লোকে পাগল বলে বলুক তবুও হাসুন, হাসিটাই আপনাকে সুস্থ রাখবে

লোকে পাগল বলে বলুক তবুও হাসুন, হাসিটাই আপনাকে সুস্থ রাখবে

Other

তিনজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। কেউ তাদের নাম জানে না। তাদের পরিচয়ও জানে না। কারণ তারা কখনো কথা বলেনি।

তারা কখনো কোন উপদেশ দেয়নি, পরামর্শ, আদেশ, বাণী কিচ্ছু দেইনি। তারা তিনজন একসাথে ঘুরতো আর একটি কাজই করতো। একে কাজ বলা যায় কি না, সেটাও অনেকের জানা ছিলো না। এই তিন বৌদ্ধ ভিক্ষু গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতো আর হাসতো।
এই তিনজনকে সবাই ‘হাসিমুখো তিন সাধু’ হিসাবেই চিনতো।

গ্রামের বাজার কিংবা কোন ভিড় এলাকায় তারা যেতো। তারপর হাসা শুরু করতো। কোন কারণ ছাড়াই। এমনভাবে হাসতো মনে হতো কি যেন মজার কিছু ঘটে গেছে। ক্রমে লোকজন জড়ো হতো। নানা প্রশ্ন, দ্বিধা, কৌতুহল তৈরি হতো মানুষের মনে। কিন্তু তিন ভিক্ষু কোন কথা বলতো না, তারা কেবল হেসেই যেতো। কে না জানে, হাসি সংক্রমক। ক্রমশ তাদের হাসি সংক্রামিত হতো। একে একে সবাই সেই হাসিতে যোগ দিতো। যখন গ্রামের লোকজন হেসে উঠতো তখন এই তিন ভিক্ষু চলে যেতো, অন্য কোন গ্রামে। আবার সেখানে বইয়ে দিতো হাসির হুল্লুড়। এভাবেই চলছিলো বেশ।

তারপর এক ভিক্ষু সাধক মারা গেলেন। বাকী দুইজন আরেক গ্রামে এলো। এতো দিনে চীনের লোকেরা এই তিন ভিক্ষুর কথা জেনে গেছে, তারা লোকমুখেই বিখ্যাত হয়ে গেছে। এইবার যখন গ্রামে দুই ভিক্ষু এলেন গ্রামের লোক তখন স্তব্ধ, শংকিত, কৌতুহলী তো বটেই। তারা দুই ভিক্ষুর কাছাকাছি এলো। তাদের ধারণা ছিলো বন্ধু, সঙ্গী হারানোর ব্যথায় তারা কাতর থাকবে। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখলো, দুই ভিক্ষু খুব হাসছেন, ঠিক তিনজন যেভাবে হাসতেন সেইভাবেই।

বিস্মিত লোকেরা এইবার সহজে হাসিতে যোগ দিতে পারলো না। গ্রামের প্রায় সব লোক এগিয়ে এলো, তারা জিজ্ঞেস করলো, আপনারা হাসছেন কেন? আপনাদের তো মন খারাপ থাকার কথা।  

এই একবার, এই প্রথমবার তারা কথা বললেন। দুই সাধুর একজন বললেন, ‘আমরা হাসছি কারণ মানুষটা জিতে গেছে। আমরা সব সময়ই ভাবতাম আমাদের মধ্যে প্রথম কে মারা যাবে। কে প্রথম হবে মৃত্যুর যাত্রী। তো ও জিতে গেলো, আমাদের হারিয়ে দিয়ে গেলো। আমরা হাসছি আমাদের পরাজয় আর বিজয় দেখে। ’

news24bd.tv‘আমরা আরো হাসছি কারণ আমরা বহুকাল একসাথে এসেছি, আমরা একত্রে উপভোগ করেছি এই পৃথিবী, আমরা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করেছি। তাকে বিদায় উপহার হিসাবে হাসির চেয়ে ভালো কিছু আমাদের কাছে নেই। আর আমরা কেবল হাসতেই শিখেছি। ’ কিন্তু এই কথাতেও গ্রামের লোকের মন ভরলো না। তারা তখনও বিষন্ন।

