সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৫-৯, উদাসিনতা থেকে মুক্তি ও সৃষ্টিরহস্য

সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৫-৯, উদাসিনতা থেকে মুক্তি ও সৃষ্টিরহস্য

অনলাইন ডেস্ক

সূরা ইয়াসিনের পবিত্র কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এই সূরার প্রথমে বর্ণিত দুই মুকাত্তায়াত হরফের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরায় রয়েছে ৮৩টি আয়াত।

সূরা ইয়াসিনে বিশ্বাসগত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এর আগে এই সূরার ১-৪ আয়াত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আজ ৫ থেকে ৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

تَنْزِيلَ الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ (5) لِتُنْذِرَ قَوْمًا مَا أُنْذِرَ آَبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ (6)

“(কুরআন) পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।

“যাতে আপনি এমন এক জাতিকে সতর্ক করেন, যাদের পূর্ব পুরুষগণকে সতর্ক করা হয়নি। ফলে তারা গাফেল বা উদাসিন। ”

ইয়াসিনের আজকের এই দুই আয়াতের মধ্যে পঞ্চম আয়াতে বলা হচ্ছে: কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম; রাসূলের কোনো বক্তব্য নয়। বিশ্বনবীর মুখ থেকে এই কুরআনের বাণী শোনা গেলেও এর সঙ্গে তাঁর অন্যান্য কথাবার্তার পার্থক্য রয়েছে। হাদিস গ্রন্থগুলোর দিকে তাকালে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূলের মুখনিসৃত হাদিসগুলোর ভাষার সঙ্গে কুরআনে কারিমের ভাষার পার্থক্য স্পষ্ট।

পরের আয়াত অর্থ্যাৎ ৬ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষকে সতর্ক করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যাতে তারা উদাসিনতা থেকে মুক্তি পেয়ে সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে জানতে পারে। এই সৃষ্টিরহস্য জানতে না পারলে মৃত্যুর পরে যে মানুষের চিরস্থায়ী জীবন শুরু হবে সে সম্পর্কে মানুষ বেখবর থেকে যাবে।

এই আয়াতে আরব উপত্যকায় নবীজী (সা.)কে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হচ্ছে: এই অঞ্চলে তার আগে আরবদের মধ্য থেকে কোনো প্রখ্যাত নবী পাঠানো হয়নি। অবশ্য কুরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে সব সময়ই এমন কেউ না কেউ ছিলেন যিনি সবাইকে আল্লাহ ও পরকাল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু হযরত ঈসা (আ.)-এর অন্তর্ধানের পর থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০০ বছরে আরব উপত্যকায় কোনো প্রখ্যাত নবীর আবির্ভাব ঘটেনি।

এই দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১. মহান আল্লাহ সমস্ত পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর অধিকারী। তিনি একদিকে ক্ষমতাবান ও মহাপরাক্রমশালী এবং অন্যদিকে দয়ালু ও মেহেরবান।
২. মানুষকে উদাসীনতার হাত থেকে রক্ষা করে পারলৌকিক জীবনের ব্যাপারে সতর্ক করা ছিল সব নবী-রাসূলের প্রধান কর্তব্য।

সূরা ইয়াসিনের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: لَقَدْ حَقَّ الْقَوْلُ عَلَى أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (7)
“নিঃসন্দেহে তাদের অধিকাংশের জন্যে শাস্তির বিষয় অবধারিত হয়েছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না। ”

এই আয়াতে বলা হচ্ছে: বেশিরভাগ মানুষই নবী-রাসূলদের সতর্কবাণীর প্রতি কর্ণপাত করে ঈমান আনে না। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের ভ্রুক্ষেপহীন মানুষদের জন্য পরকালে আল্লাহর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জন্য তওবার দরজা খোলা রেখেছেন। যারা মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হলেও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং অতীত কৃতকর্মের জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ক্ষমা করে দিতেও পারেন। মনে রাখতে হবে তওবা করতে হবে মৃত্যুর ফেরেশতাকে দেখার আগে। মৃত্যুর আলামত চোখের সামনে ভেসে ওঠার পর তওবা কবুল হবে না। কিন্তু যারা সমাজে শিরক ও কুফরের ধারক ও বাহক হিসেবে বহু মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে তাদের জন্য তওবার সুযোগ পাওয়া কঠিন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. ধার্মিকতার ব্যাপারে মানুষের সংখ্যা মুখ্য বিষয় নয়। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ যদি আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, বেশিরভাগ মানুষ সঠিক পথে রয়েছে। একজন ঈমানদার ব্যক্তি যদি মুমিনের সংখ্যা অনেক কম দেখতে পায় তাহলে তার হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

