যেভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়

যেভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়

Other

বিশ্বে ইহুদিদের নিজেদের কোনো দেশ ছিলো না। তারা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। ১৮৯৭ সাল থেকেই তাদের এই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ফিলিস্তিনে বসবাস করতো।

ইহুদিরা বিশ্বাস করে ফিলিস্তিন হলো তাদের জন্য ঈশ্বর প্রতিশ্রুত ভূমি। তাই তারা ফিলিস্তিনকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্থান হিসেবে বেছে নেয়।

ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। ফিলিস্তিন অঞ্চলটি পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চলগুলোর অন্যতম।

এর আয়তন ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইল। ফিলিস্তিন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়।

ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বিষয়টি জানিয়ে ইহুদি জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে একটি চিঠি লিখেন। সে চিঠি ইতিহাসে 'বেলফোর ডিক্লারেশন' হিসেবে পরিচিতি পায়।

রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ইহুদি ফিলিস্তিনে না থাকায় ব্রিটিশরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসে এবং ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করতে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে থাকে। ১৯২২ সালে ইসরায়েলে ইহুদি ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, ১৯৩১ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ, আর ১৯৪৭-এ তা বেড়ে ৩২ শতাংশে দাঁড়ায়।

১৯২৩ সালে স্বাধীন তুরস্কের জন্ম হলে ইহুদীরা তাদের ঈস্পিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উদগ্রীব হয়ে যান। ইহুদি নেতারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, পোল্যান্ড, গ্রীস এবং সুইজাল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদিদেরকে ইসরায়েলে বসতি গড়ার আহ্বান জানান।   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে প্রায় আড়াই লাখ অভিবাসী ইহুদি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পাড়ি জমায়।

১৯৩০-্এর দশকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারে যে তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে দলে সেখানে আসতে শুরু করে এবং জমি কিনতে থাকে। আরবরা বুঝতে পারে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিদ্রোহ করে তারা। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয় ব্রিটিশ সৈন্য ও ইহুদিরা। কিন্তু সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। তাদের কঠোর দমন-পীড়নে আরব সমাজে ভাঙন তৈরি হয়।

ইহুদিরা তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল। ব্রিটেনের সহায়তায় সে অনুযায়ী তারা কাজ এগিয়ে নেয়। ১৯৩০'র দশকের শেষের দিকে ব্রিটেন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থান জোরালো করতে সচেষ্ট হয়। সেজন্য আরব ও ইহুদি দু'পক্ষকেই হাতে রাখতে চেষ্টা করে ব্রিটেন।

১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পঁচাত্তর হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে। অর্থাৎ সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। ব্রিটেনের এ ধরনের পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি ইহুদিরা। তারা একই সাথে ব্রিটেন ও হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনা অনুয়ায়ী ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। সেখান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ইহুদি সৈন্যরা ব্রিটেন এবং আরবদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর দ্বারা লাখ-লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ট্রুম্যান চেয়েছিলেন হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে জায়গা দিতে।

কিন্তু ব্রিটেন বুঝতে পারছিল যে এতো বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিয়ে গেলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে। এ সময় ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো শুরু করে। তখন ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার-হাজার ইহুদিদের বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা ফল হয়নি।

ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি করা যাতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। তখন সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর বাধ্য হয়ে ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

  চাকরির পেছনে না ছুটে যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

  গণমাধ্যমের শত্রুরা বন্ধু সেজে সরকারবিরোধী উসকানি দিচ্ছে: ওবায়দুল কাদের

  করোনাভাইরাসে আক্রান্ত খালেদ মাহমুদ সুজন

  কামরুলের জিম্মায়ই জামিন পেলেন সেই মডেল রোমানা স্বর্ণা

 

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ৮-১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের মোট জমির ৫৫ শতাংশ দেয়ার প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিলো ইহুদিদের দ্বিগুণ। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়।

জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ছেড়ে যাবার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যরা দিন গণনা করছিল। তখন ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। তাদের গোপন অস্ত্র কারখানাও ছিল। ইহুদিরা আরবদের ওপর জোরালো আক্রমণ শুরু করে। অনেক বিশ্লেষক বলেন, তখন ইহুদিরা আরবদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেছিল।

ইহুদি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নৃশংসতা আরবদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র দলগুলো ইহুদিদের ওপর কয়েকটি আক্রমণ চালায়। কিন্তু ইহুদিদের ক্রমাগত এবং জোরালো হামলার মুখে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে ফিলিস্তিনিরা। তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইহুদিরা তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। তার আগেই তৎকালীন ইহুদি নেতারা ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জন্ম নেয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল।

news24bd.tv আহমেদ