রাজনীতি হলো মানুষকে খাঁচায় রাখার কৌশল

রাজনীতি হলো মানুষকে খাঁচায় রাখার কৌশল

Other

ইমতিয়াজ মাহমুদ নামের এক ভদ্রলোক বিজ্ঞানকে গালমন্দ করেছেন। গালমন্দটি আমার নজরে এসেছে, এবং পড়ে মনে হয়েছে, এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পার্থক্য না জানা কোনো বুড়ো মানুষের প্রলাপ। এ প্রলাপ অনেকে গ্রহণও করেছে, কারণ আলোর সাথে এ অঞ্চলের বাসিন্দারে যোগাযোগ খুব কম। প্রলাপটি তিনি শুরু করেছেন এভাবে:

“পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করছে বিজ্ঞান।

এমনকি রাজনীতির চেয়েও বেশি।   সহজ ভাষায় পুরোনো কথা বলি, সাগর আর মাটি প্লাস্টিক দিয়ে ধ্বংস করে ফেলছে। সেই প্লাস্টিক বিজ্ঞানের দান। বাতাস ধ্বংস করে ফেলছে, বিজ্ঞান।
…..”

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে, আমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একটু ব্যাখ্যা করতে চাই। বিজ্ঞান হলো একটি প্রক্রিয়া, যে-প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মানুষ নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করে থাকে। আর প্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রাপ্ত কোনো জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ। এ প্রয়োগের প্রকৃতি কেমন হবে, তা নির্ধারিত হয় প্রযুক্তিটির ম্যানুফ্যাকচারার বা স্পন্সর দ্বারা। স্পন্সর যদি মাদার তেরেসা হন, তাহলে প্রযুক্তি এক রকম হবে, আর যদি লেসলি গ্রুভস (গ্রুভস ছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টের পরিচালক) বা প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হন, তাহলে অন্য রকম হবে।  
মানুষ যখন জঙ্গলে ছিলো, তখন দেখলো যে— কোনো বস্তু যদি শক্ত হয়, যেমন পাথর বা লোহা, এবং এর একটি প্রান্তকে যদি ঘষে ঘষে সরু করা যায়, তাহলে এটি দ্বারা নরম বস্তুদের কাটা বা বিদ্ধ করা সম্ভব হবে। এ চিন্তাটা হলো বিজ্ঞান। আর এ চিন্তার প্রয়োগের ফলে যে-রামদা বা কোদাল বা বর্শা পাওয়া গেলো, তা হলো প্রযুক্তি। কোনো সমাজে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা। রাজনীতি যদি গার্হস্থ্য ধরণের হয়, তাহলে রামদা, কোদাল, ও বর্শা ব্যবহৃত হবে পশু শিকারে, কৃষিকাজে, ও রান্নাবান্নায়। আর যদি প্রভাব বিস্তারমূলক হয়, তাহলে তা ব্যবহৃত হবে গোত্র-কলহ ও যুদ্ধে।  

আধুনিক প্রযুক্তি বলতে মানুষ যা বোঝে, তার বয়স খুব বেশি নয়। এসব প্রযুক্তির বহু আগে থেকে পৃথিবীতে বিজ্ঞান ছিলো। নিউটনের কথাই ধরা যাক। তাঁর ল অব গ্র্যাভিটেশন এবং ক্লাসিকেল মেকানিক্সের ফর্মুলেশনগুলো বেশ বয়স্ক। কিন্তু পৃথিবীর ইস্কেইপ ভেলোসিটি আর বায়ুমন্ডলের ফ্রিকশোনাল হিট আমলে নিয়ে আকাশে স্যাটেলাইট ছুড়া হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। এই স্যাটেলাইট ছুড়াছুড়ি কিন্তু বিজ্ঞান নয়। এগুলো মানুষের রাজনীতি ও ব্যবসার অংশ মাত্র।  

