এই দেশে আমি ও আমার মতো অনেকেই মূল্যহীণ ও অপ্রয়োজনীয়

এই দেশে আমি ও আমার মতো অনেকেই মূল্যহীণ ও অপ্রয়োজনীয়

Other

আমি করোনা নিয়ে বহু কথা বলেছি। এখনো পর্যন্ত ভুল কিছু বলি নাই।   যা বলেছি কোনটাই নিজের জন্য না। আমি মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছি মানুষের উপকার হোক।

আগে থেকে সতর্ক করেছি।   বারবার লিখেছি। বলেছি। প্রতিটি ঔষধ , প্রতিটি বিতর্ক, প্রতিটি নতুন খবর বিশ্লেষণ করেছি।

মৃদু কথায় কাজ না হলে জোরালো কন্ঠে , আঘাত করেও লিখেছি। মানুষ যেন শোনে , বোঝে, বাঁচে। আমি তো জানিই কি করা উচিত বা উচিত না।  এসবই করেছি কারণ ভেবেছি সবার জীবন মূল্যবান। জানলে হয়তো ভালো হবে। একজনেরও যদি উপকার হয় তবে হোক। আমি বিবেকের কাছে দায়হীন থাকতে চেয়েছি। কেউ যদি প্রশ্ন করে সব জেনেও চুপ করেছিলেন কেন?

আমি বলতে পারবো , আমি চুপ করে ছিলাম না। গালাগাল দিয়েছেন অনেকে। আক্রমণ করেছেন। জঘন্য ভাষায়। সেটাও সহ্য করেছি। এসব আমাকে কখনো আক্রান্ত করে না। আমি কুকুরের ঘেউ শুনি না। আমি কোকিলের গান শুনি। ডাস্টবিনের ময়লা দিয়ে ভরাট করা জমিতে প্রাসাদের চেয়ে একটি ছিন্ন গোলাপও আমার কাছে অনেক দামী।

গত বছর এর শেষ থেকে যে ইউফোরিয়াতে সবাই ছিলেন সেটা নিয়েও আমি লিখেছিলাম। সাবধান করেছিলাম।   ব্লুমবার্গের রিপোর্টটির অন্তসারশূণ্যতা নিয়েও বলেছি। আমাকে বলা হয়েছে আমি নাকি হুদাই এসব বলি।   জীবন না থাকলে এই জীবিকা কি কাজে লাগবে?

যে পরিমান টাকা আমাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুটেরারা লুট করেছে তার অর্ধেক দিয়ে জাতিকে তিনমাস লকডাউনে রাখা সম্ভব ছিলো। লকডাউন বাঁচার জন্য জরুরী। বাঁচলে আবার শুরু করা যায় সব। না থাকলে কোটি টাকাও কিছু না। কি কাজে লেগেছে টাকা তাদের?  যারা ৩০০০ কোটি ৬০০০ কোটি টাকা ধার করে মরে গেছেন? ফিউচার পার্ক কি ফিউচার এর নিশ্চয়তা দিতে পেরেছে? হাজার হাজার কোটি টাকার এক্সপোর্ট জোনের মালিক নিজের ভাইকে সাড়ে তিন হাতের বেশী জমি দিতে পেরেছে?  

এবছরেও সবার আগে লকডাউনের বিষয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, যখন লুংগী নৃত্যের ভিডিও তে ফেসবুক সয়লাব ছিলো। মৃত্যু যখন হবার তখনই হবে। এটা আমরা বলি কারণ হলো মৃত্যুকে রিভার্স করা যায় না।   কিন্তু আমরা ভুলে যাই জীবনে বহুবার সাবধানতা ও চিকিৎসার কারণে আমরা মৃত্যু থেকে বেঁচে গিয়েছি।  

টিকা না থাকলে আমাদের মধ্যে অনেকে শৈশবে গুটি বসন্ত, হাম, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, নিউমোনিয়া , টিটেনাসে মারা যেতাম। চিকিৎসা না থাকলে এখন যাদের হার্টে স্টেন্ট /রিং পরানো তাদের অনেকে থাকতেন না। ডায়ালিসিস এর রোগীরা বহু আগেই বাঁচতেন না।
ইনসুলিন না থাকলে বহু মানুষ ত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছাতেন না।

তাই সতর্কতা ও সাবধানতা জরুরী। মৃত্যু যখন আসার তখনি আসে। কিন্তু গত এক বছর টিকা আসার আগেও যারা বেঁচে থাকলেন আর এখন আক্রান্ত হয়ে মরে যাচ্ছেন, এদের অনেকেই অসাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন এখন জাতীগত ভাবে আমরা অসাবধান হয়ে গিয়েছি। পুরো মানবজাতি নির্মূল হবে না। কিন্তু সংক্রামক রোগের প্রতিটি মৃত্যু হবে মূলত: কারো না কারো অসাবধানতার কারণে।

এখনো বিজ্ঞানকে অবহেলা করে , জীবিকার কথা বলে বলে, যতো ধরনের তুঘলকি কাজ চলছে। ১৬ কোটি মানুষ, তাই সহজে আমরা নি:শেষ হবো না। কিন্তু প্রতিটি প্রাণের অবসানের জন্য কেউ না কেউ দায়ী হবো। সব কাজ ঠিক মতো করার পরেও ব্যর্থ হলে সেটাকে ভাগ্য বলা যায়। ভুল কাজ করে ব্যর্থ হলে সেটা ভাগ্য না, সেটা বোকামী। আমি এখন প্রতিদিন প্রিয়জনদের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি আর লাশের হিসাব রাখছি। করোনা নিয়ে আর লিখবো কিনা সেটাও ভাবছি।  

আমার যে খালাতো ভাইটা করোনা হবার পরে নিজের কথা না ভেবে নিজের অসুস্থ স্ত্রীর কথা বলে কাঁদছিলেন, যিনি প্রতি সপ্তাহে আমার মন ভালো রাখার জন্য আমাকে ফোন করতেন, তিনি ৪ এপ্রিলে দুপুর বারোটায় আমার সাথে কথা বলে , ৮ এপ্রিলে মরে গেছেন। আমার যে বন্ধুটা করোনার মধ্যেও গরীব মানুষের চিকিৎসা করেছে, ফোন করে যার কাছে আমি রোগী পাঠিয়েছি, সে মরে গেছে। আমাকে সারাক্ষন মনের শান্তি খুঁজতে বলতেন যিনি সেই বন্ধুর মতো পর হয়েও আপনের চেয়ে বেশী শাকিল ভাইটাও মরে গেছে। আমার অনুষ্ঠানের সংগীত পরিচালক ফরিদ ভাই মরে গেছে। আমার প্রোডাকশন চিফ সামিউল ভাই মরে গেছে। আমার দুজন দুলাভাই মরে গেছে।  

আমি করোনায় বন্দীদশায় বসে বসে হিসাব রাখি দিন ভালো হলে যদি আমি বেঁচে থাকি তবে মোট কয়টা কবর জিয়ারত করতে হবে।  এই দেশে আমি ও আমার মতো অনেকেই মূল্যহীণ ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু আপনারা নিজেদের মূল্য বুঝতে শিখুন।   নিজেকে বাঁচান। নিজের পরিবার পরিজনকে সুস্থ রাখুন। দয়া করে মানুষের সততা ও সৎচেষ্টাকে সাহায্য করুন। নিজে পারেন না বলতে। দালালী আর ভয় আপনার চামড়া থেকে রক্তে সর্বত্র।   সত্য বলতে না পারলে অসুবিধা নাই । মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকুন। তেলের শিশি পকেটে রেখে, হাতটা সাবান দিয়ে ধুয়ে নেন।

যার জন্য মিথ্যা বলছেন, তিনি বা তারা আপনার সাথে কোথাও যাবেন না। মৃত্যুর পরে তো দূরের কথা। আপনাকে দেখতে হাসপাতালেও যাবেন না। এই মহামারীতে কোন একজনের জন্য শোকের আগেই আরেকজনকে হারাতে হবে।

শোকের সময় কোথায়? নিজেকে মূল্য দিন। বাঁচার চেষ্টা করেন। প্রিয়জনকে বাঁচাতে নিজের ভোগ উপভোগ কমান। লোভের ওপর লাগাম টানুন। শত্রুতা আর ঘৃণা মেটাবার অনেক সময় পাবেন।   এই মহামারীতে শত্রুকেও ভালোবাসা দিন। হয়তো বিপদের দিনের পরে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হবে। হয়তো আজকের সামান্য ভালোবাসার বীজ একদিন মহিরুহ হবে।  

সেই অনাগত দিনের কথা ভেবে বেঁচে থাকুন, নিরাপদে থাকার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানুন।

(এটা সবার জন্য নয়। যাদের জন্য বলা , তারা জানেন তারা কারা, আপনারা অনেকেই জানেন তারা কারা। আমাকে গালি দিতে চাইলে, আমার ওপরে রাগ হলেও তারা বেঁচে থাকুন। )

 লেখক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক আব্দুন নূর তুষার।

news24bd.tv/আলী