বিস্মিত হলাম যখন শুনলাম শপিং মলে যেতে মুভমেন্ট পাস লাগবে!

বিস্মিত হলাম যখন শুনলাম শপিং মলে যেতে মুভমেন্ট পাস লাগবে!

Other

কাল ২৫ এপ্রিল থেকে শপিংমল ও দোকানপাট খুলবে বলে ইতোমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। ওদিকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের প্রজ্ঞাপনও বহাল। আচ্ছা এই দুটো প্রজ্ঞাপন একসাথে কীভাবে থাকতে পারে? শপিং মল খুলতে হলে তো কঠের লকডাউনের প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে তাই না? আমার বিস্ময় আরও বাড়লো যখন শুনলাম, শপিং মল ও দোকানে যেতে আবার পুলিশের মুভমেন্ট পাস লাগবে! আচ্ছা মুভমেন্ট পাসে কী লিখবে লোকজন? আমি আসলে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না।  

আচ্ছা একবার ভাবেন তো! কঠোর লকডাউন, এর মধ্যে দোকান খোলা কিন্তু দোকানে বা মার্কেটে যেতে হলে মুভমেন্ট পাস লাগবে! কেউ যদি এই জট ছাড়াতে পারেন তাহলেই বুঝতে পারবেন গত এক বছরে করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে কতোটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে?

একটু পেছনে ফিরুন।

দেখেন চীনে যখন করোনা শুরু হলো আমরা ভেবেছিলাম আমাদের কিছু হবে না। এরপর মার্চে আমাদের দেশেও করোনা এলো। আমরা দেখলাম আতঙ্ক আর সমন্বয়হীনতা। তবে ওপরওয়ালার অসীম রহমত! ইতালি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে যখন রোজ লাশের সারি আমরা তূলনামূলক নিরাপদ ছিলাম।
প্রকৃতির এই অবদানকে আমরা ভেবে নিলাম আমাদের বিশাল সফলতা! আমাদের জনগনের ভয় কেটে গেল।  

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে এলো করোনার টিকা। আমি বলবো করোনা মোকাবেলায় এই টিকা প্রাপ্তিটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। এটা ছাড়া বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা বলেন কিংবা স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি,আইসিইউ তৈরি, জেলা পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা কোনটাই আমরা ঠিকমতো করতে পারলাম না! 

দেখেন, এই বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্য থেকে আমাদের প্রবাসীরা এলো। এলো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসীদের ঠিকমতো কোয়ারেন্টাইনও করানো হয়নি। বরং এই বছরের মার্চে যখন একটু একটু করে করোনা বাড়ছে তখন কিন্তু আমাদের যথাযথ প্রস্তুতিই নেই! একদিকে তখন যে যার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।  

একটু মনে করেন সময়টা। কোথায় আমরা করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি নেব, তা না দেশে তখন একদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছরের উদযাপনের অনুষ্ঠান চলছে আরকেদিকে মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের তাণ্ডব। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সময় কোথায়?

এপ্রিলের শুরুতে যখন আমাদের হুশ হলো ততোক্ষণে প্রথম সিদ্ধান্ত লকডাউন। বিদেশে ফ্লাইট বন্ধ। প্রবাসীদের দুর্ভোগ। সমস্যা সংকটে বিশেষ বিমান। নানা দুর্ভোগ। আর দেশের ভেতরে একদিকে মুভমেন্ট পাস, আরেকদিকে গাড়ি নেই। মানুষের দুর্ভোগ। লোকজন সব ঢাকা ছাড়লো। আবার এখন আসছে। লকডাউন চলাকালেই মার্কেট ও দোকান খোলার সিদ্ধান্ত। ২৮ এপ্রিলের পর যানবাহনও চলবে।   

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না লকডাউনে দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ হবে। এতে বরং সাধারণ ও নিম্নআয়েরসহ বেশিরভাগ মানুষের কষ্ট বাড়ে। এর চেয়ে বরং যে কোন মূল্যে আমরা যদি জনগনকে মাস্ক পরাতে পারতাম, দূরত্ব বজায় রেখে সবকিছু চালাতে পারতাম সেটা হতো অনেক ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের জনণনও সচেতন নয়, আমাদের যথেষ্ঠ চেষ্টাও ছিল না।   

প্রশ্ন হলো এখন কী হবে? সেই প্রশ্নে যাবার আগে একবার ভারতের দিকে তাকান। সারি সারি চিতা জ্বলছে দিনরাত। তাও লাশ পোড়ানো শেষ হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন–সংকট তীব্র। অক্সিজেনের অভাবে গতকাল দিল্লির একটি হাসপাতালেই মারা গেছেন ২৫ জন। উচ্চ আদালত সরকারকে বলেছে, যেখান থেকে পারেন অক্সিজেন আনেন। কিন্তু কোথা থেকে আসবে? 
একই ঘটনা আমাদের দেশে ঘটলে কী হবে? ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। জনগণ ও নীতি নির্ধারকদের সবাইকে বলবো, চলুন আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক হই। এই মুহুর্তে আমাদের করণীয় কী? আমি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার সাতটি ভাবনা মাথায় এলো। সেগুলো শেয়ার করছি। আপনাদের আর কোন ভাবনা থাকলে যুক্ত করতে পারেন।  