ইমতিয়াজ মাহমুদের দাবি, প্লাস্টিক বিজ্ঞানের দান। তাকে দোষ দিই না, চিন্তা যখন খর্বাকৃতির হয় তখন প্লাস্টিককে অনেকেই বিজ্ঞানের দান মনে করতে পারেন। বিজ্ঞানের দান হলো পলিমারাইজেশোন ও পলিকনডেনসেশোন নামের দুটি কৌশল, যা ছিনতাই করে পুঁজিবাদী বণিকেরা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে প্লাস্টিক। আর এ প্লাস্টিক তারা তুলে দিয়েছে তাদের হাতে, যারা মাটি ও সাগরের প্রতি যত্নশীল নয়। তবে মুফতি ইব্রাহিম আর বাবা রাম রহিমের দেশ দুটি বাদে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষই তাদের নিজ নিজ মাটি ও সাগরের প্রতি যত্নশীল। তারা প্লাস্টিক বর্জ্যকে এমন একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে এসেছে, যেখানে একটি ছোট্ট পলিথিন ব্যাগের পক্ষেও আর সাগর বা কৃষিজমি ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ কৃতিত্ব যতোটা না বিজ্ঞানের, তার চেয়েও বেশি রাজনীতিকদের। ওই দেশগুলোর রাজনীতিকেরা বিচক্ষণ বলেই এটি সম্ভব হয়েছে।  

আর “বাতাস ধ্বংস করে ফেলেছে, বিজ্ঞান” এ কথাটি দিয়ে তিনি সম্ভবত গাড়ি ও কলকারখানার ধূয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তার বুঝা উচিত ছিলো যে, টয়োটা বা গুয়াংডং কর্পোরেশনের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে মানুষের লালসা, ও অর্থনীতির। বিজ্ঞান শুধু বলেছে, তাপকে মেকানিক্যাল মোশন ও ইলেকট্রিসিটিতে রূপান্তর করা সম্ভব। বাকিটুকো এগিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকেরা। অটোহানরা শুধু দেখিয়েছিলেন, পরমাণুকে ভাঙা সম্ভব, এবং এ ভাঙন থেকে, যেটিকে আমরা নিউক্লিয়ার ফিশান বলি, পাওয়া যেতে পারে অকল্পনীয় শক্তি। কিন্তু বোমা  বানানোর জন্য লস আলামোস ল্যাব স্থাপন করেছিলো রাজনীতিক ও মিলিটারি জেনারেলরা। আর বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ গবাদি পশুর খামার। এ বোভাইনদের পেট থেকেই সবচেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।  

আর বাংলাদেশ তো হয়ে উঠেছে জাপানি গাড়ির ডাম্পিং স্টেশন। যেখানে দেশটির উচিত ছিলো ব্রান্ড নিউ এবং ইলেকট্রিক ভেহিকলকে কর সুবিধা দেয়া, সেখানে তারা এগুলোর উপর বেশি করে কর আরোপ করেছে, এবং মানুষজনকে বাধ্য করছে পুরাতন জাপানি ভাঙা গাড়ি ক্রয় করতে। এ রিকন্ডিশোন্ড বা ভাঙা গাড়িগুলোর যে-ইঞ্জিন, তা বাংলাদেশের বাতাসের পুরোটিকেই বিষ বানিয়ে ছাড়বে। এক ভদ্রলোক একটি টেসলা আমদানি করেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিমানেরা ওই লোক থেকে ছয়শো শতাংশ কর আদায় করেছে। যেখানে উচিত ছিলো গাড়িটিকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া, সেখানে তারা এটির প্রবেশ রোধ করতে চেয়েছে।  

