নেক্রোফিলিয়া বা শবকাম: এক বিকৃত যৌনাচার

নেক্রোফিলিয়া বা শবকাম: এক বিকৃত যৌনাচার

Other

একজন ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা বা ব্যাধির কারণে অনেক সময় তার আশেপাশের মানুষজনও হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু ধরণের মানসিক ব্যাধির কারণে অন্য কোনো ব্যক্তি এমনভাবে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা আইনিভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এমন একটি মানসিক ব্যাধির নাম হলো নেক্রোফিলিয়া। বিকৃত শবকামীদের কাছে জীবিত নারী বা নারীদেহের চেয়ে তার মরদেহই বেশি আকর্ষণীয়।

নেক্রোফিলিয়া এক ধরনের প্যারাফিলিয়া বা বিকৃত যৌনাচার। মৃতদেহের প্রতি এক ধরনের বিকৃত ও অসুস্থ যৌন আকর্ষণ বা আকাঙ্ক্ষা থেকে বাস্তবে লাশ বা শবের সঙ্গে সহবাস। যারা নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত তাদের বলা হয় নেক্রোফিলিক,  শবাশক্ত বা শবকামী। নেক্রোফিলিকরা মৃতদেহের সাথে যৌনকার্যে লিপ্ত হয় বা লিপ্ত হওয়ার লিপ্সা পোষণ করে।

এই কাজটা সাধারণত করে থাকে পুরুষেরা আর এই বিকৃত বর্বরতার শিকার হয় মৃত কোনো নারীর দেহ।  

Necrophilia শব্দটা আসলে প্রাচীন গ্রিক শব্দ nekros ও philia -এর সমষ্টি । যার মধ্যে nekros শব্দের অর্থ Dead এবং philia শব্দের অর্থ attraction। অর্থাৎ এর ফুল অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় মৃত দেহের প্রতি আসক্তি, কাম বা আকর্ষণ। সাধারণত লাশকাটা ঘর বা মর্গে কাজ করে এমন লোকজন, ডোম, মৃতদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, কবরে বা সমাধিতে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে নেক্রোফিলিকদের বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। এর বাইরেও নেক্রোফিলিকদের অস্তিত্ব আছে, যারা প্রয়োজনে লাশ চুরি করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ১৯৮৯ সালে ১২২ জন নেক্রোফইল ব্যক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় বলা হয়, 'বাধা দেবে না বা প্রত্যাখ্যান করবে না', মূলত এমন যৌনসঙ্গী পাওয়ার বাসনা থেকে মরদেহের সাথে যৌন সংসর্গ করে থাকে নেক্রোফাইলরা। অনেক সময় তারা এমন পেশা নির্ধারণ করে, যেখানে মরদেহের আশেপাশে থাকার সুযোগ থাকে তাদের। তবে গবেষণার জরিপে পর্যালোচনা করা ১২২ জনের কয়েকজনের মরদেহের আশেপাশে থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হত্যা করার পর মৃতদেহের সাথ যৌনচার করেছিলেন বলে উঠে আসে প্রতিবেদনে।

মৃতদেহের সাথে এধরনের বর্বর যৌনতাকে নানাভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এরমধ্যে এক ধরনের নেক্রোফিলিক আছে যারা মৃতদেহের সাথে যৌনকামনা কল্পনা করে, বাস্তবে করে না। আরেক ধরনের নেক্রোফিলিক আছে যারা মৃতদেহ খুঁজে বের করে কিংবা কবর বা মর্গ থেকে মৃতদেহ চুরি করে তার সাথে যৌনকার্য করে থাকে । আরেক ধরনের আছে তারা মৃতদেহ নিজেদের কাছে রেখে দিয়ে মৃতদেহ সংরক্ষণ করে এবং বছরের পর বছর সে মৃতদেহের সাথে যৌনকর্ম করে। আরেক ধরনের আছে যারা নারীদের খুন করে মৃতদেহের সাথে নিজের বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করে। নেক্রোফিলিকরা কোন নারীর মৃতদেহ দেখে লোভে জ্বিভ থেকে লালা ফেলার মতো নিকৃষ্টও হয়ে থাকে।  

ইতিহাসের পাতায় এই বিকৃতির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রিসের অত্যাচারী রাজা পেরিঅ্যান্ডারের শবকামের কথা উঠে এসেছে ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের লেখায়। নিজস্ত্রীর মৃতদেহ লুকিয়ে মমি বানিয়ে সেই মমির সাথে বছরের পর বছর যৌনকার্য করেছেন এমন কাহিনিও আছে। এর মধ্যে রাজা হ্যারোড, রাজা ওয়াল্ডিমার এবং রাজা চার্লম্যাগের কাহিনি অন্যতম।  

