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে শুধু অনলাইনে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।  

বাংলাদেশ এ চ্যালেঞ্জের বাইরে ছিল না। সেই কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা সহজতর ছিল না। চারদিকে এক উলট-পালট পরিস্থিতি। ভয়, শঙ্কা আর গুজব নিয়েই গেল বছর এই সময়ে করোনাকাল শুরু হয়। পাঠকরা পত্রিকা নিচ্ছিলেন না হাতে, বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদকর্মীদের মাঝেও ছিল নানামুখী আশঙ্কা। এক জটিল পরিস্থিতি।  

কিছু সংবাদকর্মী সামাজিক মাধ্যমে উৎসাহ নিয়ে লিখলেন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যারা লিখলেন তারা ভাবলেন না একবার বন্ধ হলে পত্রিকা অফিস আবার চালু করা কঠিন। সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখার। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না।  

সারা দেশে ছিল সাধারণ ছুটি। অনেক এলাকায় পত্রিকার হকাররা প্রবেশ করতে পারতেন না। পাড়ায় পাড়ায় মানুষের প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। আর কোনো বাড়িতে করোনা রোগী থাকলে তো কথাই নেই। টানিয়ে দেওয়া হতো লাল পতাকা। সে বাড়িটি হয়ে যেত সবার জন্য নিষিদ্ধ। মানুষ হারিয়েছিল সহনশীলতা। মানবিকতাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা আক্রান্তের ওপর হামলার মতো বর্বরোচিত ঘটনাও ঘটেছিল। অনেক সন্তান আক্রান্ত সন্দেহে বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। একজন মাকে তার সন্তানরা জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। সে পরিস্থিতিতে চিন্তিত ছিলাম পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখা নিয়ে।

করোনার প্রথম ধাপে নিজেও আক্রান্ত হলাম। চিকিৎসা নিলাম বাসাতেই। কারণ হাসপাতালগুলো তৈরি ছিল না। চারদিকে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয় পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানামুখী মানুষের টিকে থাকা নিয়ে। ভাবনায় এলো দীর্ঘদিনের একটি পেশার সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো যাবে কোথায়? হকার বা বিক্রয় প্রতিনিধিদের কী হবে? প্রেস শ্রমিকদের সংসার চলবে কীভাবে? প্রিন্ট মিডিয়ার আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা কাজ শুরু করলাম গেল বছরের মার্চেই। হকারদের পাশে দাঁড়াল ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ। লক্ষ্য ছিল হকাররা যাতে পেশা বদল করে চলে না যান। তার পরও অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। কিন্তু আমরা সরলাম না আমাদের অবস্থান থেকে। গুরুত্ব দিলাম পত্রিকার পাতাজুড়ে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে।  

দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মতামত প্রকাশ করতাম নিয়মিত। তার পরও আতঙ্ক কাটছিল না। এর মাঝে একটা ভালো খবর দিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, নিউজ প্রিন্ট করোনাভাইরাস ছড়ায় না। পত্রিকা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এ খবর সংবাদকর্মীদের আশ্বস্ত করল। ঘরে ঘরে পত্রিকা আবার পৌঁছে দিতে সচেষ্ট থাকলেন হকার ও বিক্রয় প্রতিনিধিরা। সবার মিলিত চেষ্টায় সেসব কঠিন দিন আমরা অতিক্রম করেছি। করোনা মহামারীর দিন শেষ হয়নি। কিন্তু মানুষের মাঝে বিরাজমান আতঙ্ক কমেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। সংবাদপত্রও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

প্রিয় পাঠক! বিশ্ববাস্তবতা সবাই জানি। করোনাকালে মানুষের সহনশীলতা আরও কমেছে। বিশ্বের অনেক দেশে আজ গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক চেতনা হুমকির মুখে। আর প্রযুক্তির দাপটে প্রিন্টের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপট দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে মিডিয়ার জন্য একটা কঠিন পরিস্থিতি। সবকিছু সামাল দিয়েই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ প্রতিদিন গণমানুষের পত্রিকা হিসেবেই থাকবে। সব অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধেই থাকবে আমাদের অবস্থান। কথা বলবে সাধারণ মানুষের পক্ষে। অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি। বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে বলিষ্ঠতা নিয়ে। কথা বলবে মানবতার। চেষ্টা থাকবে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখার। কারণ দায়িত্বশীল সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। আয়নার মতো সমাজের সব অসংগতি তুলে ধরাই সংবাদপত্রের কাজ। যদিও সে কাজ কে কতটা করতে পারছে তা সারা দুনিয়ার সব দেশের আলোচ্য বিষয়। তার পরও ডেভিড লরেন্স জুনিয়রের একটি কথা আছে, ‘গণতন্ত্রে এটা জরুরি যে সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং সংবাদপত্রগুলো সে আস্থা দাবিও করতে পারে। ’ তবে প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসনের কথাটা অন্য রকম। তিনি বলেছেন, ‘জনপ্রিয় সরকারের জনপ্রিয় তথ্যব্যবস্থা থাকতে হয়, অন্তত জনপ্রিয় তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকতে হয়, না হলে সে সরকার হবে একটি বড় রকমের প্রহসন কিংবা বিয়োগান্ত নাটকের নান্দীপাঠ। ’ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। আত্মজীবনীতে তিনি আক্ষেপ করেছেন নানামুখী সরকারি চাপে সংবাদপত্র সঠিক ভূমিকা পালন করতে না পারার। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের পাশে ছিলেন সব সময়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে মিডিয়ার অবাধ স্বাধীনতা অপরিহার্য। সে স্বাধীনতা ধরে রাখতে মিডিয়া কর্মীদেরও কণ্ঠ থাকতে হবে। ঘরে বসে শুধু আফসোস করলে হয় না। অনেকে এখন সাংবাদিকতা করার চেয়ে দলীয় কর্মী হতে বেশি পছন্দ করেন। সংবাদকর্মী দলীয় কর্মী হলে আর কিছু থাকে না। আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন, নিজের মিডিয়ায় নয়।

