বিলেতি সৌরভ ছড়িয়ে যাক; মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

বিলেতি সৌরভ ছড়িয়ে যাক; মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

Other

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিলেতি সৌরভ’ প্রবন্ধের ঢঙে লেখা । কিন্তু সুখপাঠ্য গল্প। চৈতন্য প্রকাশিত ১৫২ পৃষ্ঠার ভ্রমণ আলেখ্যটির রচয়িতা  হুসেইন ফজলুল বারী। তিনি যখন ফেসবুকে কিছুকিছু আপলোড করছিলেন তখন চোখে পড়েছে।

ভালো লেগেছে, আপ্লুত হয়েছি  ঐ সময় থেকেই। এটা বলতে হলো এজন্য যে, সময়ে ব্যবধানে পাঠকের আগ্রহ কমে যায়, পাঠক মরে যায়। কথাশিল্পী বনফুলের 'পাঠকের মৃত্যু' নামে একটি ছোটগল্প আছে। একই বই বছর দশেক পর পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হয়েছিল রাবিশ লেখা, পাঠের অযোগ্য।
কিন্তু ‘বিলেতি সৌরভ’ পুরো বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মনে হলো -চমৎকার কিছু পড়লাম।

মৃত রাজাকে কেউ স্মরণ করে না। সংকীর্ণমনা ঔপনিবেশিক দাসসুলভ মানসিকতা ও ক্ষমতাপূজারী একচোখা ইতিহাস বাহাদুর শাহকে স্মরণ রাখতে চায় না। কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দেশকে মুক্ত করার শপথ নিয়েছিলেন। লেখকও শুরু করেছেন নি:সংগ সম্রাট বাহাদুর শাহকে দিয়ে।

বাহাদুর শাহ জাফর আক্ষেপ করে লিখেছেন, “কী দুর্ভাগ্য জাফরের, স্বজনদের বা ভালোবাসার ভূমিতে তার দাফনের জন্য দু'গজ মাটি, তাও মিলল না”। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন। সে-সময় বাহাদুর শাহের ত্যাগ ও কুরবানির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আক্ষেপভরা এই বিখ্যাত শায়েরীর জবাবে পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন:
"হিন্দুস্তানে আপনি দু গজ মাটি পান নি তো কি হয়েছে, আপনার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের মুক্তির আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য আপনার নয় জাফর, স্বাধীনতার পয়গামের মধ্যে দিয়ে ভারত সম্মান ও মর্যাদার সহিত আপনার নাম নিজের সাথে জুড়ে রেখেছে। "
-২-
বিলেতি সৌরভের লেখক নেতাজী ও রাজীব গান্ধীর মতোই বিরল ব্যতিক্রম। সাবেক কলোনিয়াল শাসকদের বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামের বিস্মৃত নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা লেখকের সৎ ও স্বাধীন মানসিকতা। লেখক নি:সংগ সম্রাটের গল্প বললেও তিনি নিজে কিন্তু নি:সংগ নন। রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ যে তাগানরোগ শহরে জন্মগ্রহণ করেন সেই শহরের বাসিন্দা সুন্দরী আলিসা তাঁর বেড়ানোর সংগী। খোঁপার চেয়ে ভালো কোনও ফুলদানি নেই বলে সতীর্থ এক অনুরাগী ব্রিটিশ সহপাঠীর কবরীতে  ফুল গুঁজে দেয়ার ইচ্ছে হয় লেখকের, কিন্তু ববকাটে কী পুষ্প গাঁথা যায়? সিঙ্গাপুরি মেধাবী তরুণীর সাথে নিপাট বন্ধুতার আলোছায়ায় লেখক ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে আলপনা এঁকেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। গ্রিক সহপাঠীর আবদার কিংবা শিয়া তরুণীর সাথে আলাপচারিতার রেশে সক্রেতিস ও আবু হানিফার করুণ পরিণতির কথা এসেছে। এসেছে মার্ক্স, কিটস, রবি ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্থানের দুর্দান্ত বর্ণনা। ইউনিভার্সিটিতে ছড়ি হাতে বসে থাকা আইনবিদ জেরেমি বেন্থামের মমি আর আইনের শাসনের সূতিকাগার ম্যাগনা কার্টা স্বাক্ষরিত হবার স্থান দর্শনের যে গল্প বলেছেন তা যেমনি সুখপাঠ্য, তেমনি তৃষ্ণা নিবারক।    

