সাবধান! যেকোন যাদুটোনা হারাম

সাবধান! যেকোন যাদুটোনা হারাম

Other

[কোরআনটাইম] সূরা ফালাক্ব
সূরা ফালাক্ব। অন্ধকার (মিথ্যা, অন্যায়) ভেদ করে আলো (সত্য) প্রকাশের সূরা। এই সূরায় রাতের অন্ধকারের কথা এসেছে, যা সাধারনভাবে শয়তান বা খারাপ কিছুর পরিচায়ক। এরপর যাদুর কথা এসেছে, যা একটি কালো বস্তু (সম্পূর্ন হারাম কাজ)।

শিরক একটি অন্ধকার পর্যায়। হিংসা; চরিত্রের একটি অন্ধকার দিক। সুতরাং এইসব অন্ধকারকে ভেদ করে আলোর প্রকাশকারী আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে এই সূরায়।  
মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সত্তা যেমন জিন, দেবী ও দেবতাদের কাছে এ ধরনের আশ্রয় চাইতো এবং আজো চায়৷ বস্তুবাদীরা এ জন্য বস্তুগত উপায় ও উপকরণের দিকে মূখ ফিরায়৷ কারণ, তারা কোন অতি প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাসী নয় ৷ কিন্তু মু'মিনরা যেসব আপদ বিপদ ও বালা মুসিবতের মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিজেকে অক্ষম মনে করে, সেগুলোর ব্যাপারে তারা একমাত্র মহান আল্লাহর দিকেই মুখ ফিরায়।
এবং একমাত্র আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে৷ 

আসুন সূরাটি অর্থ সহ পড়ে নেই-
১) قُلْ أَعُوذُ بِرَ‌بِّ الْفَلَقِ
“কুল্ আ‘ঊযু বিরব্বিল্ ফালাক্বি”
‘বলুন, আশ্রয় চাচ্ছি আমি প্রভাতের রবের। ’   
১ম শব্দ ‘ক্বুল’ এর তাৎপর্য অনেক। আল্লাহ এখানে ‘ক্বুল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কারন আল্লাহ চান মানুষ তাঁর দূর্বলতাকে মুখে প্রকাশ করুক। মুখে প্রকাশ করা বা বলার মাধ্যমে অহংকার দূর হয়। আমার কোন সাহায্য, আশ্রয়ের দরকার নাই এমন চিন্তা দূরীভুত হয়। মুখে বলে আশ্রয় চাওয়ার কারনে রবকে মান্য করার বিষয়টি চলে আসে।  

‘ফালাক’ শব্দটি কোন কিছু ভেদ করে নতুন কিছুর আত্মপ্রকাশ বুঝায়। যেকোন সৃষ্টির জন্যই এটি সত্য। বীজ মাটি ভেদ করে গাছ হিসাবে বের হয়। ঝরনা পাহাড় ভেদ করে। বৃষ্টি মেঘ ভেদ করে। মানুষসহ বিভিন্ন প্রানী গর্ভ ভেদ করে আবির্ভুত হয়। অস্তিত্ব জগতের প্রতিটি জিনিস কোন না কোনভাবে আবরণ ভেদ করার ফলে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করে৷ এমনকি পৃথিবী ও সমগ্র আকাশ মণ্ডলও প্রথমে একটি স্তূপ ছিল৷ তারপর তাকে বিদীর্ণ করে পৃথক পৃথক অস্তিত্ব দান করা হয়েছে৷ যেমন, “এ আকাশ ও পৃথিবী সবকিছুই স্তূপীকৃত ছিল, পরে আমি এদেরকে আলাদা আলাদা করে দিয়েছি৷” ( আল আম্বিয়া ,৩০) 

" রাব্বুল ফালাক " এর অর্থ যদি প্রভাতের রব ধরা হয়, তাহলে তাঁর আশ্রয় চাওয়ার মানে হবে, যে রব অন্ধকারের আরবণ ভেদ করে প্রভাতের আলো বের করে আনেন আমি তাঁর আশ্রয় নিচ্ছি৷ আর যদি এর অর্থ সৃষ্টিজগতের রব ধরা হয়, তাহলে এর মানে হবে, আমি সমগ্র সৃষ্টির মালিকের আশ্রয় নিচ্ছি৷ তিনি নিজের সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আমাকে বাঁচাবেন৷

২) مِن شَرِّ‌ مَا خَلَقَ
“মিন্ শার রি মা-খলাক্ব”
‘তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে। ’
অন্য কথায়, সমগ্র সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আমি তাঁর আশ্রয় চাচ্ছি৷ এ বাক্যে অনিষ্টকারিতা সৃষ্টির ব্যাপারটিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি৷ বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ যেসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন, তাদের অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি৷ এ থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ কোন সৃষ্টিকে অনিষ্টকারিতার জন্য সৃষ্টি করেননি৷ বরং তাঁর প্রত্যেকটি কাজ কল্যাণকর এবং কোন না কোন কল্যাণমূলক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যই হয়ে থাকে৷ তবে সৃষ্টির মধ্যে তিনি যেসব গুণ সমাহিত করে রেখেছেন। যেগুলো তাদের সৃস্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন। সেগুলো থেকে অনেক সময় এবং অনেক ধরনের সৃষ্টি প্রায়ই অনিষ্টকারিতার প্রকাশ ঘটে৷

৩) وَمِن شَرِّ‌ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
“অমিন্ শাররি গ-সিক্বিন্ ইযা-অক্বাব্”
‘অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়। ’
রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারতা থেকে বিশেষ করে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, অধিকাংশ অপরাধ ও জুলুম রাতের অন্ধকারেই সংঘটিত হয়৷  আর এ আয়াতগুলো নাযিল হবার সময় আরবে রাজনৈতিক অরাজকতা যে অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল তাতে রাতের চিত্র তো ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ৷ রাতের অন্ধকারে চাঁদর মুড়ি দিয়ে লুটেরা ও আক্রমণকারীরা বের হতো ৷ তারা জনবসতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো, লুটতরাজ ও খুনাখুনি করার জন্য। যারা রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রাণ নাশের চেষ্টা করছিল, তারাও রাতের আঁধারেই উনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা তৈরি করেছিল৷ তাই রাতের বেলা যেসব অনিষ্টকারিতা ও বিপদ আপদ নাযিল হয় সেগুলো থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে৷ 

৪) وَمِن شَرِّ‌ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
“অমিন্ শাররি ন্নাফ্ফা-ছা-তি ফিল্ ‘উক্বদ্”
 ‘গিরায় ফুঁৎকারদানকারীদের (বা কারিনীদের) অনিষ্টকারিতা থেকে৷’
মুফাসসিরের মতে, গিরায় ফুঁক দেয়া শব্দটি যাদুর জন্য রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়৷ কারণ যাদুকর সাধারণত কোন সূতায় বা ডোরে গিরা দিতে এবং তাতে ফুঁক দিতে থাকে৷ কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমি পুরুষ যাদুকর বা মহিলা যাদুকরদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য প্রভাতের রবের আশ্রয় চাচ্ছি৷ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওপর যখন যাদু করা হয়েছিল, তখন জিব্রীল (আঃ) এসে উনাকে সূরা আল ফালাক ও আন নাস পড়তে বলেছিলেন৷ 


যাদুর ব্যাপারে অবশ্যই একথা জেনে রাখতে হবে যে, যাদুর মধ্যে অন্য লোকের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলার জন্য শয়তানের সাহায্য চাওয়া হয়৷ এ জন্য কুরআনে একে কুফরী বলা হয়েছে৷ যেমন, "সুলাইমান কুফরী করেনি৷ বরং শয়তানরা কুফরী করেছিল৷ তারা লোকদেরকে যাদু শেখাতো৷" ( আল বাকারা , ১০২ ) 

সাবধান!! যেকোন যাদুটোনা হারাম। এমনকি এগুলোর মধ্যে কোন কুফরী কালাম বা শিরকী কাজ না থাকলেও হারাম। তা সর্বাবস্থায় ও সর্বসম্মতিক্রমে সম্পুর্ন হারাম৷ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যাদুটোনাকে এমন সাতটি কবীরা গোনাহের অন্তরভুক্ত করেছেন, যা মানুষের আখেরাত সম্পূর্ন বরবাদ করে দেয়৷  আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন।

৫) وَمِن شَرِّ‌ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
“অমিন্ শাররি হা-সিদিন্ ইযা-হাসাদ্”
‘এবং হিংসুকের অনিষ্টকারিতা থেকে, যখন সে হিংসা করে৷’
হিংসার মানে হচেছ-— কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ, শ্রেষ্ঠত্ব বা গুণাবলী দান করেছে তা দেখে অপর ব্যক্তি নিজের মধ্যে জ্বালা অনুভব করে। এবং তার থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো তাকে দেয়া হোক। অথবা কমপক্ষে তার থেকে সেগুলো অবশ্যই ছিনিয়ে নেয়া হোক। এইসব আশা করতে থাকে৷  তবে কোন ব্যক্তি যদি আশা করে, অন্যের প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছে তার প্রতিও তাই করা হোক, তাহলে এটাকে হিংসার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না৷ 

এখানে হিংসুক যখন হিংসা করে অর্থাৎ তার মনের আগুন নিভানোর জন্য নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কোন পদক্ষেপ নেয়, সেই অবস্থায় তার অনিষ্টকারিতা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে৷ 

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কোন রোগে আক্রান্ত হলে সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে হাতে ফুঁক দিয়ে সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিতেন। ইন্তেকালের পূর্বে যখন উনার রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, তখন আমি এই সূরাদ্বয় পাঠ করে উনার হাতে ফুঁক দিতাম। অতঃপর তিনি নিজে তা সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিতেন। আমার হাত উনার পবিত্ৰ হাতের বিকল্প হতে পারতনা। তাই আমি এরূপ করতাম। ’ [বুখারী: ৫০১৬, মুসলিম: ২১৯২] 
সারকথা এই যে, যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম সূরা ফালাক ও সূরা নাস এই সূরাদ্বয়ের আমল করতেন।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

news24bd.tv/আলী