তিন সন্নাসীর একজনের অভাব বোধে তারা ব্যথিত। তো সেই সন্নাসীর দেহ রাখা হলো শেষকৃত্যের জন্য। মৃত ভিক্ষু সন্নাসী আগেই জানিয়ে গিয়েছিলেন, তার পোশাক যেন বদলানো না হয়। কারণ তিনি সদাই পরিস্কার পোশাক পরতেন। এটা অনেকের মতো চীনা রীতিও যে মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া হয় আর নতুন কাপড় দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মানা করে গিয়েছিলেন গোসল দিতে, নতুন পোশাক পরাতে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনো অপরিচ্ছন্ন থাকিনি, নোংরা থাকিনি। আমার জীবনে এতো এতো হাসি ছিলো যে আমার মধ্যে কোন অশুদ্ধতাই নেই। আমি কোন ধূলা ময়লা লাগতে দেইনি এই গায়ে। হাসি সদাই তাজা আর সুন্দর। তাই আমার পোশাক বদলাবেন না, আমাকে গোসল দেবেন না। ’ লোকে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী যেভাবে সে ছিলো সেভাবেই তাকে পোড়াতে নিলো। আর যখন তার শরীরে আগুন ধরানো হলো, তখনই সবাই বিস্মিত হলো। কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষু তার কাপড়ের, শরীরের নানা জায়গায় আতশবাজি রেখে দিয়েছিলো। আগুনের আঁচ পেয়ে সেইসব আতশবাজি আকাশে ওঠে ফুটতে লাগলো। আকাশ যেন আলোর ফুলকিতে হাসতে শুরু করলো। এক ভিক্ষু বললেন, ‘দেখো ও আমাদেরকে আবারও পরাজিত করেছে, শেষ যাত্রাতেও সে আমাদের হাসি দিয়ে গেলো। ’ গ্রামবাসী বুঝতে পারলো এই যে দুই সন্নাসী হাসছে তার সঙ্গে তাদের মৃত বন্ধুটিও হাসছে। আর সবাই হাসতে শুরু করলো।

যারা বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জানেন, তারা এটুকু জানেন যে, বুদ্ধ কোন একক ব্যক্তি নয়। সাধনার চূড়ান্তে পৌঁছালে বুদ্ধ হওয়া যায়। আর এই যে গল্পে তিন বুদ্ধ ভিক্ষু তারা ছিলেন বুদ্ধের হাসির তিন রূপ। হাসিরও তিনটি ধরণ আছে। সেটা সম্পর্কে একটু বলে নেই।

প্রথম হাসি হলো, অন্যের উপর হাসা, যেটা আমরা সব সময় করি। অন্যকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, ইয়ার্কি-ফাজলামো। এটাকে বলা হয় সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীর হাসি।

দ্বিতীয় হাসি হলো নিজের উপর হাসতে পারা। যখন কেউ নিজেই নিজেকে হাসির পাত্র মনে করে তখন সেই হাসি জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় চালিত হয়। আত্ম অহংকার, নৃশংসতা, লোভ, ঘৃণা ইত্যাদির উর্দ্ধে উঠতে পারলেই নিজেকে নিয়েই হাসা যায়। যে মানুষ নিজের উপর হাসতে পারে সে মানুষ ক্ষুদ্র কামনা-বাসনার উর্দ্ধে উঠতে পারে।

আর তৃতীয় হাসি নিজের উপরও নয়, অন্যের উপরেও নয়। এ হাসিকে বলে মহাজাগতিক হাসি। বলা হয়ে থাকে একমাত্র বুদ্ধই এই হাসি হাসতে পারে। কারণ এই হাসি হাসতে হলে মহা জগতের লীলাখেলা বুঝতে হয়। এই জগতের শুরু কোথায়, এই জগত কোথায় শেষ, মানব জন্ম কীভাবে শুরু হয়, কখন কীভাবে শেষ হয়-- এর কিছুই আমরা জানি না। অজানা অচেনা এক রহস্যময় পৃথিবীতে অনিশ্চিত একটা জীবন পার করি আমরা। এই অসীম রহস্য, অনিশ্চয়তা, অনিত্যতা যে অনুধাবন করতে পারে সে হাসতে পারে যে কোন পরিস্থিতিতে, যে কোন সময়। এই বিশাল মহাজগতের রূপ, লীলা বড়ই আনন্দময়, এর অংশ হতে পারাও বড় আনন্দের। সেই যে আমাদের রবীন্দ্রনাথের গানে আছে--

আকাশভরা সূর্য-তারা,
বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি
পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥
অসীম কালের যে হিল্লোলে
জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায়
লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি
বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে
উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি,
ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥

আরও পড়ুন


ছোট বয়সের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রেম করছেন আনুশকা

শ্রীলেখার ফোন নম্বর ফাঁস, নেটাগরিকদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য

ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণের শিকার সেই তরুণী ফেসবুক লাইভে এসে যা বললেন (ভিডিও)

খুলনায় ভিমরুলের চাকে আগুন দিতে গিয়ে পান বরজ পুড়ে ছাই (ভিডিও)


সত্যি বলছি, আমার নিজের কাছে এ গান প্রার্থনার মতো, ওষুধের মতো, কখনোবা আদরের মতো। আমি ফুলের গন্ধ, ঘাসে ঘাসে পা ফেলার আনন্দ, কান পেতে পাখির গান শোনা, চোখ মেলে ফুলের রূপ দেখার মধ্যেই জগতের সব আনন্দ পাই। আনন্দে কখন নিজের অজান্তেই আমার হাসি আসে। কখনো মুচকি হাসে, আশেপাশে কেউ না থাকলে অট্টহাসি। কিন্তু হাসি আমি দেই। নানা অজুহাতেই। কারণ, আমার বিবেচনায়, মানুষ এবং সত্যিকারের মানুষই পারে হাসতে। জীব-জন্তুর মধ্যে সে অর্থে হাসি নেই। তারা তো ফুলের রূপে, জোছনা আর সমুদ্রের ঊর্মিমালায় আনন্দ খুঁজে পায় না। তারা তো কৌতুক করতে জানে না। কিন্তু হয়তো জানে। কখনো কোন কুকুরের কা-কারখানা দেখেও খুব রসিক মনে হয় তাদের। গরুর চাহনির মধ্যেও হাসি থাকতে পারে। একটা বিড়াল যে মগ্নতায় নিজের পরিচর্যা করে সেই মগ্নতা দেখার আনন্দও আছে। একটা ব্যঙের লাফের মধ্যেও হাসি আছে। বার্টান্ড রাসেল একবার একদল আদিবাসীর সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন তারা কতো ছোট্ট ছোট্ট বিষয়ে খুশি। তাদের কাপড় নেই, পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর অথচর তারা সুখি, তারা হাসতে জানে। অথচ জগতের সকল আরাম আয়েশ নিয়েও আমরা কতো বিরক্ত, উদাস, বিষণ্ণ। বাড়িতে খাবার আছে, আলমারিতে কাপড় আছে, কারো কারো একাধিক গাড়ি বাড়ি আছে, কিন্তু মনে সুখ নেই, মুখে হাসি নেই।

একটা গাছ কি বিষণ্ণ হয়, একটা পাখি কি টাকা জমায়, একটা বাঘের কি মনোচিকিৎসক আছে? প্রকৃতিও চিকিৎসা আর এই মহাজগতই আনন্দ। এইটুকু বুঝতে গেলে আমরা হাসতে পারবো সেই তিন সাধকের মতো। আসুন হাসির সাধনা করি।

যারা করোনা নিয়ে আতঙ্কে আছেন, তাদের জানিয়ে রাখি দুঃশ্চিন্তা, আতঙ্ক শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দূর্বল করে। সবল ইমিউন সিস্টেমের জন্য হাসিটা খুব দরকারী। হাসি ফুসফুস আর হৃদয়ের জন্যও উপকারী। আমি নিজে যখন করোনাক্রান্ত ছিলাম ক্রমাগত কপিল শর্মা শো দেখতাম, খুঁজে খুঁজে হাসির সিনেমাগুলো দেখতাম। আইসোলেশনে, নিজের ঘরে বসে একা একাই হাসতাম। যে পাগল বলে বলুক, হাসিটা চলুক, যে কোন পরিস্থিতিতেই, যে কোন সময়েই।

লেখাটা শেষ করছি ওশো’র একটা উদ্ধৃতি দিয়ে, ‘কেবল জীবনকে আরো আমোদের চোখে দেখো। একদম রাশভারী হয়ো না। গুরুগম্ভীর হওয়াটা অনেকটা অন্ধত্বের মতো। ভাবুক, দার্শনিক সাজার চেষ্টা করো না। কেবল একজন মানুষ হয়ে ওঠো। এই পুরো বিশ্ব নানাভাবেই তোমাকে কতো আমোদ-প্রমোদ দেখাচ্ছে, কিন্তু তুমি এতো বেশি রাশভারী যে নিজের হৃদয়ই খুলতে পারো না।

news24bd.tv আহমেদ

সম্পর্কিত খবর