অস্ট্রেলিয়ার বাতাসে তোলা ছবি, বাংলাদেশের বাতাসে তোলা ছবির চেয়ে বহুগুণ সুন্দর কেন? একই কথা প্রযোজ্য ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, এবং সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে। ওই দেশগুলো তো প্রযুক্তিতে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে নেই, যদিও মূর্খতায় তারা অবশ্যই আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। আমার বাড়ির পাশ দিয়ে একটি খাল বয়ে গেছে, যেটিতে ছোটবেলায় আমি সাঁতার কেটেছি। তখন খালটির পানি ছিলো পানি, যা পান করে তৃপ্তি পেতো গ্রামের গরু, ভেড়া, ও হাঁসেরা। কিন্তু এখন, পুরো খালটি হয়ে উঠেছে আলকাতরার নালা। আমি অতিরঞ্জন করছি না, সত্যি সত্যিই আলকাতরা রঙের রাসায়নিকে ঢেকে গেছে খালটি। এ কৃতিত্ব একটি ডেনিম কারখানার। জেলার ডিসিকে আমি বহুবার ব্যাপারটি জানিয়েছি, কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেন নি। ব্যাপারটি এরকম নয় যে শুধু বাংলাদেশেই কল কারখানা আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলিউশানের জন্ম হয়েছে যে-দেশগুলোতে, সে-দেশগুলোর বাতাস ও পানির মানের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যাবে, বিজ্ঞান নয়, আমাদের বাতাস ও পানির দুরবস্থার জন্য দায়ী রাজনীতি, অর্থনীতি, ও দুর্নীতি। আমি চীনের কারখানাগুলোতে যে-মানের ইটিপি দেখেছি, তার এক তৃতীয়াংশ মানের ইটিপিও বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে দেখি নি। যদিও বাংলাদেশের পরিবেশ আইনে, ফুল ফাংশোনাল ইটিপি স্থাপনের বাধ্যবাদকতা রয়েছে। ইটের ভাটাগুলির কথা নাই বা বললাম। ইটের ভাটা যে কতো বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, তা তো আমরা সকলেই জানি।  

ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেছেন, “বিভিন্ন দেশ অসংখ্য স্যাটেলাইট পাঠিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথরেও বস্তি বানাইয়া ফেলছে”। মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর চারটি কারণ আছে। প্রথম কারণটি গবেষণা, দ্বিতীয়টি বাণিজ্যিক, তৃতীয়টি রাজনীতিক বা সামরিক, আর চতুর্থটি শখ বা অহংকার। সম্প্রতি একটি দেশ, অহংকার প্রদর্শনের জন্য আকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের সময়, গবেষণার চেয়ে রাজনীতিক কারণেই বেশি স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছিলো। আর এখন এলন মাস্ক নিয়ে এসেছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বাণিজ্যিক মডেল। আর্থ অরবিটাল যদি কোনো সময় সত্যিই ঢাকার কড়াইল বস্তি ওঠে, তাহলে দায়ী করতে হবে এই দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ কারণকে। বিজ্ঞান বা গবেষণাকে নয়।  

“বিজ্ঞান পৃথিবীরে এক দিলে কেড়ে নিছে দশ” এটি মনগড়া রোম্যান্টিক কথা। এটি বলে কিছু মানুষের মন উদাস করা যেতে পারে, নির্বোধ মর্টালদের কাছ বাহবা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবতার সাথে এ কথার দূরত্ব আলোক বর্ষের সমান। প্রথমত, মানুষের ম্যাটেরিয়াল অবসেসোনের জন্য বিজ্ঞান দায়ী নয়, দায়ী প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিব্যবসায়ীদের লোভ। পৃথিবীতে ভোগবাদ নামে যে নতুন ধর্মটি তৈরি হয়েছে, তার সাথে বিজ্ঞানের কোনো দেখা সাক্ষাৎ ঘটে না। এটি টিকে আছে মানুষের মগজহীনতাকে পুঁজি করে। দ্বিতীয়ত, আগে প্রকৃতি মানুষকে দশটি সন্তান দিলে কেড়ে নিতো নয়টি, আর এখন বিজ্ঞানের আঘাতে (আসলে হবে প্রযুক্তির আঘাতে) কেড়ে নিতে পারে না একটিও। এ বিষয়ে উদাহরণ দেয়া যাবে অনেক, তবে আমি কথা বাড়িয়ে আলোচনা লম্বা করতে চাই না।  

