‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এটি ডারউইন বা বিজ্ঞানের কেউ বলে নি

‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এটি ডারউইন বা বিজ্ঞানের কেউ বলে নি

Other

মনে বিজ্ঞান বিদ্বেষ পোষণ করেন, এরকম কয়েকজন বাংলাদেশীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদের দাবি— ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এরকম একটি কথা না কি বিজ্ঞান বলেছে, এবং এ কারণে তারা বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। শুনে আমি খুব অবাক হলাম। তাদের জিগ্যেস করলাম, এটি আপনারা কোথায় শুনেছেন বা পড়েছেন? তারা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও পত্রপত্রিকার রেফারেন্স দিলো, এবং বললো— ডারউইন নামের একজন নাস্তিক বিজ্ঞানী এটি বলেছেন।

আমি বললাম, কথাটি সত্য কি না তা কি আপনারা যাচাই করেছেন? তাদের উত্তর— না। যেহেতু কথাটি ছাপা অক্ষরে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, এবং ওয়াজ মাহফিলের সত্যবাদীরা কথাটিকে বিজ্ঞানের বলে প্রচার করেছে, সেহেতু তারা ধরে নিয়েছেন যে কথাটি সত্য! 

তারপর আমি ওয়াজ করেন, এরকম একজন ভালো মৌলানার সাথে কথা বললাম, যিনি ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এ কথাটি বিভিন্ন মাহফিলে প্রচার করেছেন। জিগ্যেস করলাম, আপনি ডারউইনের ‘দি অরিজিন অব স্পিসিস’, ‘দি ডিসেন্ট অব ম্যান’, এবং ‘দি ভয়েজ অব দি বিগল’ বই তিনটি পড়েছেন কি না? তিনি স্বীকার করলেন, পড়া দূরের কথা, বই তিনটির নামও কখনও শোনেন নি। একই প্রশ্ন কয়েকজন শিক্ষককে করলাম, তারাও না-বোধক উত্তর দিলেন, কিন্তু তারা জানালেন যে এ বিষয়ে তারা বিভিন্ন টেক্সট বইয়ে পড়েছেন, কিন্তু ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এরকম কোনো কথা তারা পান নি।

 

এ পর্যায়ে আমার একটি ছবির কথা মনে পড়লো। ছবিটি প্রথম দেখেছিলাম গাজী আজমলের একটি বইয়ে (সম্ভবত অন্যদের বইয়েও ছবিটি ছিলো)। বইটি উচ্চ মাধ্যমিকে আমাদের টেক্সট বই ছিলো।  

ওই বইয়ে একটি ছবি ছিলো এরকম:
বানর সদৃশ বা গরিলা সদৃশ একটি প্রাণী, ধীরে ধীরে, লাখ লাখ বছরের ব্যবধানে, তার আদল বদলিয়ে মানুষে পরিণত হচ্ছে।
ওয়ালেস, ডারউইন, ও ল্যামার্কের কাজের পর এ ধরণের ছবি বা ইলাস্ট্রেশন অনেক শিল্পীই এঁকেছেন। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটি এঁকেছিলেন রুডলফ জালিঙ্গার। ছবিটির নাম ছিলো ‘মার্চ অব প্রোগ্রেস’। গাজী আজমল সম্ভবত ওই ছবিটিকেই, কোনো প্রকার ডিসক্লেইমার ছাড়া, তার বইয়ে ব্যবহার করেছিলেন। আমাদের যেহেতু কোনো কিছুকেই গভীরভাবে তলিয়ে দেখার অভ্যাস নেই, তাই আমরা ধরে নিলাম যে ওই ছবিটি নিশ্চয়ই ডারউনের আঁকা! ডারউইন নিশ্চয়ই বলেছেন ‘মানুষ এসেছে বানর থেকে! 

সত্য হলো, ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এটি ডারউইন বা বিজ্ঞানের কেউ বলে নি। ডারউইনের তিনটি বইয়ের কোথাও আমি এমনটি লেখা পাই নি। এটি রটিয়েছে কবিরাজেরা। কবিরাজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে, ধর্মপাগল মানুষদের লেলিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের পেছনে। ডারউইনের কোনো বই এ কবিরাজদের পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। তারা পড়েছে তাদের আকৃতির পত্রিকা, তারা শুনেছে তাদের আকৃতির রটনা, আর মগজ ধুইয়েছে কোটি কোটি তরুণ ও বৃদ্ধের। এ অঞ্চলে মগজের ময়লা এতো দূর থেকে দেখা যায় যে, তা ধুইয়ে দিতে কাছে আসার প্রয়োজন নেই। দূর থেকে থুথু ছিটিয়ে দিয়েই এ মগজ ধুইয়ে দেয়া সম্ভব।  

যারা এ থুথু ছিটাচ্ছে, তাদের বিজ্ঞানভীতির প্রধান কারণ— বিজ্ঞান মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। গামছার আড়ালের সত্যটুকো যেন মানুষ দেখে না ফেলে, এ জন্যই তাদের এ আয়োজন। একবার যদি মানুষ প্রশ্ন করা শিখে ফেলে, তাহলে তাদের অস্তিত্ব যে বিপন্ন হয়ে যাবে, তা তারা জানে। এজন্য সাধারণ মানুষদের তারা, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে উস্কে দিচ্ছে। এ কৌশলগুলোর একটি হলো, মানুষের কিছু অপকর্মকে বিজ্ঞানের অপকর্ম হিশেবে প্রচার করা, এবং বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলা, যদিও তারা জানে, বিজ্ঞান ছাড়া আধুনিক মানুষ চলতে পারবে না একটি মিনিটও।  

বিজ্ঞান কোনো প্রাণী নয়, এর হাত পা চোখ দাঁত কোনোটিই নেই। এটি কোনো ভূতও নয় যে মানুষের শরীরে আছর করে, তাকে দিয়ে করিয়ে নেবে অপকর্ম। এটি একটি ধারণা মাত্র। এটি চিন্তা করার একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, এবং মানুষের এটি অংশ, যাদের শরীরে মাংসের চেয়ে মগজের ক্রিয়া বেশি চলে, আদিকাল থেকে এ প্রক্রিয়ায় চিন্তা করে আসছে। এ প্রক্রিয়াতেই তারা পাথরের সাথে পাথর ঘষে আগুন জ্বালিয়েছে, রান্না করেছে, এবং মাঝে মাঝে দুর্ঘটনায় নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।  

মানুষের সাথে বিজ্ঞান কতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তা বুঝতে একটি সাধারণ উদাহরণ দিই:
ধরা যাক আধুনিক বিজ্ঞানের সকল অবদান থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন, এবং চলে গেলেন জঙ্গলে। আপনি ন্যাংটো। গায়ে শার্ট নেই, পরনে লুঙ্গি নেই, কোমরে ঘুনসি নেই। গোসলের জন্য সাবান নেই, চুল ধোয়ার জন্য শ্যাম্পু নেই। এ নিয়ে আপনি চিন্তিত নন, কারণ বেঁচে থাকাই আপনার কাছে মুখ্য। আপনি একটি বড়ই গাছ দেখলেন। বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে বড়ই খেতে হবে। গাছে উঠতে গিয়ে দেখলেন কাঁটা আর কাঁটা। কী করা যায় কী করা যায় ভাবছেন। একদিন দুইদিন তিনদিন পর, ক্ষুধায় যখন প্রাণটি খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম, তখন হঠাৎ দেখলেন আপনার অদূরে পড়ে আছে একটি পাথরের নুড়ি। বিদ্যুতের মতো আপনার মাথায় খেলে গেলো, আরে, এটি দিয়ে তো বড়ই গাছে ঢিল ছোঁড়া যাবে! 
এই যে আপনি বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেড়ে খাওয়ার একটি মামুলি কৌশল আবিষ্কার করলেন, এটিই বিজ্ঞান। বিজ্ঞান মানে শুধু তা নয়, যা ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা পারমাণবিক বোমা বানানো যায়।  

ধর্ম পালন করতে বিজ্ঞানের সাথে কলহে লিপ্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করেও ধর্ম পালন করেছেন। সম্ভবত তারা কবিরাজ নন বলেই পেরেছেন।  

কিন্তু কবিরাজদের জন্য এটি কঠিন। কবিরাজদের প্রধান কাজ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। প্যারাসিটামল নয়, জ্বরে একটি ফুঁ অধিক কার্যকরী, এটি কাউকে না বুঝানো গেলে সে কবিরাজের কাছে যাবে না। এজন্য কবিরাজেরা, নানা প্রলাপ বকে, ‘বানর থেকে মানুষ এসেছে’ এ রটনায় বিশ্বাসীদের কাছ থেকে বাহ্বা কুড়াচ্ছে, এবং নিজেদের বামন মূর্তিটিকে পূজনীয় রাখতে, মানুষকে নানা কৌশলে বিভ্রান্ত করছে।

তারা জানে যে, বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করা বেশ পরিশ্রমের কাজ, এবং এ কাজে দরকার পড়ে পড়াশোনোর। এজন্য তারা, নিজেদের হীনমন্যতাকে ঢাকতে গামছা ছুঁড়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের গায়ে। মুশকিল হলো, এ গামছা একটু ফুঁ দিলেই উড়ে যাচ্ছে।  
এ কবিরাজদের বলতে চাই, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা গ্রন্থটি শুরু হয়েছে এডমুন্ড হ্যালির একটি কবিতা দিয়ে। হ্যালি, নিউটনের এ অসামান্য কাজের প্রশংসা করে কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতাটির শিরোনাম— “Ode on This Splendid Ornament of Our Time and Our Nation, the Mathematico-Physical Treatise by the Eminent Isaac Newton”। আমার কাছে প্রিন্সিপিয়ার যে-সংস্করণটি আছে, তার ২৫ পৃষ্ঠায় কবিতাটি আছে। আমি ছবি দিয়ে দিলাম। কোনো কবিরাজের পক্ষে নিউটনের প্রশংসা করা সম্ভব নয়।  

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

মহিউদ্দিন মোহাম্মদ 

news24bd.tv/আলী