টপোনিমিক্স : বাংলাদেশে স্থাননামের অংশ হিসেবে টেক

টপোনিমিক্স : বাংলাদেশে স্থাননামের অংশ হিসেবে টেক

Other

স্খাননাম বা ভৌগোলিক নামের উৎপত্তি, অর্থ ও ব্যববহার সংক্রান্ত বিদ্যাকে টপোনিমিক্স বলা হয়। বাংলাদেশ জুড়ে যতো জায়গা আর তার যতো নাম- সবই কি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা বা পড়ে পাওয়া ধন? না কি এইসব জায়গার এইসব বিশেষ নামকরণের পেছনে কোনো তাৎপর্য রয়েছে?

আদর করে ছেলেমেয়েকে যে-কোনো নামে ডাকা আর একটি স্থানের নাম রাখা এক ব্যাপার নয়। স্থাননামের মূল্য ব্যক্তিনামের থেকে বেশি, স্থায়িত্বের দিক থেকেও বেশি মূল্যবান। স্থাননাম নিরর্থক হয় না, কোনো না-কোনো অর্থ থাকেই।

কোনো স্থাননাম তৈরি হয় নানাভাবে আর নানাকিছুর প্রভাবে। টপোনিমিক্স স্থাননামের ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে।

আমার বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের জমিদার পাড়ায়। গ্রামের নামও হারবাং।

আমাদের পাড়াটি বেশ বড়। আমার বাড়ি পাড়ার একেবারে উত্তরে। অনেকে জমিদার পাড়া বলার পরও জমিদার পাড়ার কোন জায়গায় জিজ্ঞেস করে। তখন অবস্থান বোঝাতে বলি, বাইন্নারটেকের পাশে।

এই টেক মানে চাটগাঁইয়া ভাষায় নদী বা রাস্তার বাঁক বা মোড়। আমার বাড়ির পাশেই একটা ছড়া বা খালের বাঁক। ওপারে বাইন্নাপাড়া বা বানিয়াপাড়া। তাই এই বাঁক বা মোড়ের এই নাম হয়েছে। যদিও এখানকার বানিয়াদের উপাধি ধর। কিন্তু পেশায় স্বর্ণকার বলে তাদের বানিয়া বা বাইন্না বলা হয়। হারবাং বাস স্টেশনের উত্তর পাশে বুড়ির দোকানের আগে রয়েছে সইব্বারটেক বা শইপ্পারটেক।

নাফনদীর বাঁকে অবস্থিত দেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলার নাম টেকনাফ। কক্সবাজার সদর ও ঈদগাঁওয়ে রয়েছে টেকপাড়া। কক্সবাজারে নাজিরারটেক নামেও একটি জায়গা আছে। জেলার পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নে রয়েছে টেকপাড়া নামে একটি এলাকা। কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নেও একটি টেকপাড়া আছে। এর পাশে আছে খুইদ্দারটেক।

চট্টগামে আঁকাবাঁকা অর্থে টেকবেঁক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামে মোড় ঘোরা বোঝাতে বলে টেক ফিরা। চট্টগ্রাম শহরের অদূরে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতুর দক্ষিণ পাড়ে একটি জায়গার নাম মইজ্জারটেক। এটিও মোড় বা টেক। এর আশেপাশে আছে সৈনারটেক ও খুইদ্দারটেক নামে আরো দুইটি এলাকা।

চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী থানার ফিশারি ঘাঁট এলাকায় টেকপাড়া নামে একটি পাড়া রয়েছে। বন্দর থানায় রয়েছে কলসিদিঘির পাড় বারেক আলী ফকিরেরটেক বা ফইররটেক। নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকার এ-ব্লকে রয়েছে বালুরটেক নামে একটি এলাকা।  

চট্টগ্রামের পটিয়ায় রয়েছে মনসার টেক ও গৈরালার টেক বোয়ালখালীতে রযেছে আফুল্লার টেক ও বড়ুয়ার টেক। বড়ুয়ারটেক আছে বান্দরবান পৌরসভার কালাঘাটায়ও।

সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্তে আসা কঠিন নয় যে বাংলাভাষায়ও শব্দটি এক সময় বেশ প্রচলিত ছিলো এবং একই অর্থে অর্থাৎ বাকঁ বা মোড় অর্থে ব্যবহৃত হতো। কখনোবা ছোট টিলা বা পাহাড় অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রাম বা এলাকার নামের শেষাংশ হিসেবে ‘টেক’-এর ব্যাপক ব্যবহার থেকে এর অর্থময়তা ও ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

টেক এখানে একটি সাধারণ স্থানবাচক বিশেষ্য। এর আগে একটি ষষ্ঠী বিভক্তি যুক্ত করে একটি অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস নিষ্পন্ন করার মাধ্যমে একটি স্থানবাচক বিশেষ্য পদ গঠন করা হয়েছে। তবে সরাসরি টেকের পাড়া থেকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস টেকপাড়া নামটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সারাদেশে। এমনকি, পশ্চিমঙ্গেও টেকপাড়া রয়েছে।

ঢাকা মহানগরের কাফরুল থানাকে ভাগ করে সৃষ্ট থানার নাম ভাষানটেক। পল্লবী থানার উত্তর কালশীতে রয়েছে বুড়িরটেক। উত্তরখান থানার দক্ষিণে রয়েছে আরেকটি বুড়িরটেক। আশুলিয়ার কবিরপুরে রয়েছে আরও একটি বুড়িরটেক। মীরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়  পীরেরবাগ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে অলি মিয়ারটেক।

আর কপালের ফেরে আমি বহুবছর ধরে থাকি ঢাকার আদাবর থানাধীন শেখের টেকে। এটিও একটি মোড়। অর্থাৎ এখানেও শেখেরটেক বলতে মোড় বোঝানো হয়েছে। আর শেখেরটেকের মাইল খানেক দক্ষিণে রয়েছে বইদ্দারটেক। এটি হালের মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে বৈদ্যেরটেক নামে একটি গ্রাম আছে।  
ঢাকার সবুজবাগ থানার বাসাবো এলাকায় রয়েছে মাদারটেক নামের জায়গা। বাড্ডায় রয়েছে, টেকপাড়া ও লৌহেরটেক। গেন্ডারিয়া থানার স্বামীবাগে রয়েছে মুন্সীরটেক। এছাড়া উত্তরখানে রয়েছে মৈনারটেক বা ময়নারটেক, নির্নিরটেক ও বুড়িরটেক। দক্ষিণখানে রয়েছে মোল্লারটেক। খিলগাঁও থানায় রয়েছে ত্রিমোহনী টেকপাড়া। ভাটারা থানার বাড্ডায় রয়েছে খিলবাড়ির টেক ও টেকপাড়া।  

ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার বাইপাইল পশ্চিম পাড়ায় রয়েছে দরগারটেক। বারোলের অদূরে শামের বা শ্যামেরটেক। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সামাইরে রয়েছে টেকপাড়া। শাহআলী থানার তুরাগ নদের তীরে রয়েছে সিন্নিরটেক। আশুলিয়া থানার ধামসোনা ইউনিয়নে রয়েছে বড়টেক, মোল্লারটেক, কালারটেক, নয়াটেক, পেয়দারটেক ও বলারটেক। ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়নে রয়েছে রৌহারটেক। সোমবাগ ইউনিয়নে রয়েছে সোনারটেক।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার রুহিতপুর বাজার ধর্মশুর সংযোগ সড়কের সামনে রয়েছে বালুরটেক নামে একটি জায়গা। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায়ও একটি বালুরটেক রয়েছে। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানায়ও বালুরটেক রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম আলীরটেক। সোনারগাঁ উপজেলা এবং আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রামে রয়েছে টেকপাড়া। সাতগ্রামে আরও রয়েছে জিয়ারটেক ও ধোপারটেক। রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনায় রয়েছে টেকপাড়া। উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের মর্তুজাবাদে আরেকটি টেকপাড়া। সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার শিমরাইলেও একটি টেকপাড়া রয়েছে।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার মনোহরদী সড়কে রয়েছে দারগারটেক। কালিয়াকৈরের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে রয়েছে কানারটেক। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দুর্গম একটি চরের নামও কানারটেক।

মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার একটি বন্দর হলো টেকেরহাট। আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা নদী কুমার নদীর ওপর রয়েছে টেকেরহাট সেতু। এটি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের অন্যতম সেতু। সেতুটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বহু ঘটনার সাক্ষী। সদর উপজেলায় রয়েছে কাজীরটেক ফেরিঘাট।

মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় রয়েছে বালিরটেক। এখানে কালিগঙ্গা নদীর ওপর ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি  ৪৭ কোটি ১৭ লক্ষ ৪১ হাজার ২০৪ টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। এর নাম বালিরটেক সেতু।

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি টেকের সমারোহ। লালখারটেক, ভাঙ্গারটেক, জাঙ্খারটেক (জান খা’রটেক), কামারটেক, চান্দারটেক, কুলুরটেক, টঙ্গিরটেক, ডুপিরটেক, জোলারটেক, মৈশেরটেক, কুতুবেরটেক. নন্দিরটেক, দেবালেরটেক, সাধুরটেক, পাগলারটেক, সোনাইমুড়ি টেক ও টেকপাড়া নামের গ্রাম।  

সোনারগাঁ উপজেলার জামপরি ইউনিয়নে রয়েছে তিলাব কালারটেক গ্রাম। রায়পুরা উপজেলায় রয়েছে ব্রাহ্মণেরটেক। এছাড়া জেলা সদরের শিলমান্দী ইউনিয়নে রয়েছে কলারটেক ও টেকপাড়া। বেলাবো উপজেলায় রয়েছে পালেরটেক; ধনারটেক; কাওয়ারটেক; মধুয়ারটেক ও কাজীরটেক। উপজেলার বিন্নাবাইদে রয়েছে টেকপাড়া। সদর উপজেলার মাধবদী থানায় আছে যোগীরটেক। পলাশ উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নে আছে সাধুরটেক।  

ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার লালমোহন ইউনিয়নের ফুলবাগিচা এলাকার একটি গ্রামের নাম কালিরটেক। উপজেলার ধলীগোর নগর ইউনিয়নে রয়েছে বালুরটেক।

নোয়াখালীর সদর উপজেলার নোয়াখালী ইউনিয়নে রয়েছে তিরানব্বই সাল্লা ওরফে কাজীরটেক গ্রাম। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে রয়েছে রহিম মিয়ারটেক। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার দুধমুখা বাজার সংলগ্ন স্থানে রয়েছে উলাল মিয়ারটেক।

ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানায় রয়েছে আহালিয়াটেক, পুড়াদিয়াটেক ও টেকপাড়া গ্রাম। ভালুকা উপজেলার খারুয়ালীতে রয়েছে দরগারটেক। পানিভাণ্ডা গ্রামে রয়েছে বয়রারটেক।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় রয়েছে ভাতেরটেক গ্রাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে চর চারতলায় রয়েছে টেকপাড়া। চুয়াডঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামী ইউনিয়নের পাঁচলিয়ায়ও আছে টেকপাড়া।

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় আছে গাজীরটেক ইউনিয়ন ও লোহারটেক গ্রাম। জেলার সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নে রয়েছে নলেরটেক। লোহার টেক আছে গাজীপুর জেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নেও। এখানকার মাটি সিরামিকের জন্য বিখ্যাত।

দেখা যাচ্ছে সারা দেশে একমাত্র টেকনাফ ছাড়া উপজেলা বা থানার নামে টেক শব্দটি নেই। এছাড়া এ যৌগশব্দটির গঠনও আলাদা। অন্যান্য স্থাননামের সঙ্গে মিল রক্ষা করলে এটি হতো নাফেরটেক। অথচ তা হয়নি। এছাড়া লক্ষণীয় যে, খুব কম সংখ্যক ইউনিয়নের নামে এ শব্দটি আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি পাড়া বা ছোট লোকালয় অথবা বিশেষ কোনো স্থানের নামে টেক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

এমন উদাহরণ সারা দেশে আরো থাকতে পারে। খুঁজলে পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। কারো জানা থাকলে জানাতে পারেন।

বি. দ্র. লেখাটি তৈরি করতে আমার দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টার সঙ্গে আমার ফেবু ফ্রেন্ডসসহ সারা দেশের বেশকিছু মানুষের সহায়তা যুক্ত হয়েছে।

লেখক : হারুন আল নাসিফ : কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক।

(ফেসবুক থেকে নেয়া)

news24bd.tv/আলী