হুইপ পুত্রের কাণ্ড: আত্মহত্যা করা ব্যাংকারের স্ত্রীর কান্না ‌‘আমরা কি বিচার পাব না’

হুইপ পুত্রের কাণ্ড: আত্মহত্যা করা ব্যাংকারের স্ত্রীর কান্না ‌‘আমরা কি বিচার পাব না’

অনলাইন ডেস্ক

আত্মহত্যা করা তরুণ ব্যাংকার মোর্শেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী জুলি বলেন, আমি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাঁকে যারা আত্মহত্যায় বাধ্য করেছে তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য। এখনো আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুষ্ঠু বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।  

মামলার আট দিন পরও আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। কেন আসামিরা আটক হচ্ছে না, জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? পুলিশ কি তাদের খুঁজে পাচ্ছে না? নাকি খোঁজার কোনো চেষ্টাই নেই? আমাদের আকুতি কি তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না? মামলার তদন্তে কী হচ্ছে তার কোনো আপডেটও আমি জানতে পারছি না।

আমরা কি বিচার পাব না?’

এ ছাড়া তিনি জানান, মোর্শেদ চৌধুরীকে হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী ওরফে শারুন ফোন করে র‌্যাডিসন হোটেলে দেখা করতে বলেছিলেন। মোর্শেদ চৌধুরী আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, “আপনার সঙ্গে তো আমার কোনো লেনদেন নেই। তাহলে কেন মিট করতে বলছেন? মোর্শেদের এ কথায় শারুন হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘লেনদেন নেই, এখন হবে। মিট করেন।

’ শারুনের ওই ফোনকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মোর্শেদ এবং ওই দিনই অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৯ মে তাঁদের ফ্ল্যাটে হামলা চালানো হয়। এরপর ওই রাতেই ব্যবসায়ী আযম খানের বাসায় মোর্শেদকে ডেকে নেওয়া হলে সেখানেও শারুন ছিলেন।

ইশরাত জাহান চৌধুরী আরো বলেন, “সেদিনের সেই ফোনের হুমকির তথ্য আমি ভুলিনি। আমি আমার স্বামীর পাশে থেকে ফোনালাপ শুনছিলাম। মোর্শেদ বলছিলেন, ‘শারুন এ বিষয়ে কেন ফোন করছে?’

জানা যায়, ফোনে হুমকি দেওয়ার পর চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক হুইপপুত্র শারুন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে দুটি গাড়িতে করে ১০-১২ জন যুবকসহ ব্যাংকার মোর্শেদের বাসায় যান। চিটাগাং চেম্বারের সাবেক পরিচালক পারভেজ ইকবাল দলের অন্যদের নিয়ে লিফট দিয়ে ওপরে উঠে বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। এ সময় দরজা খুলতে না চাইলে লাথি মারতে থাকেন। নিজের ও শিশুকন্যার নিরাপত্তার জন্য দরজা খুলতে না চাইলেও দরজার অন্য প্রান্ত থেকে হুমকি দিয়ে পারভেজ ইকবাল দরজা খুলতে চাপ দিতে থাকেন। উত্তেজিত পারভেজ ব্যাংকারের স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমরা আপনাকে আটকে রেখে ওকে (মোর্শেদ) আনব। ’ এ সময় ভবনটির নিচে নম্বর প্লেটবিহীন গাড়িতে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও সাবেক ছাত্রনেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু বসা ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায়। ওই দিনের হামলায় ভীতসন্ত্রন্ত হয়ে ব্যাংকার মোর্শেদ তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পালিয়ে নিকট আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সহযোগিতা চান পুলিশের কাছে। থানায় জিডিও করেন।

ইশরাত জাহান জানান, সেদিন তাঁদের ফ্ল্যাটে যারা হামলা চালায় তারা ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী রাসেলকেও মারধর করে। মারধরের সময় হামলাকারীরা বলেছিল, তারা বাচ্চু ভাইয়ের লোক এবং গাড়ির ভেতরে বাচ্চু ভাই ও শারুন রয়েছেন। এ ছাড়া ওই রাতেই ব্যবসায়ী আজম খানের বাসায় যে বৈঠক হয় সেখানেও শারুন উপস্থিত ছিলেন। এর কয়েক মাস পর শারুনের একে-৪৭ দিয়ে গুলি চালানোর ভিডিও এবং আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরীকে প্রাণনাশের হুমকিসহ কুরুচিপূর্ণ কথা বলার অডিও ব্যাপক আলোচনায় আসে। সেসব আলোচনার পর মোর্শেদকে মোবাইল ফোনে বা সরাসরি কিছু বলা হয়েছিল কি না, তা তাঁর জানা নেই।