এবার ইমতিয়াজ মাহমুদ আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিপক্ষকে ডিহিউম্যনাইজ করার কৌশলের। ডিহিউম্যানাইজেশনের বাংলা, হুমায়ুন আজাদ করেছিলেন ‘বিমানবিকীকরণ’, আর আমি করেছিলাম ‘প্রাণীকরণ’ (কারণ গসেতের ডিহিউম্যানাইজেশন অব আর্টের চেয়ে আমার কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলো মানুষের এনিম্যালাইজেশন)।

তিনি লিখেছেন— “তো, এইসব কথা বললেই বিজ্ঞানরে পবিত্র জ্ঞান করা  কাঁটাবনের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানানুভূতি আহত হয়। তারা বলে, বিজ্ঞান ঠিক আছে, মানুষ খারাপ। আরে ভোঁদরের দল, ঐ হিসাবে রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি সবই ঠিক আছে, শুধু মানুষ খারাপ। ”
এখানে ইমতিয়াজ মাহমুদ তার প্রতিপক্ষের মোরাল ভেঙে দেয়ার জন্য সাহায্য নিয়েছেন এনিম্যালাইজেশনের, এবং টেনে এনেছেন ভোঁদরের মতো একটি সুন্দর প্রাণীকে। উদ্দেশ্য যখন অসুন্দর হয়, তখন এরকম একটি সুন্দর প্রাণীকে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করাটা বিস্ময়কর কিছু নয়। পুঁটি মাছ যখন কাতলা মাছের চরিত্রে অভিনয় করে, তখন এ বিপর্যয় ঘটে। কবি হুইটম্যান তাঁর একটি কবিতায় ভোঁদরদের (প্রাণীদের) খুব প্রশংসা করেছিলেন, এবং মনে মনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন ভোঁদর (প্রাণী) হওয়ার: 

I think I could turn and live with animals, they are 
so placid and self-contain’d,
I stand and look at them long and long.
They do not sweat and whine about their condition,
They do not lie awake in the dark and weep for their sins,
They do not make me sick discussing their duty to God,
Not one is dissatisfied, not one is demented with the mania of owning things,
Not one kneels to another, nor to his kind that lived thousands of years ago,
Not one is respectable or unhappy over the whole earth….

রাজনীতি আর ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের অত্যন্ত মৌলিক পার্থক্য আছে। ধর্ম স্থির, অবিচল। এর মূলনীতি— প্রচারেই প্রসার। এটি নিজের ধ্বংস অনুমোদন করে না। কিন্তু বিজ্ঞানের এক তত্ত্বকে আরেক তত্ত্ব দিয়ে বাতিল করা যায়। এরিস্টোটলের সময়ে, বিজ্ঞানের চোখে পৃথিবী যেরকম ছিলো, কোপার্নিকাসের সময়ে সেরকম ছিলো না। নিউটনের সময়ে মহাকর্ষ ছিলো একরকম, কিন্তু আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির পর মহাকর্ষ হয়ে গেলো অন্য রকম। এরিস্টোটলের চারটি স্পিরিটের কথা এখন আর কেউ বলে না। এখন আমরা আত্মা নামক ভূতের আশ্রয় না নিয়ে, মগজে নিরন্তর ঘটতে থাকা বায়ো-কেমিক্যাল রিয়েকশানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারি মানুষের মনকে। আর কাঁটাবনের বিজ্ঞানী কারা, এ সম্পর্কে আমার বিশদ জানা নেই। সম্ভবত তারা মুফতি ইব্রাহিম ঘরানার কেউ হবেন। এরকম হলে, কাঁটাবনের বিজ্ঞানী অভিধাটিতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ইমতিয়াজ মাহমুদ নিজে কাঁটাবনের বিজ্ঞানী কি না এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ থেকে যাবে।
 