মিশরের মমির সঙ্গেও জুড়ে আছে শবকামের কাহিনী। নেক্রোফিলিয়ার ভয়েই মমি তৈরির আগে সুন্দরী মহিলাদের দেহ মৃত্যুর পর দিন চারেক ফেলে রাখা হত। দেহে খানিকটা পচন ধরলে তবেই তা মমি প্রস্তুতকারকদের হাতে তুলে দেওয়া হত। এর কারণ হলো, এতে করে লাশটি বিকৃত হয়ে যেত এবং সৎকারকারীদের মধ্যে যদি কোনো নেক্রোফিলিক থেকে থাকে, সে আর তার যৌনলিপ্সা পূরণ করতে লাশের ওপর চড়াও হতে পারত না।  

২০১৩ সালে সৌদি আরবের আল এরাবিয়া নিউজ পত্রিকায় একটি আইনের বিরুদ্ধে মিশরের নারীদের বিক্ষোভের একটি খবর প্রকাশ করা হয় । আর সেই আইনটি হলো, Farewell intercourse বা বিদায়ী যৌনমিলন আইন। যেখানে বলা হয়েছে, কারো  মারা গেলে তিনি তার বউয়ের মৃতদেহের সাথে মৃত্যুর ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত শেষ বা আখেরি সহবাস করে নিতে পারবেন। আর এর আইনের বিরুদ্ধেই বিক্ষোভে নেমেছিল মিশরীয় নারীরা।

সম্প্রতি বাংলাদেশে এরকম একটি শবকামের ঘটনা ঘটেছে । গত বছর ১৯ নভেম্বর রাতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ডোম শ্রী যতন কুমারের সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে নারীদের মরদেহের সাথে 'যৌন লালসা চরিতার্থ' করতো।   সিআইডি বলেছে, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত মুন্না ভক্ত (২০) অন্তত পাঁচজন মৃত কিশোরীর লাশ ধর্ষণ করেছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে।  

পৃথিবীতে এ ধরনের অসংখ্য নেক্রোফfইল বা শবকামী আছে। এদের যতটা বিকৃত ভাবা হয় এদের চেহার কিংবা ব্যক্তিত্ব দেখে কখনোই আন্দাজ করা যায় না যে এরা নেক্রোফােইল হতে পারে। এই পাশবিক যৌনাচার যতক্ষণ কারো নজরে চলে না আসে কিংবা ফাঁস হয়ে যায় ততক্ষণ বোঝার কোনো উপার নেই। কারণ যারা একবার নেক্রোফাইল হয়ে যায় এদের আর জীবিত কোন নারীর শরীর নিয়ে কোনো আকর্ষণ থাকে না। এরা অনেক সময় জীবিত নারীদের যথেষ্ট সম্মান করে থাকে এদের যতোই বিকৃত মানসিকতার ভাবেন না কেনো এরা ব্যাক্তিগত জীবনে যথেষ্ট ব্যাক্তিত্ত্ব সম্পন্ন এবং সামাজিক হয়ে থাকে।  

কোনো নারীর মৃত্যুর পর তার চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানো এবং তার প্রেম ও যৌনতার রগরগে ও রসালো আলোচনায় মেতে উঠে সুখ পান অনেকে। এটাও এক ধরনের নেক্রোফিলিয়া। এরা মৃত নারীর বহুগামিতা ও ব্যভিচারের অশ্লীল ও নোংরা গল্প ফেঁদে নিজেদের সেই ব্যভিচারে সামিল করার কল্পনা বিলাসে ডুবে যেতে ভালোবাসেন। এতে করে হয়তো তারা নেহাত অক্ষমতার কারণে তাদের অচরিতার্থ যৌনলালসাকে রোমান্টিক সক্ষমতা দেওয়ার প্রয়াস পেয়ে থাকেন। শবকাম যে ধরনেরেই হোক তা যে পৈশাচিক বিকৃতি ও মনোবিকার তা শবকামীর বোধগম্য হয় না। তার কাছে এটা তার নির্দোষ পুলক লাভের বাগে পাওয়া মওকামাত্র।

লেখক : হারুন আল নাসিফ : কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক।

news24bd.tv/আলী