২. অদৃশ্যের প্রতি উদাসীনতা মানুষকে কুফরের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন


বঙ্গবন্ধু শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন : প্রধানমন্ত্রী

শিশুশ্রম একটি জাতীয় সমস্যা : রাষ্ট্রপতি

চীন ইসলামকেই মুছে ফেলতে চায় : অ্যামনেস্টির রিপোর্ট

এবার টকশোতেই এমপিকে চড় (ভিডিও)


সূরা ইয়াসিনের ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلَالًا فَهِيَ إِلَى الْأَذْقَانِ فَهُمْ مُقْمَحُونَ (8) وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لَا يُبْصِرُونَ (9)

“আমি তাদের গর্দানে চিবুক পর্যন্ত বেড়ী পরিয়েছি। ফলে তাদের মস্তক উর্দ্ধমুখী হয়ে গেছে। ”
“আমি তাদের সামনে ও পিছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদের দৃষ্টিকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা কোনো কিছু দেখতে পায় না। ” 

এই আয়াতে দুনিয়া ও আখেরাতে কাফেরদের কৃতকর্মের শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। কিয়ামতের শাস্তির বর্ণনায় জাহান্নামীদের হাত পা ও গলায় লোহার শেকল বা বেড়ী পরানোর কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, তাদের গলায় এমনভাবে বেড়ী পরানো থাকবে যে তারা মাথা নাড়াতে পারবে না। আগুনে পোড়ার কষ্টের পাশাপাশি এটি হবে তাদের জন্য চরম অপমান। এরা পার্থিব জীবনে সামনে ও পেছনে সত্য খুঁজে পাওয়ার অসংখ্য নিদর্শনকে উপেক্ষা করেছিল। তারা সৃষ্টির উৎসমূল আল্লাহকে যেমন দেখতে পায়নি তেমনি সৃষ্টির শেষ অর্থাৎ কিয়ামতকেও উপেক্ষা করেছে। পার্থিব জীবনে সত্য না দেখার কারণে কিয়ামতের দিন তাদেরকে অন্ধভাবে উঠানো হবে। আখেরাতে দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মগুলো ভিন্ন আকৃতিতে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করবে। দুনিয়ায় মানুষ যত খারাপ কাজই করুক না কেন তার ফলাফল হয়ত মানুষ উপলব্ধি করে কিন্তু খারাপ কাজের কুৎসিত চেহারাটা প্রকাশ পায় না। কিন্তু কিয়ামতের দিন মন্দ কর্মশীল বান্দারা দুনিয়ার কৃতকর্মের আকৃতি নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। যারা পৃথিবীতে চোখ থাকা সত্ত্বেও সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেনি তারা প্রকৃতপক্ষ অন্ধের মতো আচরণ করেছে। তাই কিয়ামতের দিন তাদেরকে অন্ধ করে আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. কিয়ামতের দিনের শিকল ও বেড়ীগুলো কাফেররা আসলে দুনিয়ার জীবনেই নিজেদের হাতে পায়ে পরে নিয়েছে। পার্থিব জীবনে তারা নিজেদেরকে স্বাধীন মনে করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের ঋপুর তাড়নার কাছে বন্দি।

২. কাফেররা দুনিয়ার জীবনের তাৎক্ষণিক ভোগসম্ভার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সৃষ্টির অতীত এবং নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তারা চিন্তাভাবনা করতে রাজি নয়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের চোখের ওপর আবরণ ফেলে দিয়েছেন। তারা যেমন অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না তেমনি নিজেদের পরকালীন জীবনের ব্যাপারেও চরম উদাসীন।  

news24bd.tv আহমেদ