এভাবে পনেরটি গল্প দিয়ে 'বিলেতি সৌরভ' ছড়ানো হয়েছে। আত্মকথন আকারে গল্পগুলো শাখা মেলেছে। শাখা থেকে প্রশাখা। কোন কোন সময় পাঠকের মনে হবে বিদগ্ধজনদের আড্ডায় বসে আছেন। প্রেম-বিরহ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, মানবিক টানাপোড়ন ও দেশপ্রেম কোনকিছুই বাদ নেই গল্পগুলোতে। তথ্য ঠাসা। তত্ত্বও দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে। তবে সমগ্র গ্রন্থের ভাষাশৈলী বেশ ঝরঝরে।

"এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে। " রবি ঠাকুর ডেকেছেন নীপবনে। আর প্রফেসর ড. শাহ আলম স্যার ডেকেছেন তপোবনে। রবি ঠাকুরের নীপবনটাকেই যেন তপোবনে পরিণত করলেন আইনের এই কণ্বমুনি। শহর থেকে দূরে পাহাড়ী নিস্তব্ধতায় জারুলের ছায়ায় গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য আইন বিদ্যাপীঠ। তপোবনের অন্যান্য মুনিঋষি, যেমন- মোর্শেদ স্যার, খালেদ স্যার, জাকির স্যার,  ফারুক স্যারসহ অন্যদেরও অবদানের উল্লেখ আছে এক অধ্যায়ে। এসেছে জারুলতলের আড্ডা কিংবা শাটলট্রেনের দুর্লভ ভালোলাগার গল্প।  

লেখকের আদালতের ঘটনা। পুলিশ অফিসার অভিযোগ উত্থাপন করল এভাবে, "আপনাকে মদ্যপানের জন্য এখানে আনা হয়েছে"। আসামি বাইশ-তেইশ বছরের সুদর্শন যুবক। বিচারকের আসনে বসা লেখককে উদ্দেশ্য করে বলেন-‘চলুন, শুরু করা যাক’। এ রকম ঘটনা অনেকের সামনে ঘটে। সবাই রস আহরণ করতে পারে না। বিলেতের পেলব বর্ণনার আড়ালে আইন-আদালতের যে অম্ল-মধুর গল্প বলেছেন- তা একবারে জীবন্ত।  

এভাবে 'সেমিটিক ললনা, তীর্থ, বিলেতি সারমেয় থেকে শুরু করে প্রতিটি গল্পই দুর্দান্ত। সুরুচির পাঠকদের খোরাকে ভর্তি এইসব গল্প। পাঠক বিদগ্ধ হলে কোন কোন সময় মনে হবে তিনি কৃষণ চন্দর পড়ছেন। আবার কোন সময় মনে হবে এই ফিরে এল 'দৃষ্টিপাত' এর যাযাবর। মোহিতলাল মজুমদারের মতো কড়া স্বভাবের সমালোচকও দৃষ্টিপাত পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিজেই ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বইখানি পড়িয়া আমাদের মতো বিশ্বনিন্দুকও মুগ্ধ হইয়াছে। রচনার আরও দুটি গুণ আছে, একটি লেখকের অতিশয় সপ্রতিভ চিন্তা; আরেকটি তাহার তীক্ষ্ণ রসবোধ- ইংরেজিতে যাহাকে Sense of Humor বলে। ’ বিলেতি সৌরভের স্রষ্টার রসবোধও অতি উন্নত। যেহেতু তিনি চারুদত্ত আধারকার নন, কাজেই তাঁর হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। আমি নিশ্চিত, নিয়মিত  লিখলে তাঁর পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্য অনিবার্য।  
-৪-
কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়ে মানুষ প্রেম করতে শিখেছে’। আশা করি, ' বিলেতি সৌরভ'ও এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে না। নতুন যাঁরা বিদেশে,  বিশেষত ইংল্যান্ডে পড়তে যাবেন তাঁদের জন্য এই বইটি বেশ সহায়ক হবে। বিদেশী সহপাঠীদের  সাথে কিভাবে পরিচয় হবে, তাদের সাথে কোন বিষয়ে কথা বলা যাবে এসব ক্ষেত্রে এই বই খুব ভালো কাজে আসব। এপ্রোচ ও এটিচুডের কারণে কারোটা হয় ইভটিজিং, কারোটা হয় প্রেম-প্রস্তাব। কথা হলো-জানা লাগবে। শেখা লাগবে। মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে মেয়েরা খুশি হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে না। আবার সব সব সময়ও না। কী অসাধারণ ভাষাগত সুষমায় নারী সৌন্দর্যের বর্ণনা এসেছে লেখকের লেখনীতে-তা সাহিত্য চর্চার নতুন দিক বলে মনে হয়েছে। বলছি না প্রেমে পড়তেই হবে। কিন্তু লুকিয়ে-চুকিয়ে যাদের প্রেম করার বাতিক আছে কিংবা যাঁরা সাহিত্য রচনা করতে চান লেখকের শব্দ প্রয়োগ, কাহিনীর বুনন এবং ভাষার অপূর্ব কলাকৌশল তাঁদের কাজে লাগবে। অদ্ভুত সব উপমা, পরিহাস, উৎপ্রেক্ষা, শ্লেষ আর কবিতার পঙক্তিমালায় পুরো বই ঝলমল করছে। তাই শিক্ষিত মানুষদেরই বেশি ভালো লাগবে তাঁর গল্পগুলো। ডিগ্রী থাকলেই শিক্ষিত নন। ভিতরে কিছু থাকা লাগবে। কারণ -সাহিত্য বিচারে 'বিলেতি সৌরভ' হলো সাহিত্যিকদের সাহিত্য। কাজেই বেসিক কিছু লিটারেচার পড়া না থাকলে কোন কোন জায়গায় পাঠক রস আস্বাদন করতে ব্যর্থ হতে পারেন। তবে সেটা বইয়ের সামগ্রিক ও সার্বজনীন উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে না। এই গ্রন্থপাঠে  সাহিত্য, আইন কিংবা ইতিহাসের অনুরক্ত পাঠকগণের অনেক পিপাসা মিটবে। বলতে দ্বিধা নেই, অন্তত গত দুই দশকে এই মানের বাংলা ভ্রমণ সাহিত্য আমার চোখে  পড়ে নি।  