১. বিদেশ থেকে যারা আসছে তাদের প্রত্যেকের করোনা টেস্টের স্যাম্পল নিয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো উচিত। এটা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে করতে হবে। যাদের নেগেটিভ আসবে তারা বাসায় যাবে, যাদের পজেটিভ তারা আইসোলেশনে বা হাসপাতালে।  
২. ভারতে সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক হওয়ায় অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়া উচিত। সীমান্ত যদি পুরোপুরি বন্ধ রাখা সম্ভব নাও হয়, তাহলে অবশ্যই ভারত থেকে আসা ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে প্রত্যেকের স্যাম্পল নিয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে। যারা নেগেটিভ তারা বাসায় ফিরবে বাকিরা আইসোলেশনে।  
৩. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। দেখুন করোনা হুট করে চলে যাচ্ছে না। অন্তত আরও বছরকয়েক তো থাকবেই। গত ৫০ বছরেও আমরা যথাযথভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলিনি। আগামী এক বছরে আইসিউ, অক্সিজেন, হাসপাতাল এসবে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। পাশাপাশি করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত। দিনে দরকার হলে এক লাখ পরীক্ষা। এন্টিজেন পদ্ধিত এক্ষেত্রে কার্যকর। এটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হোক। আর স্বাস্থ্যখাতের কাজগুলো হচ্ছে কী না সেটি দেখতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত একটা বিশেষ দলের মাধ্যমে নজরদারি করা। পারলে একজন তরুণ সৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করা যেতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আসলেই কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।  

৪. আগেই বলেছি করোনা মোকাবেলায় সবেচয়ে বড় সাফল্য টিকা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখনো যে কারও চেযে এগিয়ে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটকে আমরা দেড় কোটি ভ্যাকসিনের টাকা দিয়েছি। কাজেই দেড় কোটি ভ্যাকসিন অন্তত আমাদের দেওয়া উচিত। এজন্য আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে ফর্মূলা অনুযায়ী যতো দ্রুত সম্ভব টিকা উৎপাদনে যেতে হবে। আমি মনে করি ১৮ বছরের উপর সব নাগরিককে কীভাবে আমরা টিকার আওতায় আনতে পারি সেদিকে নজর দেয়া উচিত। পুরো জনগোষ্ঠীকে যতো দ্রুত টিকা দিতে পারবে ততো মঙ্গল।  

৫. দেশের সব মানুষকে বসে খাওয়াতে না পারলে লকডাউন কোন সমাধান নয়। কাজেই আমি সবকিছু খুলে দেয়ার পক্ষে এবং সেটা সীমিত সময়ের জন্য নয় বরং বেশি সময়ের জন্য। ধরেন শপিং মল ও মার্কেট খুলবে। সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা এমন সময়ের মধ্যে সীমিত না রেখে আমি মনে করি ১৮ ঘন্টার জন্য কিংবা পারলে ২৪ ঘন্টার জন্য খুলে দেয়া উচিত যাতে ভীড় কমে। মনে রাখবেন যে কোন কিছু অল্প সময়ের জন্য খুললে ভীড় বাড়বে। বেশি সময়ের জন্য খুললে লোকের মাথায় থাকবে যে কোন সময়ের জন্য যেতে পারবে।   ব্যাংক-বীমা অফিস আদালতগুলো অনলাইনের মাধ্যেম প্রত্যেকের সেবার আলাদা টাইম ঠিক করতে পারে। অনলাইনের এই ব্যবস্থাপনায় আরও নজর দেয়া উচিত।  

৬. যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র বা ডাক্তার বা একক কোন গোষ্ঠীর বদলে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আরও ভালো হয় যদি কয়েকদিন ট্রায়াল করে ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যাতে আমরা একই ভুল বারবার না করি। আমার মনে হয় সব সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে না নিয়ে জেলা, উপজেলায় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, ডাক্তারসহ সবাইকে নিয়ে স্থানীয়ভাবেও অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। এই কমিটির মাধ্যমে সারা দেশে দুর্ভোগে পড়া মানুষদের তালিকা করা উচিত যারা করোনার কারণে পথে বসে গেছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
৭. যে কোন মুল্যে সবাইকে মাস্কের আওতায় আনতে হবে। এ বিষয় সবাইকে সচেতন করতে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা যদি এখনো সচেতন না হই, সবসময় মাস্ক না পরি, দূরত্ব বজায় না রাখি পরিস্থিত আরও খারাপ হবে। কাজেই মাস্ক ছাড়া কাউকে পেলে প্রতিবার হাজার টাকা জরিমানা করা উচিত। আমি মনে করি মাস্ক পরা ও দূরত্ব বজায় রাখাই এখন পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ঔষুধ।  

আমি মনে করি আমরা যদি সবাই সচেতন হই, সম্মিলিতভাবে আমরা সবাই যদি লড়তে পারি করোনার বিরুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারবো। নয়তো স্বজনদের লাশ গুনতে গুনতে ওপরওয়ালার ওপর দিকে তাকিয়ে ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। ভারতের দিকে একবার তাকান। দ্রুত প্রস্তুতি নিন। আল্লাহ আমাদের রহম করুন। সবাই ভালো থাকুন। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী