কোনও গণ্ডমূর্খও এই কথার বিরোধিতা করবে না

কোনও গণ্ডমূর্খও এই কথার বিরোধিতা করবে না

Other

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: একটি তরলপাঠ

আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ এমনটি মনে করেন সবাই। কোনো গণ্ডমূর্খও এ কথার বিরোধিতা করবে না। কিন্তু এটা কি সবাই বুঝে বলেন? এমন প্রশ্ন সচরাচর মাথায় আসার কথাই না। এলেও হয়তো উত্তর হবে: এটা না বোঝার কী আছে? আসলেই কি? বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষ প্রযুক্তিকেই বিজ্ঞান ঠাওরে বসে আছেন!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরস্পর ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত বলেই হয়তো এ দুটোর পার্থক্য এড়িয়ে যাই আমরা।

কিন্তু এতে বিপত্তি ঘটতে পারে। আবার প্রযুক্তি ও এর ব্যবহার এক নয়। দুটো গুলিয়ে ফেললে সমস্যা হয়। আর এই দ্বিবিধ কারণেই আমরা প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারকে বিজ্ঞানের অভিশাপ বলে ভুল করি, গাল পাড়ি।

সাধারণভাবে বলা হয় বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান। কিন্তু এই বিশেষ জ্ঞানটা কী? এটা থাকে কোথায়? আর আমরাই বা কীভাবে এটি পাই? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিজ্ঞানের সূচনা পর্বের দিকে নজর দিলে সুবিধা হবে বলে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি বিজ্ঞানের সঙ্গে আবিষ্কারের একটা সম্পর্ক আছে গোড়া থেকেই।

তো আবিষ্কার জিনিসটা কী? শব্দটি বেশ ভারী ও গুরুগম্ভীর। বই-পুস্তকের সুবাদে এই শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত হলেও বাস্তবে দেখা যায় যে এর অর্থ সম্পর্কে অনেকের ধারণা স্বচ্ছ নয়। শব্দটি সংস্কৃত। এর সহজ বা খাঁটি বাংলা অর্থ হলো কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া বা খুঁজে বের করা। হঠাৎ কোনো কিছু খুঁজে পাওয়াকেও আবিষ্কার বলা হয়।

পৃথিবীতে বসবাসের শুরুতেই মানুষের সবকিছু জানা থাকলে কোনো কিছুই আবিষ্কার হতো না বা করার প্রয়োজন পড়তো না। জগতে আবিষ্কারের সূচনা আছে, কিন্তু শেষ আছে মনে হয় না। এটি একটি চলমান বিষয়। তো কখন ও কীভাবে আবিষ্কারে সূচনা হয়? কোন জিনিসটি মানুষ প্রথম আবিষ্কার করে?

আবিষ্কারে সূচনা ঠিক কখন হয় তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয় মানুষ প্রথম যেসব জিনিস আবিষ্কার করে তার মধ্যে আগুন অন্যতম। কীভাবে? মানুষ অবিষ্কার করলো বা দেখতে পেলো যে জঙ্গলে বিজলী বা বজ্রের আঘাতের ফলে আগুন জ্বলে। এটি দেখে তার মধ্যে বিস্ময় ও কৌতুহলের সৃষ্টি হয়।  

মানুষ দেখতে পায় আগুন জ্বললে আলো বিচ্ছুরিত হয়। গাছ-পালা পুড়ে যায়। এসময় তাপ নির্গত হয়। এগুলোকে আধুনিক ভাষায় বলে আগুনের ধর্ম। এক পর্যায়ে সে পাথরে পাথর ঘঁষে আগুন জ্বালাতে শেখে। এখানে মূলসূত্র হলো ঘর্ষণ। পরে মানুষ আরো নানাভাবে আগুন জ্বালাতে শেখে। শেখে এর নানা ব্যবহার। উদ্ভাবন করে আগুন জ্বালানোর নানা কৌশল বা প্রযুক্তি।

আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ, আগুনে মাংস সিদ্ধ করা এবং পরে মশাল জ্বালিয়ে অন্ধকার দূরীকরণ রপ্ত করে সে। এই যে মশাল এটি কিন্তু একটি প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে সহজে আগুন পরিবহন করা সম্ভব। এছাড়া এর আরো বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। সে ব্যবহার যেমন ইতিবাচক হতে পারে, হতে পারে নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্মক।

সে যাই হোক, এতক্ষণ ধরে যে আগুন আগুন করছি সেটি আসলে কী? এটি আসলে এক ধরনের শক্তি। এ শক্তি প্রাকৃতিক। মানুষ তা খুঁজে বের করেছে মাত্র। মানুষ দেখতে পেয়েছে বাতাসে থাকা অক্সিজেন ও জ্বালানি উৎসের মধ্যে বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আগুন উৎপন্ন হয়। আগুন কী ও কীভাবে জ্বলে তা খুঁজে বের করতে গিয়ে সে যে চিন্তা-ভাবনা করেছে এটাকে বলা যায় গবেষণা।
কথায় কথায় অনেক কথা তো হলো। কিন্তু বিজ্ঞান কী তা কি পরিষ্কার হলো? আমরা দেখতে পেলাম বিজ্ঞান প্রকৃতিতেই নিহিত থাকে। মানুষ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা খুঁজে বের করে মাত্র। আধুনিক অর্থে এই বিদ্যাকেই বিজ্ঞান বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিধাতা আমাদের চারপাশের জগৎ বা প্রকৃতিতে যে জ্ঞান নিহিত রেখেছেন তা উদ্ঘাটন করার নামই বিজ্ঞান।

আর প্রযুক্তি? এটি হলো বিজ্ঞানের ব্যবহারের নানা কৌশল। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য মানুষের কাজ-কর্ম সহজ করে তোলা। ঢেঁকিও একটি প্রযুক্তি, পুরানো হলেও। অটো রাইসমিল যার আধুনিক সংস্করণ। বিজ্ঞান ব্যবহার করেই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। কিন্তু তাই বলে প্রযুক্তি বিজ্ঞান নয়।  

প্রযুক্তির ব্যবহার ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে। তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর।

আগুন পোড়ায়। এটা তার ধর্ম। আমরা পাত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আগুনের পুড়ানোর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এর উত্তাপকে কাজে লাগিয়ে রান্না করি। এটি প্রযুক্তি। পাত্র ও চুলা দুটোই এক্ষেত্রে প্রযুক্তি। এবং ভালো প্রযুক্তি। এখন কেউ যদি কোনো প্রযুক্তি, যেমন ম্যাচ বা লাইটার ব্যবহার করে কারো ঘরে আগুন দেয়, তাহলে দোষ কি আগুনের না প্রযুক্তির? নাকি বিজ্ঞানের?

হারুন আল নাসিফ : কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী