মানুষ নিজের চোখের আলোর শক্তিতে মানুষ হয়ে উঠুক

মানুষ নিজের চোখের আলোর শক্তিতে মানুষ হয়ে উঠুক

Other

১. কতটা বড় মানুষ। যতটা মানুষ ভাবে ততটা না। মানুষ যখন বিশাল আকাশের দিকে তাকায়, তখন মানুষ কতটা ছোট তা সে বুঝতে পারে। মানুষ যখন মহাসমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন উত্তাল নীল ঢেউ মানুষের কানে কানে যেন বলে যায় ‘যতটা বড় তুমি তোমাকে ভাবছো তুমি ততটাই ছোট।

’ সমগ্র পৃথিবীর সাথে মানুষের তুলনা কখনো কি করা যায়? যায় না।

প্রচণ্ড ঘূর্ণাবর্তের আঘাতের চেয়ে মানুষের প্রতিঘাত কখনো কি বড় হয়ে উঠতে পারে? হয়তোবা পারে, পারে না। সময়ের চেয়ে মানুষ কখনো বড় হয় না। তারপরও শক্তি দিয়ে মানুষ সময়কে কেনার বৃথা চেষ্টা করে।

ঠকে যায়, ধস নামে। মাটিতে গড়াগড়ি খায়। কেউ মানুক আর না মানুক, বড়র থেকে বড়, তার থেকে বড় থাকে।

এ যেন অসীম ধারণার যুক্তিতে বুলেটবিদ্ধ কবির কবিতার মতো। যে কবি প্রতিনিয়ত বড় থেকে বড় স্বপ্নের সাথে লড়ে যায়। থমকে দাঁড়ায়। নত হয়, ক্ষয়ে ক্ষয়ে রিক্ত হয়, আবার নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে একসময় বিস্মিত চোখে কিংবদন্তি মহানায়কের মতো উঠে দাঁড়ায়। মানুষ নিজেকে যত ছোট ভাববে, ততই মানুষ বড় হয়ে উঠবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এটাই গতানুগতিক ধারা। ঝাপসা চোখে আলোকিত চিঠির শব্দের মায়াবী জাদু।

একটা মানুষ কতটা শক্তশালী, কতটা বড়। যে মানুষ জানেনা তার মৃত্যু কখন হবে। কখন দেহটা মাটিতে মিশে হারিয়ে যাবে। সব কিছু অনিশ্চিত। গন্তব্যহীন। যেখানে সুর নেই, তাল নেই, আছে অচেনাকে চেনার মতো করে নিজেকে চেনার নিস্তব্ধতার গান। মানুষ যখন মানুষ হয়ে উঠবে, ছোট করে নিজেকে আবিষ্কার করবে তখন সব বড়র বড়রা মানুষের কাছে ছোট হয়ে ধরা দিবে। অহংকার নয়, হিংসা নয়, বড়ত্ব নয়, প্রতিহিংসা নয়, বিশুদ্ধ ও উদার মনের বড়ত্বে মানুষ বড় হয়ে উঠুক। ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মানুষ বড় হয়ে উঠুক। দুঃখকে জয় করে মানুষ বড় হয়ে উঠুক। চিন্তার শক্তিতে মানুষ বড়র থেকে আরো বড় হয়ে উঠুক। মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠুক। কুপির নিভু নিভু আলোর সাথে আলিঙ্গন করে মানুষ নিজেকে নিজের মতো করে চিনুক। তবেই না আমরা মানুষ। ছোট কিংবা বড়।

