একযুগেও দুর্ভোগ কমেনি সাতক্ষীরার আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের
আজ ভয়াল ২৫ মে

একযুগেও দুর্ভোগ কমেনি সাতক্ষীরার আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের

Other

আজ ভয়াল সেই ২৫ মে। ২০০৯  সালের এই দিনে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সুন্দরবন ঘেষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির উপকুলীয় জনপদ। আইলার ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ এখনও কমেনি। লোনা পানির কারণে এলাকায় ফসল ফলে না, নেই কোনো কর্মসংস্থান।

রয়েছে তীব্র খাবার পানি সংকট, রাস্তা-ঘাটের সমস্যা, আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৭ কিলোমিটার নদীর বেড়িবাঁধ গুলোয় আবারও ফাঁটল ও ভাঙ্গন দেখা দেওয়ায় চরম ঝুঁকিতে এলাকাবাসী। ফলে আইলা দুর্গত এলাকার মানুষের এখনো কাটছে দুর্বিসহ জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রতি বছরই উপকূলবাসীকে আইলা,সিডর, মহাষেন, বুলবুল ও আম্ফানের মতো প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক দূযোর্গ মোকাবেলায় ও এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের বিশেষ বরাদ্দের জন্য সাতক্ষীরা জেলাকে অতি দূর্যোগপ্রবণ ক্ষতিগ্রস্থ্য জেলা হিসাবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল।

আইলা দুর্গত এলাকার মানুষের এখনও কাটছে দুর্বিসহ জীবন। অর্থের অভাবে বসতঘর নির্মান করতে না পেরে প্রখর রোদ, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেকেই। এলাকায় লোনা পানির কারনে জমিতে ফসল ফলে না। তাই নেই কোনো কর্মসংস্থান। অন্ন, বস্ত্র, খাবার পানি আর বাসস্থানের জন্য এখনও চারিদকে চলছে হা-হা-কার।  

২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা ঘুর্ণিঝড় ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে সাতক্ষীরা  জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার উপকুলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদী পশু আর বসত ঘর বাড়ি। ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার। লাখ লাখ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকুল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সর্বনাশা ‘আইলা’র আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায় নিহত হয় ৫৫ জন নারী,পুরুষ ও শিশু। আর আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ। আইলা ১২ বছর পূর্তিতে আজও সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভীদ শুন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ফসল ও করোনার লগডাউনের কারণে চিংড়ী রপ্তানি বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন মানুষ এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল ওই এলাকার মানুষের জীবনযাপন এখন দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের অভাব-অনটন বেড়েই চলেছে। ক্রমে বাড়ছে দরিদ্র ও অতি দরিদ্রের সংখ্যা। আইলার পর থেকে ঘূর্ণিঝড় মহাষেন, বুলবুল, আম্ফানের মতো একের পর এক প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলোর স্থান ভেদে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে বয়াবহ ফাঁটল দেখা দিয়েছে।

শ্যামনগরের খোলপেটুয়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন জানায়, আইলা দুর্গত এলাকায় আশির দশক থেকে লবন পানির চিংড়ি চাষ ছাড়া আর কিছুই হয় না। আইলার পর পাউবোর ভেড়িবাঁধ কেটে নদীর পানি চিংড়ি ঘেরে উঠাতে দিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। ফলে এলাকায় না হচ্ছে চিংড়ি চাষ, না হচ্ছে কোন ফসল। ফলে মানুষের হাতে কোনো কাজ না থাকায় বহু পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

চকবারা ক্লোজার সংলগ্ন নদীতে নেট জাল দিয়ে রেণু পোনা শিকারে ব্যস্ত নবম শ্রেণির ছাত্রী আসমা আক্তার জানায়, বাবার একার উপার্জনে সংসার চলছে না তাই নদীতে জোয়ার লাগতেই মায়ের সাথে এসে মাছের পোনা ধরছে সে। তার মতো অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা এখন ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে নদীতে জাল নিয়ে মাছের পোনা সংগ্রহ করছে।

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদ আলম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১০ সালের ২৩ জুলাই আইলা কবলিত এলাকা পরিদর্শনে এসে প্রথম পর্যায়ে দশ হাজার পরিবারকে গৃহ নির্মাণের জন্য ২০ হাজার করে টাকা (মোট ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) অনুদান দেয়। পরবর্তিতে জলবায়ু ট্রাস্ট ও জেলা পরিষদের টাকায় এলাকায় অনেকে বসতঘর পেয়েছে। তবে সেটা খুব অপ্রতুল। পয়সার অভাবে ঘর বাঁধতে না পারায় অনেকেই এখনও বাঁধের উপর বসবাস করছে। এলাকায় ফসল উৎপাদন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ পার্শ্ববর্তী নদীতে মাছ ধরে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছে। এক সময় উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আইলার পর সুন্দরবনের জলদস্যুর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালীরা আজ অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। এলাকায় কোন কাজ না থাকায় বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছে।  

শাকিলা ইসলাম জুঁই সাতক্ষীরা