রাজনীতি হলো মানুষকে খাঁচায় রাখার কৌশল, আর বৈজ্ঞানিকভাবে রাজনীতিক চিন্তা করা হলো মানুষকে খাঁচা থেকে বের করার কৌশল। দুটি দুই জিনিস। হবস  ও হিউম যেভাবে চিন্তা করতেন, সেটি ছিলো রাজনীতির বৈজ্ঞানিক চিন্তা। একটি লেবিয়াথান লেখা আর ভোটের জন্য রাজনীতি করা এক ব্যাপার নয়। হিউম তাঁর কাজকে বর্ণনা করেছিলেন ‘দ্য সায়েন্স অব হিউম্যান ন্যচার হিশেবে’, যেটিকে আমরা এখন রাজনীতি বলি। সে-হিশেবে রাজনীতিক তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলেও রাজনীতি করা কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাপার নয়। মানুষ রাজনীতি করে থাকে ক্ষমতা উপভোগের জন্যে, আর ক্ষমতার এ উপভোগ টিকিয়ে রাখার জন্যে সে আশ্রয় নেয় প্রযুক্তির। এক প্রযুক্তি দিয়ে মানুষ ফেসবুকে ঢোকে, আর আরেক প্রযুক্তি দিয়ে রাজনীতিকেরা ফেসবুক বন্ধ করে। ম্যাকিয়াভেলি তাঁর প্রিন্সকে মানুষ দমনের যে-বুদ্ধি দিয়েছিলেন, রাজনীতিকেরা প্রযুক্তির সাহায্যে সে-বুদ্ধিরই বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে। এখানে মূল উৎপাদ হলো রাজনীতিকের লক্ষ্য। হ্যাঁ, কিছু বাইপ্রোডাক্ট তৈরি হচ্ছে, যেগুলোর জন্য ইমতিয়াজ মাহমুদ অন্ধভাবে বিজ্ঞানকে গালমন্দ করছেন। আমেরিকার ডিফেন্স পলিসির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রি-এম্পটিভ মিজার বা আগাম সতর্কতা। এই প্রি-এম্পটিভ মিজারের অংশ হিশেবেই তারা সাগর মহাসাগরে অনেকগুলো পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, এবং তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে, কিন্তু বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে পৃথিবী পেলো তেজস্কক্রিয় জলবায়ু, দূষিত পানি, আর নানা প্রাণীর মৃতদেহ। এ কাজগুলো যারা করেছে তারা অস্ত্রধারী, এবং অস্ত্রধারী কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে আমরা বেশ ভয় পাই। ফলে গালাগালির জন্য অনেকে বেছে নেন নিরস্ত্র বিজ্ঞানকে। ইমতিয়াজ মাহমুদও তাই করেছেন।  

“গ্যালাক্সির দার্শনিক” শব্দগুচ্ছটির ‘গ্যালাক্সি’ অংশটি কিন্তু বিজ্ঞানের আবিষ্কার। আর ‘দার্শনিক’ শব্দটি বাংলাদেশে হয়ে উঠেছে ছাগলের মাথার মুকুটের মতো। যে যেভাবে পারছে শব্দটিকে ব্যবহার করছে। এদেশে যে কোনো কালে কোনো দার্শনিক জন্মান নি, এবং দর্শনের সাথে যে আমাদের কোনো পরিচয় নেই, তার বড় প্রমাণ এ শব্দটির অপপ্রয়োগ। একটি প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা বা ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিট কি আমাদের আছে? কান্টের তিনটি ক্রিটিকের সাথে, বা রাসেলের অন ডিনোটিংয়ের সাথে, বা শোপেনহাওয়ারের উইলের সাথে বা বেন্থামের ফ্রাগমেন্টের সাথে কি কোনো ভাবাবেগময় পদ্যের তুলনা করা যায়? কিন্তু বাঙালি করছে কবরবাসীর আচরণ। তারা যাকে তাকে ডাকছে দার্শনিক! আমি বিভিন্ন সভা সেমিনারেও লক্ষ করেছি, সস্তা রাজনীতি ও ইতিহাস উচ্চারণকারীদের দার্শনিক ডাকা হচ্ছে! গল্প, উপন্যাস, ছড়া, এবং কবিতা লেখেন, এমন মানুষদেরও দার্শনিক ডাকা হচ্ছে! এসব দেখে অন্য গ্যালাক্সিতে লুকিয়ে থাকা রুশো, লক, বার্কলেরা নিশ্চয়ই হাসাহাসি করছেন।  