উল্লেখ্য, প্রভাবশালী একটি চক্রের গোপন ব্যবসার বলি হতে হয় তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ চৌধুরীকে। ২৫ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেও নিষ্কৃতি মেলেনি তাঁর। তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহননের পথ। ঘটনাটি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এখন প্রধান আলোচনার বিষয়। অনেকের প্রশ্ন, কার গোপন ব্যবসার বলি হতে হলো মোর্শেদকে? যে বিপুল পরিমাণ টাকার কথা বলা হচ্ছে সেই টাকার উৎস কী?

গত ৭ এপ্রিল আত্মহননের আগে সুইসাইড নোটে মোর্শেদ উল্লেখ করেন - ‘আর পারছি না। সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। কিছু লোকের অমানুষিক প্রেসার আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার জুমকে (মেয়ে) সবাই দেখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ। ’

ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘৭ এপ্রিল আমার স্বামী যেদিন আত্মহত্যা করেন সেদিনই টাকা নিতে পারভেজ ইকবালদের আসার কথা ছিল। কিন্তু আর টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার স্বামীর ছিল না। ’

তিনি এ বিষয়ে বাদী হয়ে পাঁচলাইশ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে মো. পারভেজ ইকবাল, জাভেদ ইকবাল, সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দীন, রাসেলসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৮-১০ জনকে আসামি করেন। গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের পরিদর্শক মইনুর রহমানকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

শারুনের নাম মামলায় উল্লেখ কেন করেননি এ প্রসঙ্গে ইশরাত জাহান চৌধুরী আগেই জানিয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নেপথ্যের ওই ব্যক্তিদের নির্দেশেই সব কিছু হয়েছে। পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এজাহারভুক্ত আসামি পারভেজের কাছ থেকে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ সহজেই পেয়ে যাবে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।

আসামিদের পক্ষ থেতে কোনো ধরনের হুমকি বা চাপ আসছে কি না—এ প্রশ্নে ইশরাত জাহান বলেন, ‘ফোনে কোনো হুমকি পাচ্ছি না। আমি আমার মোবাইল ফোন খোলা রেখেছি। সব কল রিসিভ করছি। মোবাইল ফোনের সব কথার রেকর্ড থেকে যায় বলে হয়তো এতে হুমকি পাচ্ছি না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি ওরা ওপর মহলে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। ’

আরও পড়ুন


ওবায়দুল কাদেরের বাড়িতে ককটেল হামলা কাদের মির্জার সাজানো: উপজেলা আ.লীগ

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবরী

নিজ বাসা থেকে অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের লাশ উদ্ধার

সহিংসতার দায় কোনোভাবেই হেফাজতের উপর বর্তায় না: মাওলানা মামুনুল হক


এদিকে কেন আসামিরা আটক হলো না—সেই প্রশ্নের উত্তরে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলছেন, মামলা হলেই আসামি ধরতে হবে এমন বিধান নেই। তদন্ত হচ্ছে, শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে অপরাধী প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) ইন্সপেক্টর মাইনুর রহমান বলেন, ‘আমি মাত্রই তদন্তভার বুঝে পেয়েছি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ’

সার্বিক এ পরিস্থিতি সম্পর্কে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না, নাকি নেপথ্য শক্তির চাপে করছে না, সেটিও এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের দাবি, দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেছেন, এমন মামলায় অপরাধী আসামির গ্রেপ্তার না হওয়া প্রশ্নবোধক। এর নেপথ্যে কোনো প্রভাশালী লোকের হাতে হাত আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

ব্যাংক কর্মকর্তার আত্মহত্যার এ বিষয় নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তোলপাড় চলছে। নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, নাগরিক কমিটির অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলছেন, দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে আসামিদের ধরতে হবে। তিনি বলেন, এই মামলায় তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধের সব উপাদান উদঘাটন করতে হবে। কেন তিনি (মোর্শেদ) আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কেন বা কিভাবে তাঁকে প্ররোচিত করা হয়েছিল, তার সত্যাসত্য তুলে এনে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। অপরাধী যিনিই হোন, তিনি সরকারদলীয় বা বিরোধীদলীয় যা-ই হোন, প্রচলিত আইনেই তাঁকে শাস্তি দিতে হবে। সূত্র: কালের কণ্ঠ।

news24bd.tv আহমেদ