অনন্য মুহাম্মাদ (স.)

অনন্য মুহাম্মাদ (স.)

Other

মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনের বড় বড় ঘটনাগুলো আমাকে তেমন আলোড়িত করে না। মহামানবদের জীবন ঘটনাবহুলই হয়। কিন্তু আমাকে যে ব্যাপারগুলো সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য করে, তা হল তাঁর ছোটখাটো জীবনাচারসমূহ। তাঁর পরম পরিচ্ছন্নতাবোধ, স্নানের রীতি, নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার করা, চুল-নখ কাটা, খাদ্যগ্রহণ বা শৌচকার্যের আদবকেতাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরম পরিমিতিবোধ তাঁর সময়ের তুলনায় তো বটেই, এই যুগেও অত্যন্ত উঁচু স্ট্যান্ডার্ডের।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই জীবনাচারগুলোর বিবরণ খুব স্পষ্ট এবং অবিসংবাদিত অবস্থায় পাওয়া যায়, এসবে কোন মিথোলোজিক্যাল রঙ চড়েনি। আরও বিস্ময়কর হল, এই তথ্যসমূহের পরিব্যাপ্তি!

জীবনাচারের সকল সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর এত বড় ভাণ্ডার একটা মানুষ থেকে এসেছে ভাবাই যায় না। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীবনাচারের এত হাই ডিটেইলস আর কোন মানুষের পাওয়া যায় না। আপনি এযুগের অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও এখনকার কোন মানুষের এত সূক্ষ্ম জীবনাচার জানতে পারবেন বলে মনে হয় না, সেখানে পনের শতক আগের একজন মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসের  তথ্যাদির বিপুল প্রাপ্যতা হতবাক করে দেয়।

  জানলে বা শুনলে মনে হয় তিনি আমাদের মতই কোন রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন, আর তাঁর অভ্যাসগুলো চাইলে যে কেউ রপ্ত করে নিতে পারে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, তিনি পনেরশত বছর আগে ফল খাবার আগে ধুয়ে খেতে বলেছেন, যে ছুরি/বটি দিয়ে ফল কাটতে হবে, তাও ধুয়ে পরিষ্কার করতে বলেছেন। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তাতে খাওয়াদাওয়া সেরে সেটা কিভাবে পরিষ্কার করে ভাঁজ করে তুলে রাখতে হবে সে সম্পর্কে তার নির্দেশনা সংক্রান্ত বিবরণও মিলবে হাদিসে, যা আমার কাছে আলেকজান্ডারের পারস্য বিজয়ের চেয়েও বিস্ময়কর মনে হয়।

তিনি পাঁচবার দাঁত মিসাওয়াক করতেন, প্রতিবার খেয়ে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করতেন। মুখের দুর্গন্ধ তাঁর ভীষণ অপ্রিয় ছিল এবং তা থেকে সদাই মুক্ত থাকতেন। আমি এই যুগেও খুব কম মানুষের মুখ পুরোপুরি দুর্গন্ধমুক্ত পাই। শৌচকার্যের পর খুব ভাল করে পরিষ্কার হতেন এবং এই ব্যাপারে তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে কড়া নির্দেশ দিতেন। ইসলামের সবচেয়ে কঠোর বিধিবিধানগুলোর কয়েকটা হল এই শৌচকার্যের পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন সংক্রান্ত। বিস্ময়কর এই যে, মানুষটা উন্মুক্ত শৌচকার্য আজ থেকে দেড় সহস্রাব্দ আগে চরমভাবে নিষিদ্ধ করে গেছেন যা বর্তমান সভ্যতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়।

প্রতিদিন গোসল তো বটেই, তিনি চুল দাড়ি গোঁফও সবসময় পরিমিত/পরিষ্কার রাখতেন এবং শরীরের অন্যান্য স্থানের লোমগুলোও নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেঁটে ফেলতেন। তাঁর গোসলের সংজ্ঞা ছিল খুবই উন্নত, তদনুযায়ী মুখ এবং নাকের ভেতরসহ প্রতিটা লোমকূপের গোড়ায় পানি সঞ্চালন অত্যাবশ্যক যা আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়। তিনি খুব স্বল্পাহারী ছিলেন। তাঁর খাবার সময় বসার নিয়মটি আমাকে হতবাক করে। ভঙ্গিটি খুবই ইউনিক এবং অকাট্য যৌক্তিকতায় ভরা।

এমনভাবে বসতে হবে যেন বাঁ পা পাকস্থলীর ওপর একটা চাপ দিয়ে রাখে। চাপে পাকস্থলীর আকার ছোট হয়ে যাবে এবং কম খাবারেই উদর পূর্ণ বলে মনে হবে। তিনি পেট ভরার আগেই খাবার খাওয়া বন্ধ করতে বলেছেন, নির্বিচার উদরপূর্তিই কিন্তু যাবতীয় পাকাশয়ের পীড়ার স্রষ্টা, আর পেটের সমস্যা মানে যাবতীয় জাগতিক সমস্যা। সকালে, দুপুরে , রাতে কিভাবে কতটুকু খেতে হবে তাও তার বয়ানে পাওয়া যায়, সহস্রাব্দ প্রাচীন সোর্সেই সেসব আছে।

শরীরে সুগন্ধ ব্যবহারে তাঁর উন্নত রুচির পরিচয় পাওয়া যায়; চরম দারিদ্র্যের মুহূর্তেও তাঁর শরীর থেকে সুবাস আসত; ব্যাপারটা আসলে প্রাচুর্যের নয়, বরং পুরোই রুচিবোধের। ইউরোপে এসে বিষয়টা বুঝলাম। সবার শরীরেই সুগন্ধির সুবাস। বাজারে এক দেড় ডলারেও চমৎকার সুগন্ধি মিলছে। যে কেউ অনায়াসেই তার শরীর সুবাসিত রাখতে পারে। এটা কিন্তু এতদিনে এরা করতে পারছে, যাতে মুহাম্মাদ (সঃ) আরও পনেরশ বছর আগেই অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি সদাই কাপড় পরিষ্কার রাখতেন এবং তাও করতেন নিজ হাতেই, কাপড় কাচা সংক্রান্ত নির্দেশনাও হাদিসে আছে অনেকগুলো, এই হাদিসগুলোও আবার সিহাহ সিত্তাহরই অন্তর্গত। যেখানে সেখানে ময়লা নিক্ষেপ, উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি দূষণরোধে তাঁর নিষেধাজ্ঞা শুনলে রীতিমত অবাক হতে হয়। জানালা দিয়ে বাইরে ময়লা বা পানি নিক্ষেপের ব্যাপারে তাঁর হাদিসের গভীর তাৎপর্যতা আমাকে হতবাক করেছে। তিনি সবসময় মৃদু স্বরে কথা বলতেন, সবাইকে সবার আগে সালাম জানাতেন, হ্যান্ডশেক করতেন। তিনি তাঁর নিজ গৃহে প্রবেশের আগেও অনুমতি নিতেন। সব মানুষ তো বটেই, স্ত্রী এবং মেয়েদের সাথে তাঁর আচরণের কথা পড়লে হতবাক হতে হয়। তিনি হাঁটতেন মেরুদণ্ড সোজা করে অথচ দৃষ্টি থাকত আনত। তিনি শরীর সুস্থ রাখতে শরীরচর্চা সংক্রান্ত নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। তিনি কোন উদাস জিনিয়াস ছিলেন না, বরং ছিলেন সমাজ-সংসারের ব্যাপারে নিখুঁতভাবে দায়িত্বপরায়ণ। সবরকমের অপচয়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদাই সরব। আমি আশ্চর্য হই যে তাঁর এই সুন্দর অভ্যাসগুলোকে এখন চরম সুসভ্য এবং স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে পালনীয় ধরা হচ্ছে। ঘুমুবার সময়েও তাঁর অনেক নির্দেশনা আছে, যেমন কখন কোন দিকে কাত হয়ে শুতে হবে, কতক্ষণ শুতে হবে বা দুপুরবেলার খাবার পরের বিশ্রামরীতি যা হাইপারঅ্যাসিডীটি নিবারক ও নিরোধক। সবকিছু এসেছে একটা মানুষের কাছ থেকেই। বিস্ময়কর এই যে, তাঁর এসব চর্চার বিবরণগুলো অত্যন্ত প্রাচীন কিন্তু কোন অতিমানবিকতার ছাপ নেই, বরং একেবারেই সাদামাটা। তাঁর বা তাঁর আগে পরের আমলের সব মহামানবই দেখি অতিমানবীয় সব সুপারপাওয়ারের অধিকারী, তাঁরা কেউ গদার আঘাতে সিংহ খতম করে হারকিউলিস হয়েছেন কিংবা আদিগন্ত রাখস ছুটিয়ে লাখো গর্দান নিয়ে দিগবিজয়ী বীর রুস্তম হয়েছেন। তাঁদের তুলনায় আমার কাছে মানুষ মুহাম্মাদের এই সাধারণত্বটাই সবচেয়ে অসাধারণ মনে হয়। আপাতঃদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হতে পারে কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সার্বিক বিবেচনায় তিনি এসব সাধারণ অভ্যাসের মধ্য দিয়েই একজন ‘স্বাভাবিক’ অতিমানবের রূপ ধারণ করেছেন। মুহাম্মদ আসলে অসাধারণ হয়েছেন সাধারণত্বের ভেতর দিয়ে। অন্যান্য কীর্তিমানের সাথে এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য তাঁর। এমন নিখুঁত, সুসভ্য , সুশৃঙ্খল জীবনাচার তৎকালে একেবারেই ছিল না, এখনও বিরল। সত্যই তাঁর দৈনন্দিন জীবনাচার বর্তমান যুগেও সামগ্রিকভাবে মানুষের যাবতীয় সুসভ্য আচরণকে সংজ্ঞায়িত করে। আমি যখন মহামনিষীদের জীবনী পড়ি, তখন দেখি শুধুই তাঁদের সংগ্রাম, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সাফল্য আর কীর্তিগাঁথার কথা। মুহাম্মাদের তো এসব আছেই, সেই সাথে আছে অনন্য উন্নত জীবনানুষঙ্গ যার ডিটেইল্ড বিবরণ সাধারণ্যে অবারিত। নবী মুহাম্মদের চেয়েও মানুষ মুহাম্মদই আমার কাছে অধিক অবাককর, অনুকরণীয় আদর্শে পরিপূর্ণ এক কালোত্তীর্ণ সত্ত্বা। মুহাম্মাদ (সঃ) আমার চোখে পৃথিবীর প্রথম পরিপূর্ণ সভ্য মানুষ। আফসোস এই যে, সুসভ্যতার পরম মানদণ্ড মানুষ মুহাম্মাদ আজ মুসলমানদের মাঝেই সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত।

(অনন্য মুহাম্মাদ (স.) - মুহাম্মাদ তালুতের প্রবন্ধ)