প্রিয় পাঠক! নানামুখী জটিলতার এই সময়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে গভীর কৃতজ্ঞতা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহানসহ পরিচালকমন্ডলীর প্রতি। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে সফল উদ্যোক্তা আহমেদ আকবর সোবহান। তাঁর সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, তিনি ছাই ধরলে সোনা হয়ে যায়। দেশের সব খাতেই বসুন্ধরা গ্রুপের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।


কেক কেটে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের সূচনা

রাজনীতি ভুলে বিএনপি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে: ওবায়দুল কাদের

মোদিবিরোধী মিছিল হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা: মনিরুল

ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে সাহায্যের আশ্বাস স্পেনের রাষ্ট্রদূতের


আধুনিক চিন্তার এই মানুষটির দিকনির্দেশনা আমাদের পথচলার সাহস ও শক্তি। তাঁর সব চিন্তাভাবনা আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে। কৃতজ্ঞতা শরীরের চেয়ে মন বড়, তারুণ্যের সফল উদ্যোক্তা সায়েম সোবহান আনভীরের প্রতি। আগামী দিনের উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যের স্বপ্নকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিচ্ছেন তিনি। কৃতজ্ঞতা কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান, ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান ও সাফওয়ান সোবহানের প্রতি। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ প্রিয় পাঠক আপনাদের কাছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের আজকের এ সাফল্য শুধু পাঠকদের ভালোবাসার কারণে তৈরি হয়েছে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সব বিজ্ঞাপনদাতা, হকার-এজেন্টসহ বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত সমিতির সদস্য ও সর্বস্তরে জড়িয়ে থাকা সবার প্রতি। বাংলাদেশ প্রতিদিন আজকের অবস্থানে সবার ভালোবাসা নিয়েই। আমার সব সহকর্মীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা। তাদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, টিমওয়ার্ক, কঠোর শ্রমের কারণে বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশ-বিদেশে সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ঢাকার পাশাপাশি নিউইয়র্ক ও লন্ডন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। প্রবাসের পাঠকদের কাছে সপ্তাহে এক দিন আমরা পত্রিকা পৌঁছে দিই। বাংলাদেশে ঢাকার পাশাপাশি বগুড়া থেকেও নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিদিন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ লেখা শেষ করছি জেমস অগাস্টাস হিকির উপমা দিয়ে। কলকাতা থেকে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন হিকি। নাম বেঙ্গল গেজেট হলেও পত্রিকার ভাষা ছিল ইংরেজি। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র আমাদের এ অঞ্চলে। ইংরেজ মানুষটি পত্রিকা বের করার পর স্বজনরা খুশি হয়েছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন হিকি ইংরেজদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন। কিন্তু হিকি তা করেননি। তিনি মানুষের কথা বলেছেন সংবাদপত্রে। ইংরেজদের অপকর্ম তুলে ধরেছেন। প্রশাসনের অনিয়মের খবর ছিল তাঁর পত্রিকায়। ইংরেজদের লুটপাটের কাহিনিও বাদ যায়নি। এমনকি ইংরেজ সেনাদের ব্যর্থতা ও লোভের খবরও প্রকাশিত হতো। ব্যস, আর যায় কোথায়? সবকিছু তুলে ধরার কঠিন খেসারত হিকিকে দিতে হয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। প্রেস জব্দও হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে আফ্রিকায় দাস পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়েও কলম ধরেছিলেন হিকি। তিনি লিখেছেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, একজন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না। ’ ভাবতেও পারছি না সে যুগে এভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা আর বলতে পারার বীরত্বটা। এ যুগে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ছে। কবিগুরু বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। ’ কাঠিন্যকে ভালোবেসে এ পেশাটাতে থাকতে হয়। একজন পরিপূর্ণ সংবাদকর্মীই পারেন অনেক কিছু পরিবর্তন আনতে। আর সে কারণে কাউকে কাউকে কঠিন খেসারতও দিতে হয়। জীবনের সব হিসাব-নিকাশ মেলে না এ পেশায়।

news24bd.tv নাজিম