বাঙালি গানভক্ত লোকদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি নাহিদ নিয়াজির 'আকাশের ওই মিটি তারার সনে কইবো কথা নাইবা তুমি এলে' গানটি শোনেননি। সেই বিখ্যাত শিল্পীর সাথে লেখকের দীর্ঘ আড্ডা পাঠককে আলোড়িত করবে। এই কালজয়ী গানটির শিল্পী বাংলায় কথাও বলতে পারেন না। তিনি উর্দুভাষী।  

লেখক এত জাঁকজমক ও চাকচিক্যময় বিলেতে গিয়েও বাবা মা’কেই মিস করতেন। মিস করতেন নিজের গ্রাম, চেনা রাস্তা ও আড্ডার শহর এভাবেঃ ‘আমি বিলেতের হাজার বছরের পুরনো পার্লামেন্টের শীর্ষে চেয়ে থাকি, কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে আমার গাঁয়ের অনুচ্চ মসজিদের চুড়ায়’।   'ফেরা' গল্পে দেখা যায়- বাবার বুকে ফিরে লেখক কী এক স্বর্গীয় প্রশান্তি অনুভব করেছেন!এটা পাঠক হৃদয়কে দোলা দেবে।   হঠাৎ দেখা বরফকণায় আঙুল ছুঁয়ে লেখকের যে মায়ের হাতের ইলিশের ঝোল মেখে গরম ভাত খাবার ইচ্ছের কথা বলেছেন-তাও হৃদয় ছুঁয়ে যায়।  

আসলেই এটাই মূল মানুষ। এটা না থাকলে হয় না। এঁরাই দেশের সম্পদ। এঁদের দিয়েই হয়। বিলেতি সৌরভ এঁরা সাময়িকভাবে গায়ে মাখতে বাধ্য হলেও বিলেতি সৌরভে আচ্ছন্ন হন না। টেমসের পাড়ে সেমিটিক ললনা বা সিঙ্গাপুরি রাজশ্রীর সাথে বন্ধুত্ব হয়,  কিন্তু বাঙালীর আঁচলেই স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়েন।

বেশকিছু সাদাকালো ও রংগিন ফটোগ্রাফি আছে বইতে। ছবির মান এক্সিলেন্ট বলা যাবে না। তবে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাদাকালো ছবিটা খুব চমৎকার হয়েছে। উজ্জ্বল হাসিমাখা রানী যেন 'বিলেতি সৌরভ' এর জয়গান গেয়ে চলেছেন। আমরাও বলি -'বিলেতি সৌরভ' ছড়িয়ে যাক।

রচয়িতা বিচারক ও গবেষক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

সম্পর্কিত খবর