মানুষের কতো বিপদ, আসুন পাশে দাঁড়াই

মানুষের কতো বিপদ, আসুন পাশে দাঁড়াই

Other

‘কতোটা সংকটে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হিসেবেই জানে। কিন্তু করোনা মহামারিতে আমরা প্রায় শেষ। ঢাকায় মেসে থেকে লেখাপড়া করতাম।

মেস ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। পরিবারের অবস্থাও খুব খারাপ। বৃদ্ধ বাবা আমাদের নিয়ে আর সংসার চালাতে পারছে না। অনার্স শেষ হয়নি।
আমি নিজেও কিছু করতে পারছি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। কারও কাছে সাহায্য চাইতে সম্মানে বাঁধে। আপনাকে ভিন্ন নামে মেসেজ দিচ্ছি। ’

আমার ইনবক্সে এসেছে মেসেজটা। করোনার এই মহামারিকালে গত এক বছরে আমি এমন কতো মেসেজ যে পেয়েছি! বিশেষ করে লকডাউনে। আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। ভীষণ কান্না পায়। আমি সব বাদ দিয়ে আমার সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী যার জন্য যতোটুকু পারি করার চেষ্টা করি। কিন্তু বহুক্ষণ আমার ভীষণ মন খারাপ থাকে। কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারি না।

আমাকে যারা কাছ থেকে চেনেন তারা জানে বিলাসিতা আমার জীবনে নেই বললেই চলে। আমি নিজের জন্য সব ধরনের অতিরিক্ত খরচ পরিহার করি। মাঝে মধ্যে বই কেনা ছাড়া আমার নিজের জন্য আমি কখনো খরচ করি না। নিজের খুব বেশি শখ-আল্লাদ আমার নেই। অপচয় তো পরের কথা, সামান্য দাম দিয়ে কিছু কিনতে গেলেই আমার খারাপ লাগে। তার মানে না এই নয় যে আমার টাকা নেই। বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আমি অনেকের চেয়ে ভালো আছি। আমার যে আয় তা দিয়ে মোটামুটি একটা ভালো জীবন যাপন করা যায়। কিন্তু আমার নিজের জন্য টাকা খরচ করতে ভীষণ যন্ত্রণা লাগে। আমার বারবার মনে হয়, চারপাশে কতো লোকের কতো সংকট! তখন মনে হয় নিজের জন্য না খরচ করে যা আছে সব তাদের দিয়ে দেই!

জানি না আপনাদের এমন হয় কী না! না আমার বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, সম্পদ নেই তারপরেও দেখেন শুক্রবার আমি যখন বাজার করি আমার সেদিনও খারাপ লাগে। না আমি বিরাট ধনীর মতো বাজার করি না। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের যতোটুকু লাগে ততোটাই। কিন্তু মাছ-মাংস কিনতে গেলেই আমার মন খচখচ করে।

আমার মনে হয়, আমি সৌভাগ্যবান যে জীবনে কখনো খাওয়ার কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু কতো লোক তো দুবেলা সামান্য খেতে পারছে না। জানি না আপনাদের এমন হয় কী না! আমার চারবছরের ছেলেটা যখন খেতে চায় না কিংবা ঠিকমতো খায়, দুই সময়েই আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে কতো শিশু আছে যাদের খাবার নেই। অমার মনে হয়, এই করোনায় কতো মানুষের কতো ধরনের বিপদ!

এই যে গতকাল নাম পরিচয়হীন ছেলেটার মেসেজ আসার পর থেকে ভীষণ খারাপ লাগছে। না এটাই প্রথম নয়। এই ধরনের মেসেজ আমি প্রায়ই পাই। কিন্তু এই যে একটা মানুষ নিজের পরিচয় দিয়ে সাহায্য চাইতে পারছে না সেটাও তো একটা যন্ত্রণা!

একবার ভাবেন! এই দেশে একটা শিক্ষিত ছেলে রিকশা চালাতে গেলে বা কায়িক পরিশ্রম করতে গেলে তাকে দশবার ভাবতে হয়! ওই যে হুমায়ুন আহমেদের নাটকে একটা লাইন ছিল, মামা রিকশা চালালে তো লোকে দেখবে, চলেন চুরি করি। কেউ দেখবে না। কিন্তু তারপরেও তো অনেক লোকে রিকশা চালায়। এর মধ্যে কতোজন আছে হয়তো বাধ্য হয়ে চালায়। মাঝে মধ্যে যখন দেখি রিকশা উল্টানো ভীষণ খারাপ লাগে। জীবনের তাগিদে কতো মানুষকে কতো কষ্ট করতে হয়!

এসব ভাবলে আজকাল আমার ভীষণ অসহায় লাগে! ওপরওয়ালা জানেন, সারাজীবন আল্লাহর কাছে চেয়েছি, হে আল্লাহ! আমাকে সম্পদশালী বানানোর দরকার নেই কিন্তু আমাকে সেই পরিমান টাকা দাও যেন যেন আরেকজন মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারি। আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেননি। দুই-চারজন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামর্থ্য দিয়েছেন। কিন্তু করোনার এই মহামারি, লকডাউনে তো চারপাশে হাজার হাজার মানুষের সংকট! আমি তাদের কয়জনের পাশে দাঁড়াতে পারছি! আমার তো যন্ত্রণা লাগে।

হ্যা, অনেকেই আমাকে বলেন, মানুষ বিপদে পড়েছে এমন কোন ঘটনা জানলে যেন তাদের বলি। তারাও সাহায্য করবেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমি চেষ্টা করি একা সামলানোর। আমার মনে হয় যেই মানুষটা আমাকে বলেছে সে হয়তো চায় না অন্য কেউ ঘটনা জানুক। আমার তখন বারবার মনে হয়, আমার যদি কয়েকশ কোটি টাকা থাকতো! আমি সারাক্ষণ মানুষের কথা শুনবো, আর যার বিপদ তার পাশে দাঁড়াবো! আমি সেটা পারি না। আমার তাই অসহায় লাগে!


আরও পড়ুনঃ


বাঙ্গি: বিনা দোষে রোষের শিকার যে ফল

আপনি কী করেন? এটি মোটেও নিরীহ প্রশ্ন নয়

সড়ক দুর্ঘটনায় রাস্তাটি গুরুতরভাবে আহত হয়েছে: নোবেল

লকডাউনে 'বান্ধবীর' সাথে দেখা করতে যুবকের আকুতি, পুলিশের রোমান্টিক জবাব!


আমি বিশ্বাস করি আমার মতো আরও অনেক মানুষ নিশ্চয়ই আছেন যাদের একইভাবে অসহায় লাগে, যারা মানুষের জন্য কষ্ট পান। আমরা সবাই মিলে কী সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারি না? এমন অনেক মানুষ নিশ্চয়ই আছেন যাদের আসলেই বিপুল সম্পদ আছে। অনেকের হয়তো বিপুল না হলেও নিজের বাড়ি গাড়ি আছে। অনেকেই হয়তো, আছেন ঈদে পাবর্ণে বা যে কোন সময় দামী দামী জিনিষ কেনেন। নানা শখ মেটান।

আমি বলছি না শখ মেটাবেন না। একটু ভালো জীবন যাপন করবেন না। অবশ্যই করবেন। কিন্তু তারপরেও আমরা সবাই যদি যার যায় জায়গা থেকে একটু ছাড় দেই, সবাই মিলে যদি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, নিশ্চয়ই অনেক মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব!

আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীতে সম্পদের অভাব নেই। আমি বিশ্বাস করি এই বাংলাদেশেও যে সম্পদ আছে তাতে সবাইকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। পৃথিবীর যে সম্পদ আছে তাতে গোটা পৃথিবীর মানুষকে আজীবন ভালো রাখা যায়। দরকার শুধু মানবিকতা। পরষ্পরের পাশে দাঁড়ানো। দরকার খোঁজ রাখা কে কেমন আছে! আমাদের আত্মীয়-স্বজন-পাড়া প্রতিবেশী-দেশের মানুষ সবার খোঁজ রাখা।

ওই যে ছোটবেলায় পড়েছিলাম, কারো প্রতিবেশি যদি পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাত যাপন করে, কেউ যদি কোনো পথশিশুকে ক্ষুধার তড়নায় কাতরাতে দেখে, আর সে যদি ক্ষুধার্ত প্রতিবেশি কিংবা ক্ষুধার্ত পথশিশুর পাশে এসে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই।

দেখেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধর্মে মানুষকে, মানবতাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি আমরা সবাই সবার পাশে থাকতে পারি। যে বলতে পারছে তার যেমন খোঁজ নিতে পারি যে বলতে পারছে না তারও খোঁজ নিতে পারি। আমরা যদি মন থেকে চাই, আরেকজন মানুষের কষ্ট যদি আমাদের স্পর্শ করে, সবাই মিলে একসাথে নিশ্চয়ই বাঁচতে পারি। আল্লাহ আমাদের রহম করুন।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv / নকিব