মিথের সাম্রাজ্য, হকিংয়ের কচ্ছপ ও প্রমিজডল্যান্ডের কথকতা

মিথের সাম্রাজ্য, হকিংয়ের কচ্ছপ ও প্রমিজডল্যান্ডের কথকতা

Other

স্টিফেন হকিং তার 'কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' নামের অতিবিখ্যাত বইটা শুরু করেছেন মজার একটা ঘটনার বয়ান দিয়ে। এক নামজাদা বিজ্ঞানী (অনেকে বলেন তিনি ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল) একবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর একটা বক্তৃতা দেন। তিনি বেশ মনোরম ভাষায় বয়ান দিয়ে যান যে ঠিক কীভাবে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে আর সূর্যই বা কীভাবে আমাদের আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। ভাষণ শেষ হতেই মিলনায়তনের এক কোণ থেকে  শীর্ণকায়া এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে মুখঝামটা দিয়ে বললেন- কীসব  গুলগপ্প বলেই যাচ্ছো!

শোনো বাছা, পৃথিবী আসলে একটা চ্যাপ্টা থালা, যা এক অতিকায় কচ্ছপের পিঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝলে! বিজ্ঞানী মশায় একখানা বেশ বিজয়ীর হাসি ঠোঁটের তলায় ঝুলিয়ে বললেন- তা যা বলেছেন আন্টি; তাহলে এটাও বলে যান যে, সেই প্রকাণ্ড কচ্ছপটাই বা ঠিক কিসে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? বুড়িও কম যাননি, বলেন কী না- তুমি বাপু সেয়ানা আছো বটে; তবে জেনে রেখো, পৃথিবীর তলায় খালি কচ্ছপ আর কচ্ছপ আছে! বিজ্ঞানীর দাঁতকপাটি লেগে যাবার দশা।

 

 

মার্কিন লেখক বব ফুলযাম তার বেস্ট সেলার 'All I Really Need to Know I Learned in Kindergarten' বইয়ে মিথ নিয়ে বেশ মজার কথা বলেছেন- 'আমার বিশ্বাস কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও শক্তিশালী। মিথের ক্ষমতা ইতিহাসের বাড়া। বাস্তবের চেয়েও স্বপ্ন ঢের মজবুত । আর অভিজ্ঞতাকে টেক্কা দিয়ে আশাকেই জয়যুক্ত হতে দেখা যায়।

তাহলে, মিথ বা পৌরাণিক ব্যাপারস্যাপার সম্বন্ধেও কিছুটা আলোকপাত করা যাক। এক্কেবারে সাদামাটা কথায়, যে গল্পের কোনো প্রমাণ বা ঐতিহাসিকতা নেই কিন্তু  শুনতে, মানতে ভালোই লাগে,  নানান কাজে বা অকাজে যাকে ভালই লাগানো যায় অথচ আবার উড়িয়ে দেয়া যায় না মিথ্যে বলে দাগিয়ে দিয়ে, তাকেই সম্ভবতঃ মিথ বলে।  

বনু ইসরাইলের আদিনিবাস নাকি ছিলো মিশরে। সেখান তাদের দাস বানিয়ে দেয়া হয়। একসময় তারা ফেরাউনকে ফাঁকি দিয়ে মিশর থেকে মহানিষ্ক্রমণ (exodus) এর মধ্য দিয়ে নীল নদ পেরিয়ে আজাদি লাভ করেন। তাদের অবশ্যি জিহোভাপ্রদত্ত একখানা গ্যারান্টিক্লজ আগে থেকেই ছিলো- কানানে একটি বাসভূমির নিশ্চয়তা (promised land)। ও হ্যাঁ, বলে রাখা ভাল- এত্তগুলা দাবির আবার ঐতিহাসিক সইসাবুদ নেই বলে তা মিথ্যে হবে নাকি; কার ঘাড়ে ক'টা মাথা- এ যে পাক্কা মিথ! জায়নবাদী পণ্ডিতেরা ঠিকই বের করে ফেলেছেন যে-সেই প্রতিশ্রুত কানান'ই হলো আজকের ইসরাইল, গাজা, পশ্চিমতীর, গোলান মালভূমি, সিনাই উপত্যকা ইত্যাদি মিলে।  

সে যাই হোক, মানবজাতি অক্সিজেন আর মিথের সাম্রাজ্যেই বসবাস করে। ইদানিং অক্সিজেন কিঞ্চিৎ কম পড়ে গেলেও রাম জন্মভূমি, প্রতিশ্রুতদেশ, জিহাদ, মসিহা, প্রাণীহত্যা মহাপাপ, সভ্যকরণ প্রকল্প ইত্যাকার নানান মিথের বাজার ভালোই চলছে।  

নামজাদা পুরানতত্ত্ববিদ জোসেফ ক্যাম্পবেল “The Power of Myth” (২০১১, পৃ. ৩০) এ 'ব্যক্তিকে নিছক তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নয় তামাম পৃথিবীর মাঝে খুঁজে পেতেই আমাদের মিথের দরকার' বলে দাবি করলেও আমাদের জন্য নিরাপদ হলো- কচ্ছপের গল্পে আস্থা রাখা। পৃথিবীর তলায় কচ্ছপ, তার নিচে কচ্ছপ, এরপর কচ্ছপ, অতঃপর কচ্ছপ ... মিথ, মিথের উপর মিথ, তদুপরি মিথ এবং মিথ, এভাবে যেতে যেতে সবচে' উপরে যা পাওয়া যাবে তার নাম ইসরাইল! মিথ'ই সব, বাকি সব মিথ্যা।

মিল্লাত হোসেন, বিচারক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী