ঠিক এই মুহুর্তটি খুব ট্রানজিশনাল

ঠিক এই মুহুর্তটি খুব ট্রানজিশনাল

Other

যদি ধরেন আজকে ঈদের চাঁদ না দেখা যায় তাহলে আগামীকাল হবে ঈদের আগের দিন আর পরশু ঈদ। আমার জীবনে ঠিক এই মুহুর্তটি খুব ট্রানজিশনাল, আমি একটা এনিগমার মধ্যে ভুগি এই সময়টায়। আমাকে তাড়া করে ফেরে আজকে থেকে ৩১ বছর আগের ঠিক এই দিনগুলো।  

এই সময়টি ছিল ১৯৯০ সালের ২৫ এপ্রিল, অন্যান্য গ্রীষ্মের সকালের মতই আমাদের ঘুম ভেঙ্গেছিল।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, দুইদিন পরে ঈদ। ১০-১২ দিনের মধ্যে মা চলে যাবে ইউ এস এতে ১৩ মাসের জন্য। সকাল ১০ টা নাগাদ বাবা তখন কোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছেন, আম্মাও অফিসে যাবে মনে হয়। হঠাত দেখি আমাদের বাসায় কিছু পরিচিত আত্মীয়- স্বজন আর আম্মার একান্ত কিছু স্টাফের আনাগোনা।
 

কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাচ্ছি না, আব্বা চলে আসলেন কিছুক্ষনের মধ্যে- বড় ভাই মুনির নাকি ঢাকায় অসুস্থ, আব্বা দুপুর দেড়টার শাকিল খানে ঢাকায় যাবে। আমি বোধহয় দ্রুত আব্বার স্যুটকেস গুছিয়ে দিলাম, আব্বা লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন যথারিতি ঢাকার উদ্দেশ্যে। এদিকে বাসায় লোকজন বারছেই, কেউ আম্মার সামনে কিছু বলছে না। বড় ভাই মুনির অসুস্থ... আম্মা যদি আরও টেনশনে অসুস্থ হয়ে যায়। বিকাল বেলা মেঝো ভাই, জাকিরকে খুব সম্ভবত দূর থেকে কাদতে দেখলাম। আমি সন্ধ্যায় পড়তেও বসে গেছি, ইফতারের পরে।  

তারপর রাতে ঘুমালাম, সকালে উঠে দেখি বাসায় কান্নার রোল ... মুনির নাকি মারা গেছে। আমি অবাক... কিছু বুঝতে না বুঝতে আম্মার অফিশিয়াল গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার আতাহার কাক্কু আমাদের সবাইকে দাদীর বাড়িতে নিয়ে আসলো...  সকাল ৮ টা নাগাদ আসলো সেই ট্রাক, লাশবাহী ট্রাক। জানালায় লাল পতাকা লাগানো কালকে ঈদ, জীবনে প্রথম মনে হয় সেদিন কফিন দেখেছিলাম। কোথা থেকে একটা শাবল যোগাড় করে চাড় দিয়ে কফিন খোলা হল- মনিরের নিথর লাশ। চোখে সুরমা দেয়া, কর্পুর লাগানো- গলায় থুত্নি পর্যন্ত লাশকাটা সেলাই- ক্লিন শেভড মুখ।

মুনির মারা গিয়েছিল আগেরদিন সকাল ৯-১০টার মধ্যেই, অফিশিয়ালি আত্মহত্যা। অথচ আমাদের পরিচিত প্রিয় আত্মীয় স্বজনরা আমার বাবার মত পলিটিকালি ইনফ্ল্যেনশিয়াল লোককে ভাওতা দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে লঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছিল। তথাকথিত ময়না তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন, তিনি কিছুতেই ঢাকায় যোগাযোগ না রাখতে পারেন। খুব দ্রুততার সাথে লাশের সুরতাহাল, উদ্দার, ময়না তদন্ত ,গোছল শেষ করে মুনিরের লাশ যখন পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রাত ৯ টায় রওনা দিয়েছে বাবা তখন সবে লঞ্চে বরিশাল লঞ্চ ঘাটে পৌছেছেন, যিনি তখনও জানেন না তার সবচেয়ে বড় ছেলেটি মারা গেছে অনেক আগেই। বাবাকে বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকেই নামিয়ে আনা হয়েছিল আর রাত ১২ টা নাগাদ তিনি বরিশালের সেজো চাচার অফিশিয়াল গাড়ি নিয়ে পটুয়াখালীতে পৌছেছিলেন।

দুপুর বেলা পুরাতন হাসপাতালের কাছে শিশু একাডেমির সামনে জানাজা শেষ করে আমরা মুনিরকে পটুয়াখালী কবরস্থানে দাফন করি। সেদিন রাতে দারুন কাল বৈশাখী ঝড় হয়েছিল- অনেক বৃষ্টি। দাদীর বাসায় সামনের বারান্দায় বিছানায় শুয়েছিলাম, আমি আর আব্বা। আব্বা বলেছিলেন, বৃষ্টির শব্দে আর কান্নার শব্দে- মুনিরের কবরে পানি ঢুকছে, না ?- আমরা দুজনেই ভীষণ কাঁদছিলাম, একজন পিতা তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন।

তার পরেরদিন ঈদ, আম্মার চিৎকার আর কান্নায় শুরু হয়েছিল সেদিনটি। এরপর আম্মা যতদিন বেচেছিলেন, আমাদের প্রতিটি ঈদ শুরু হত মুনিরের জন্য কান্নায়।

এই দুঃস্বপ্ন আমাকে ভীষণ তাড়া করে গত ৩১ বছর... একটা রোলার কোস্টারের মত ঘোর লাগা এনিগমা। আমি চারপাশে খুব যেন, একটা অস্থিরতার শব্দ টের পাই ঈদের দিনের ঠিক ২ দিন আগে থেকেই... একটা লাশ, চোখে সুরমা-কর্পুর, গলা পর্যন্ত সেলাই, বাবার হাআতে সিকো ঘড়ি, গায়ে শাদা পাঞ্জাবি, কফিন আর কিছু কান্না- এক অবিমিশ্র ঘোর।

news24bd.tv / কামরুল