“বিজ্ঞানরে পবিত্র জ্ঞান করার কিছু নাই”, বিজ্ঞান কি কারও কাছে পবিত্রতা দাবি করেছে? বিজ্ঞান কি মানুষ যে এর স্থলন ঘটে? যাদের লুঙ্গি সারাক্ষণ নষ্ট থাকে তারা এ কাজ করলে করতে পারে, কিন্তু এদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো যোগাযোগ নেই। এরা বড়জোর প্রযুক্তিভক্ত উন্মাদ। আর মানুষের অভ্যাস বদলিয়েছে মানুষ। এক মানুষ আরেক মানুষকে টোপ দেখিয়েছে নতুন পণ্যের, আর অমনি আলসে মানুষেরা গিলেছে ওই বড়শী। এখন আটকা পড়ে লাথি মারছে বিজ্ঞানের উপর। স্বর্ণ তো এক প্রকার ধাতব পাথর, মানুষের জীবনে এটি কোনো কাজে লাগে বলে শোনা যায় না, কিন্তু এটি লাখ টাকা দিয়ে কেনার অভ্যাস মানুষ কেন করলো? স্বর্ণ মূল্যবান, এটি তো বিজ্ঞান রটায় নি। রটিয়েছিলো অর্থলোভী মানুষেরা। স্মার্টফোনের ব্যবসা তো সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা করছে না, করছে প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা।  

মানুষকে ক্ষুধা, ভয়, মৃত্যু, অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির দায়িত্ব বিজ্ঞান নেয় নি, নিয়েছিলো ধর্মনেতা ও রাজনীতিকেরা। রুশ জারদের হাত থেকে এ দায়িত্ব লেনিন নিয়েছিলো, এবং মানুষ দিয়ে ভরে ফেলেছিলো কারাগার। বহু দেশে এখন, না খেয়ে মারা যাওয়ার চেয়ে মেদ-ভুঁড়িতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অসুখে মারা যাওয়ার চেয়ে যুদ্ধে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এগুলো মানুষের দুর্দশার বৈজ্ঞানিক কারণ নয়, সামাজিক ও রাজনীতিক কারণ।  

“হাজার হাজার বছরেও মানুষের বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয় নাই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব অহংকার নিয়ে মানুষ এখনো কুত্তার মতন অসহায়”, এগুলো হলো চিপ রেটোরিক। কুত্তা কখনোই অসহায় ছিলো না। কুত্তা অসহায় হয়েছে মানুষ কর্তৃক কুত্তার ডোমেস্টিকেশন বা গৃহপালিতকরণের পর। মানুষ ও কুত্তা যখন উভয়েই জঙ্গলে ছিলো, তখন কুত্তা মানুষের চেয়ে ভালো খাবার খেতো। মানুষকে দীর্ঘকাল অন্য প্রাণীর উচ্ছিষ্ট খেতে হয়েছে। শক্তিমান প্রাণীরা যখন শিকার ধরে মাংস খেতো, এবং মাংস খেয়ে হাড়গোড় ফেলে যেতো, তখন মানুষ ওই ফেলে যাওয়া হাড় ভেঙে বোনম্যারো খেতো।  
বিজ্ঞানকেও গালমন্দ করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, কিন্তু ইমতিয়াজ মাহমুদ ওই পড়াশোনো আর পরিশ্রমের পথে হাঁটতে চান নি। তিনি হেঁটে গিয়েছেন সেই পথে, যে-পথে বাঙালি, লাইন ধরে পিঁপড়ার মতো যায়।  

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

মহিউদ্দিন মোহাম্মদ 

news24bd.tv/আলী