নৃগোষ্ঠী পাঙন বা মণিপুরি মুসলিমদের কথা

নৃগোষ্ঠী পাঙন বা মণিপুরি মুসলিমদের কথা

Other

মণিপুরীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের অনুসারী সম্প্রদায়টি ‘পাঙন’ বা ‘পাঙ্গান’ বা ‘পাঙ্গাল’ বা মণিপুরী মুসলিম হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার নানান স্থানে প্রায় পঁচিশ হাজার মণিপুরী মুসলিম বাস করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও পাঙনরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য আজো বজায় রেখেছে। তাদের ঘরবাড়ি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা স্বতন্ত্র এবং বৈচিত্রে ভরপুর।

কথিত আছে যে, মণিপুর রাজ্যে ভারতবর্ষের কোনো এক অঞ্চলের পাঠান মুসলিম ব্যবসা-বাণিজ্য করতে মণিপুর যান। তাঁদের একজন এক মৈতৈ মণিপুরী মেয়ের সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হন এবং তাঁকে বিবাহ করে সন্তানাদিসহ সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। মৈতৈই  মা ও পাঠান মুসলিম পিতার বংশধররাই পরে পাঙান বা মণিপুরী মুসলিম নামে পরিচিতি পায়। তারা মায়ের ভাষায় কথা বলে এবং পিতার ধর্ম পালন করে।

 

ইতিহাসবিদদের মধ্যে মণিপুরে ইসলামের সূচনা এবং পাঙ্গাল নামের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। কোনো কোনো সূত্র সূচনা সালটি ৯৩০ সালের আগে-পরে বলে মনে করেন। তবে অধিকাংশ সূত্র সালটি ১৬০৬ বলে নিশ্চিত করেন। এ সালে মুসলিম সৈন্যরা বন্দুক প্রস্তুতকারক হিসাবে বা লবণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মণিপুর প্রবেশ করেন। ঘটনাক্রমে তারা একটি চুক্তির মাধ্যমে মণিপুরে থেকে যান।

 ইতোমধ্যে বার্মার সাথে যুদ্ধ বাঁধলে মণিপুরের রাজা মৈতৈ বাহিনির পক্ষে মুসলিম সৈন্যদের সাহায্য চান। যুদ্ধে তারা বীরত্বের পরিচয় দেন। মৈতৈ বাহিনি জিতে যায়। রাজা খুশি হয়ে তাদের ‘পাঙ্গাল’ উপাধি দেন। মৈতৈ ভাষায় পাঙ্গাল মানে শক্তি বা শক্তিশালী। এই সৈন্যরা মৈতৈ সম্প্রদায়ের মেয়েদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং মৈতৈ সংস্কৃতির ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন দিকগুলো গ্রহণ করেন। কালক্রমে তাদের বংশধররা পাঙ্গাল বা পাঙন নামে পরিচিতি পায়।

পাঙনরা সুন্নী মুসলিম। তবে স্থানীয় বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠির সঙ্গে পাঙনদের সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তাদের ধর্মাচরণ, সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতির সাথে বাঙালি মুসলমানদের পার্থক্য রয়েছে। পাঙনরা প্রচণ্ড ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল। পাঙন মেয়েরা কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলে।   পাঙন সমাজ নিজেদের সম্প্রদায়ের বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক অনুমোদন দেয় না। পাঙান মেয়েরা কুর্তি, সালোয়ার ও ফানেকের মতো নিজস্ব পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে। পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো লুঙ্গি ও পায়জামা।

পাঙনদের মসজিদগুলোতে কেবল পাঙন ইমামরাই ইমামতি করেন। নানান সামজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা মাতৃভাষা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে কোরান শরিফের তর্জমা ও তাফসীর, বিভিন হাদিসের পাঠ ও ব্যাখ্যা সবকিছু মাতৃভাষায় করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিয়ের দিনে ‘কাসিদা’ নামে পরিচিত এক ধরনের লোক ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান ও নাচের অনুষ্ঠান থাকে যা পাঙনদের একান্ত নিজস্ব।

ঈদ পাঙনদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ঈদের দিনে গোত্র বংশ নির্বিশেষে সব শ্রেণীর পাঙন এক কাতারে সমবেত হয় এই বিশেষ দিনটিকে উদযাপন করার জন্য। ঈদের জামাতও নির্দিষ্ট স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, ঈদের জামাতে ইমামতির ভার থাকে যথারীতি পাঙন সম্প্রদায়েরই কোন মৌলভির ওপর। মসজিদে, দোকানে, হাটবাজারে, খেয়াঘাটে সবখানে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা চলে।  

আত্মীয় স্বজন ও পরিচিত জনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। পরিবারের সবার জন্য নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। এদিন মেয়েদের জন্য পর্দা কিছুটা শিথিল থাকে। ঈদের দিনে পাঙন মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়ে দল বেঁধে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার দৃশ্য চেয়ে দেখার মতো।

পাঙন জাতির নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের ইতিহাস মণিপুরীদের অপরাপর শাখা বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈদের থেকে আলাদা। যদিও তিনটি জনগোষ্ঠিই অষ্টাদশ শতাব্দিতে আদিভূমি মণিপুর ত্যাগ করে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে। মণিপুরে মুসলমানদের সর্বপ্রথম এবং সর্ববৃহৎ অভিভাসন ঘটে মোগল আমলে।  

পাঙনরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী জাতি। ভিক্ষাবৃত্তিকে এরা মনুষ্যজন্মের নিকৃষ্ট পেশা বলে মনে করে। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি সরঞ্জাম ও আসবাব তৈরিতে দক্ষ। পাঙন মেয়েরা কৃষিকাজে পুরুষের সমান পারদর্শী। এছাড়া তাঁতে কাপড় বোনা এবং সূঁচিকর্মে পাঙন মেয়েদের অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। মণিপুরীদের পরিধেয় ফানেক বা চাকসাবির ওপর পাঙন মেয়েদের সূঁই সুতার সুক্ষ্ম কারুকাজ দেখে বিস্মিত হতে হয়।

লেখক : হারুন আল নাসিফ  : কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক।

(ফেসবুক থেকে নেয়া)

news24bd.tv/আলী