২. কেউ কেউ ভবিষ্যতকে দেখতে পায়। এটা মানুষের কপালের ঠিক নিচে থাকা দৃশ্যমান চোখের দেখা নয়। বরং মানুষের অদৃশ্য চোখের দেখা। অনেক সময় আমরা তৃতীয় নয়নের কথা বলে থাকি। হয়তো সেটাই এটা। এটা কোনো রূপকথা না, উপকথা না, হাইপোথিসিস না। এটা বাস্তবতা না, কল্পনাও না। এটা এমন এক শক্তি যা মানুষের ভিতরকে বাহিরে এনে অদেখাকে দেখার জীবনবোধ তৈরী করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ। অনেক বৈচিত্র্য। তবে অন্যকে বোঝার মতো শক্তি সবার থাকে না। কারো কারো থাকে। এই যে প্রকৃতি, সেটিকে দেখার মতো কজনইবা মানুষ আছে। হয়তো কেউ কেউ আছে। একটা কথা এখন বেশ প্রচলিত হয়েছে। কথাটা এমন সবাই মানুষ না, কেউ কেউ মানুষ।  

আজকের এই সময়ে কথাটা ফেলে দেবার মতো নয়। আমরা যে দুটো চোখ দিয়ে দেখি তা কি আমাদের মধ্যে দেখার গভীরতা তৈরী করতে পারে। কতটা পারে, কতটা পারে না, তা অনেকটাই আপেক্ষিক। বরং যে চোখ দিয়ে মানুষ দেখার অহংকার করে, সে চোখ হয়তো অন্ধ। মানুষ হয়তো ভেবে নিয়েছে চোখ তাকে দেখায়। কিংবা ঘটনাটা একদম উল্টো। হয়তো চোখ মানুষকে দেখে। যা বোঝার ক্ষমতা মানুষ রাখেনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার জীবনবোধের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, চোখ কতটুকুই দেখে কান কতটুকুই শোনো স্পর্শ কতটুকুই বোধ করে। কিন্তু মন এই আপন ক্ষুদ্রতাকে কেবলই ছড়িয়ে যাচ্ছে।  

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটু ভিন্নভাবে বলেন চোখ কেড়েছে চোখ উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক। যাই হোক এই কথাগুলো দর্শনশাস্ত্র ও মনস্তত্ব মিলিয়ে দেখবে। সেই বিচারে কোনো একটা অর্থবোধক ফলাফল হয়তো থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। কারণ মানুষ যা চিন্তা করে তা আবার অন্য চিন্তা দ্বারা পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা অব্যাহত থাকবে যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে। মানুষ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। এই দেখাটা কখনো মানুষ মনে রাখতে পারে, কখনো পারেনা।  

মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। মানুষের প্রচলিত চোখ দুটো বন্ধ থাকে। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। তার মানে স্বপ্ন দেখাটা চোখের উপর নির্ভরশীল নয়। এ পি জে আবদুল কালাম আজাদ জীবনবোধের গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না। যে স্বপ্নগুলো তৃতীয় চোখটা দিয়ে মানুষ দেখে, সেটা মানুষকে স্বপ্নের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নেয়।

এটা এমন এক চোখ যা মানুষের ভিতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। তাহলে এটা কি চিন্তার চোখ? সেটা হবার সম্ভাবনা হয়তো একটু বেশি। কারণ চিন্তা থেকেই মানুষের কল্পনাশক্তি জাগ্রত হয়। কিন্তু তারপরও তৃতীয় নয়ন আর চিন্তার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য হয়তো আছে। যেটা বুঝতে হলে নিজেকে চিন্তাশক্তির বাইরের কোনো এক পৃথিবীতে নিয়ে যেতে হয়। এটা সবাই পারেনা, কেউ কেউ পারে। বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে। এই নয়নে সে প্রেমে পড়া বিষয়টি চট করে বুঝে ফেলে। পুরুষের খারাপ দৃষ্টিও বুঝে। মুরুব্বি কোন মানুষ মা- মা বলেপিঠে হাত বুলাচ্ছে - সেই স্পর্শ থেকেও সে বুঝে ফেলে মা ডাকের অংশে ভেজাল কতটুকু আছে।

কথাটা খুব অর্থপূর্ণ। অনেকে মন্দ কাজ করে ভাবে সে ছাড়া বোধ হয় বিষয়টা কেউ জানে না। বুঝে না। বোঝারও চেষ্টা করে না। এটা তার অতি আত্মবিশ্বাস। যেটা ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক। আসলে মন্দ লোকের তৃতীয় চোখ থাকে না। একটা অসার মাথা থাকে। সাইকোপ্যাথির মতো মানসিক রোগ থাকে। অগভীর আবেগ, কম ভয়, উদাসীন সহানুভূতি, ঠাণ্ডা মাথায় অন্যায় করা, নিজ দোষ শিকার না করা, অহংকার করা, মানুষকে মিথ্যা কথা দিয়ে প্রভাবিত করা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পরিকল্পনা করে অন্যায় কাজ করা, সুযোগ খোঁজা, মানুষের ক্ষতি করে অনুতপ্ত না হওয়া, মানুষের কষ্ট দেখে উপহাস করা এবং অসামাজিক আচরণ যেমন খারাপ চরিত্রের দিকে ধাবিত হওয়া, স্বার্থপূরণের জন্য নিজের চরিত্র নষ্ট করা, পরের সাফল্যের বা শ্রমের উপর নিজ জীবনধারা বিন্যাস করা এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে অপরাধিত্ব বজায় রাখা-সবগুলো নেতিবাচকতা যার মধ্যে থাকে সেই তো সাইকোপ্যাথ।

আরও পড়ুন:

 আরবি-বাংলা অক্ষরে চিরকুট নিয়ে আসা সেই ‘কণ্ঠী ঘুঘু’ অবশেষে অবমুক্ত

 বাংলা টিভি ইউকের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ খান আর নেই

 চীনের আরও একটি টিকার অনুমোদন দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

 গুরুদাসপুরে পাট ক্ষেত থেকে নারীর মরদেহ উদ্ধার

 

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে। যাদের হয়তো আমরা চিনি, মুখের মুখোশটা ভদ্রতার খাতিরে টেনে বের করে আনিনা। তবে তৃতীয় নয়ন বলছে এসব অসুখে পড়া মানুষদের চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সেটা করতেও যে সাইকোপ্যাথরা চায়না। কারণ এখন অনেক অনেক সুস্থ মানুষ অন্যায় করতে সাইকোপ্যাথ সাজে। সাজার ভান করে। তবে টেলিপ্যাথি তা ধরে ফেলে। যেখানে একজনের সুপ্ত চিন্তা আরেকজনের মস্তিষ্কে ধরা পড়বে। মস্তিষ্কের সঙ্গে মস্তিষ্কের এ যোগাযোগ টেলিপ্যাথি নামে পরিচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকেরা বলছেন, কারও মনের কথা পড়ার বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মতভাবে সত্য হতে পারে। এমন এক পদ্ধতি তারা বের করেছেন যাতে দুই মস্তিষ্কের ভেতর চিন্তাভাবনা বিনিময় করা যাবে। এ পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে ব্রেইন নেট। কেবল দুই মস্তিষ্কের চিন্তার বিনিময় নয়। পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়কে আগে থেকে জানা ও বোঝা সেটাও টেলিপ্যাথির অংশ হতে পারে।

এমন অনেক অমীমাংসিত রহস্য পৃথিবীতে টিকে আছে, হয়তো সেটা তৃতীয় নয়নেরই জাদুকরী শক্তি। সেটা যেন হয় মানবিক মূল্যবোধের অংশ। জীবন দিয়ে জীবনকে বোঝার মর্মকথা। সব আবর্জনা আস্তাকুড়ে পড়ে থাকুক, নতুন নতুন ইতিবাচক চেতনা হোক বিকশিত। প্রতিটি মানুষের তৃতীয় নয়ন জেগে উঠুক সূর্যের আলোর মতো। সে আলোর তীব্রতায় পুড়ে যাক অন্ধকার। দগ্ধ হোক পুরাতন ধ্যান ধারণা। মানুষ নিজের  চোখের আলোর শক্তিতে মানুষ হয়ে উঠুক। তবেই না মানব জন্মের সার্থকতা।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

news24bd.tv নাজিম