ধর্মের নামে অধর্ম

ধর্মের নামে অধর্ম

Other

অনেকটা ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের মত। গ্রাম থেকে শহর অভিমুখে হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা, বন্দুক উঁচিয়ে রওয়ানা হলো। সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে আগুন জ্বললো! তারপর দেশটি নিমজ্জিত হলো চিরস্থায়ী গৃহযুদ্ধে।  

ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের এক দশক হতে চলল।

নিউইয়র্কে বহু মুদি দোকান এবং গাড়ি চালিয়ে জীবন নির্বাহ করা বহু ইয়েমেনী। তাদের গৃহযুদ্ধের কারণ জিজ্ঞেস করেছি। কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারে না- কেন এই গৃহযুদ্ধ? অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং অপুষ্টিতে জর্জরিত একটি জাতি কেন দিনদিন অন্ধকারের গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে!

কোনো কোনো ইয়েমেনী বলেছে- হুতিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ইরানী ভাবধারার বিস্তৃতি ঘটেছে। অনেক সুন্নী ইরানী টাকার লোভে শিয়া হয়ে গেছে।

এখন তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলটাই বাকি। ইরান যেহেতু এসেছে, তাই বিপরীতে সৌদি আরবের অংশগ্রহণ অবধারিত। হাতি-ঘোড়ার লডাইয়ে প্রাণ যাচ্ছে উলু-খাগড়ার!

আফগানিস্তানের তালেবান কিংবা পাকিস্তানের তালিবানদের কথাই ধরুন। আফগানিস্তান পুরোটাই জিম্মি তালেবান দমন পীড়নে। পাকিস্তান মাঝেমাঝেই বিস্ফোরিত হয় ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আস্ফালনে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অঁকেজো করে দেয়ার মত! 

চলতি সপ্তায় এরা লাহোর নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। ১১ জন পুলিশ সদস্যকে জিম্মি করে বুঝিয়ে দিয়েছে, এরা ইচ্ছে করলে সিভিল প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে! বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে সেদিকেই যাচ্ছে!

বাংলাদেশের ভেতরে বাইরে থেকে ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে অনৈতিক কাজে মদত দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করি। একটি হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে এই মদত দেয়ার পেছনে। আড়ালের রাজনৈতিক নেতারা কেবল ব্যবহার করে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের।  

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনৈতিক নেতাদের অসৎ উদ্দেশ্য ও মিথ্যাচার ধরে ফেলেছে। তাই ব্যাপকভাবে অন্তত ৯০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী আর নেতাদের বিশ্বাস করে না। তাদের কথায় এক মিনিটও সময় নষ্ট করতে চায় না।  

বাকি থাকে ১০ শতাংশ। এদের কেউ কেউ সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় নিজেদের আখের গোছানোর মতলবে। এবং খুব সামান্য একটি অংশ হয়ত ন্যায়ের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের নষ্টালজিয়ায় ভোগে। কাজেই নষ্ট রাজনীতির আকাঙ্খা পূরণে এখন তাই মাদ্রাসার ছাত্ররাই একমাত্র ভরসা।  

মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের উস্তাদের উস্কানিতে শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় আগুন জ্বালায়। জনগণের সম্পত্তি ধ্বংস করে। কয়েকজন হয়ত পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেয়। বাকিরা আবার ফিরে যায় মাদ্রাসায়। গত এক দশকে এটিই বাংলাদেশের চালচিত্র।  

বাংলাদেশের এইসব মাদ্রাসার ছাত্র কারা? এদের মোচ-দাড়িও গজায়নি ঠিকমত। উস্তাদের রক্তচক্ষু ও উস্কানিকে এরা বিধাতার আদেশ মনে করে। সামাজিকভাবে এরা হীন ও দরিদ্র। উস্তাদ এবং মাদ্রাসার কল্যাণে এদের অন্তত ৮০ শতাংশের ভাত-কাপড়ের সংস্থান হয়েছে!

বাংলাদেশের উঠতি ধনীক শ্রেণীর বদান্যতায় চলে মাদ্রাসাগুলো। এর সঙ্গে যুক্ত প্রবাসীদের অর্থানুকূল্য। এই দু’টি উৎসই জানে না বাংলাদেশের উত্থান ও জন্মলাভের ইতিবৃত্ত। এরা জীবনযাপনে আধুনিক হলেও পশ্চাদপদ মানসিকতার।  

মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার যে সব সরলপ্রাণ বাংলাদেশী বিনাবাক্য ব্যয়ে বাংলাদেশের মসজিদ মাদ্রাসায় টাকা ঢালেন, তারা কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও জানতে চান না সেসব মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয়। সেখানে শিক্ষক হিসেবে কারা কর্মরত।  

পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে হুজুরদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা ব্লাসফেমী আইনের সমতুল্য। এক পাকিস্তানীকে আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম- এই যে তোমাদের দেশে শিয়া মসজিদে সুন্নীরা গুলি করে মানুষ হত্যা করে, কিংবা শিয়ারা সুন্নী মসজিদে গুলি চালায়, এসব কি ইসলাম সম্মত? 

উত্তরে সে বলেছিল- এরা পরস্পরকে মুসলমানই মনে করে না! বলে ‘ফেৎনা’ সৃষ্টিকারী। আর ‘ফেৎনা’ সৃষ্টিকারীদের ধ্বংস করা না গেলে আসল ইসলাম নাকি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না! 

এই যে ধর্মের নামে অধর্ম চলে, এর বিস্তার শুরু হয়েছে আমাদের দেশেও। এই বিষধর সাপকে রুখবেন কী দিয়ে? কারা বলবে- ধ্বংস, বিভিষিকা, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ধর্মের মর্মবাণী নয়! সমাজকে শান্তি ও কল্যাণের পথে ধাবিত করাই ধর্মের কাজ।  

পরস্পরকে জানা, বুঝা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মধ্যেই ধর্মের মর্মবাণী নিহিত। যতদিন পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে আত্মপোলব্ধি জাগ্রত না হবে, যতদিন পর্যন্ত সমাজের অপশক্তিকে সততা ও সাহসিকতা দিয়ে মোকাবিলার প্রস্তুতি অর্জিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত অন্ধকার এবং কুসংস্কার আমাদের পিছু ছাড়বে না! 

ধর্মকে নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের উপলব্ধির সময় হয়েছে বহু আগেই যে, এই বাড়াবাড়ি ধর্মের কোনো কাজে লাগে না। বরং ধার্মিক মানুষেরা তাদের আচরণে হয় বীতশ্রদ্ধ। যারা সমাজের মঙ্গল এবং কল্যাণ কামনা করেন- উন্নাসিকতা ও নীরবতার দিন শেষ হয়েছে তাদেরও। একটিবার গর্জে উঠুন এবং বলুন- ধর্মের নামে সমাজে অধর্ম চলতে পারে না!

লেখক: চৌধুরী জহিরুল ইসলাম, নিউইয়র্ক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী

এই রকম আরও টপিক