বাংলাদেশে উদ্ভট কথার বাজার ভালো

বাংলাদেশে উদ্ভট কথার বাজার ভালো

Other

আবু ত্বহা আদনান নামের একজন ধর্মীয় বক্তা নিখোঁজ হয়েছেন। কিছুদিন আগে ভদ্রলোকের একটি ওয়াজের ভিডিও, আমাকে এক পাঠক পাঠিয়েছিলেন, এবং আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। কৌতূহলবশত আমি তার কয়েকটি ভিডিও দেখি, এবং এগুলোর বিরোধীতা করে কয়েক লাইনের প্রতিক্রিয়া লিখি। এ নিয়ে ভদ্রলোকের ভক্তরা আমাকে আক্রমণ করেছিলেন।

ভদ্রলোক স্পষ্ট ভাষায় আধুনিক অর্থনীতিকে হারাম বলেছেন, ভ্রান্ত যুক্তির ভিত্তিতে কাগজের টাকার বিরোধীতা করেছেন, কারেন্সি হিশেবে খেজুর ও স্বর্ণমুদ্রার প্রশংসা করেছেন, এবং সেক্যুলার ঘরানার মুসলিমদের কাফের ও মুশরিক ঘোষণা করেছেন। দাজ্জালের একটি কাল্পনিক রূপও তিনি আবিষ্কার করেছেন। ঢাকা শহরের উপর যেকোনো সময় আল্লাহর গজব নেমে আসতে পারে, এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।    

নো ওয়ান্ডার, এ উদ্ভট কথাগুলো আমার কাছে প্রলাপই মনে হয়েছে, কারণ যারা সবকিছুকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তাদের পক্ষে কোনোকিছুকেই নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

মডার্ন কারেন্সি সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, তা জানা থাকলে তিনি এগুলো বলতেন না। স্পেনিশরা যখন এজটেক বিজয় করে, তখন তারা দেখতে পায়, এজটেক শিশুরা স্বর্ণপিন্ডকে, সাধারণ পাথর হিশেবে খেলাধুলার সামগ্রীরূপে ব্যবহার করছে।

কাগজ বা স্বর্ণ নয়, কারেন্সি সিস্টেমের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কাগজের মতো স্বর্ণও মূল্যহীন, যদি না মানুষ স্বর্ণকে মূল্যবানরূপে বিশ্বাস করে। যদি মানুষ আগামীকাল থেকে বলে, স্বর্ণের উপর আমাদের আর বিশ্বাস নেই, স্বর্ণকে আমরা আর মূল্যবান মনে করি না, আমরা মূল্যবান মনে করি লোহা বা কপারকে, স্বর্ণের চেয়ে এলুমিনিয়ামের অলংকারই ভালো, তাহলে পরশু থেকেই স্বর্ণ, একটি সাধারণ ধাতুতে পরিণত হবে।

মানুষ একসময় বিশ্বাস করতো শামুকের খোল বা কাওয়ারি শেল মূল্যবান। এই কাওয়ারি শেল দীর্ঘদিন মুদ্রা হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। কিন্তু এটি ভেঙে যেতো, এবং বস্তায় করে সারাক্ষণ বহন করা সহজ ব্যাপার ছিলো না। এজন্য একসময় উদ্ভব ঘটেছিলো ধাতব মুদ্রার। এই ধাতব মুদ্রাদের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো, কারণ ধাতু হিশেবে স্বর্ণ ছিলো দুর্লভ, এবং সহজে নষ্ট হতো না।

আর স্বর্ণমুদ্রা মোটেই মুসলিমদের কোনো আবিষ্কার নয়। কাগজের মুদ্রার মতো স্বর্ণমুদ্রাও বিধর্মীদের আবিষ্কার।

ভারতে তো একসময় স্বর্ণের কোনো দামই ছিলো না। পারস্যের সাথে যখন তারা ব্যবসা শুরু করলো, তখন পারসিয়ানরা, সিল্কের বিনিময় মূল্য হিশেবে স্বর্ণ চাইলো। কারণ, স্বর্ণ ভারতে মূল্যবান না হলেও মূল্যবান ছিলো পারস্যে। এর কারণ বিশ্বাস। পারসিয়ানরা শামুকের খোলের মতো স্বর্ণের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো। আর ভারতীয়রা ভাবতো— পারসিয়ানরা এতো বোকা কেন? ফালতু স্বর্ণের বিনিময়ে এরা আমাদের মূল্যবান সিল্ক দিচ্ছে!

যাইহোক, বাংলাদেশে উদ্ভট কথার বাজার ভালো। এগুলো অনেকেই বিশ্বাস করেন, কেউ যাচাই বাছাই করে দেখার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। আমি এসব বলা বা বিশ্বাস করার স্বাধীনতা নিয়ে এখানে প্রশ্ন তুলছি না, কিন্তু কিছু ব্যাপার আছে যা আমার কাছে সবসময়ই আপত্তিকর মনে হয়। যেমন, কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে যদি আপনি কাফের, মুশরেক, মুরতাদ, ইহুদিদের দালাল, নাসারাদের দালাল, জঙ্গী, এসব ট্যাগ দিয়ে দেন, তখন ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।

আমি ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কারও জীবন বিপন্ন করে তোলাকে সমর্থন করি না। আমি মানুষকে ভয় দেখানোও সমর্থন করি না। সভ্য দেশ হলে এসব নিয়ে নির্বিকার থাকা যেতো, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধর্মীয় ফ্যানাটসিজমকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

এসব ফ্যানাটিসিজমকে রুখে দেয়ার সভ্য উপায় হলো এগুলোর বিরুদ্ধে লিখা ও কথা বলা, যা খুবই বিপজ্জনক কাজ। আমি লেখালেখি করি অনেক বছর ধরে, কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহ এসব ফ্যানাটিসিজমের বিরুদ্ধে লিখেই নানা উপাধি পেয়ে গেছি। আমি শুধু মানুষকে সাবধান করেছিলাম যে, ধর্মকে যারা নিজ নিজ রাজনীতিক ও অর্থনীতিক স্বার্থে ব্যবহার করে, তাদের কথা সতর্কতার সাথে আমলে নিতে। কিন্তু এ সামান্য কথাতেই মানুষ খেপে উঠেছিলো।

এখন প্রশ্ন হলো, কথার জবাব কথা দিয়ে না দিয়ে, লেখার জবাব লেখা দিয়ে না দিয়ে, কাউকে নিখোঁজ করে ফেলাটা সঠিক কি না?

উত্তর হলো, আমার কোনো শত্রুকেও আমি গুম করা সমর্থন করি না। আদনান সাহেবকে কে বা কারা কী কারণে নিখোঁজ করেছে তা আমরা জানি না। শুধু অনুমান করতে পারি মাত্র। যদি মনে হয় আদনান সাহেব কোনো অপরাধ করেছেন, বা কারও জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থানীয় আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এজন্য স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়া হলো, তাকে প্রকাশ্যে আইনি প্রক্রিয়া মেনে গ্রেপ্তার করা, এবং আদালতে প্রেরণ করা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে, সেটিরও স্ট্যান্ডার্ড প্রসেজার আছে। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করলে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। কিন্তু একজন নাগরিককে, গোপনে নিখোঁজ করা, অত্যন্ত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।

আবার এমনও হতে পারে, তার কোনো বিরোধী পক্ষ তাকে নিখোঁজ করেছে। সবই অনুমান মাত্র। কিন্তু পুলিশকে এসব অনুমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, এবং তাকে উদ্ধার করতে সামর্থ্যের সবটুকু প্রয়োগ করতে হবে।

কারও বক্তব্যের সাথে আমার দ্বিমত থাকতে পারে, কাউকে আমার কাছে উন্মাদ মনে হতে পারে, কিন্তু তার কোনো মৌলিক অধিকারের হরণ আমার পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়। কেউ আমার শত্রু হলেও, আমি তার উপর সংগঠিত কোনো অন্যায়কে উপভোগ করি না।

আর ওয়াজ-মাহফিলের যারা ভক্ত, তাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। অপ্রয়োজনীয় ধর্মীয় বয়ান, যা ঘৃণা-বিদ্বেষ ও মারদাঙ্গাকে উৎসাহিত করে, যা স্রেফ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা রাজনীতিক ও অর্থনীতিক মতবাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার প্রচার করে, তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে।


আরও পড়ুন:


তিন সঙ্গীসহ তিনদিন নিখোঁজ ধর্মীয় বক্তা আদনান

মধ্যগগণে ক্রু-যাত্রীদের ধ্বস্তাধস্তি, বিমানের জরুরি অবতরণ

চতুর্থ বিয়ের মধুচন্দ্রিমায় পাহাড়ে যেতে চান শ্রাবন্তী?

দায়িত্ব গ্রহণ করেই যে প্রতিশ্রুতি দিলেন ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী


মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা শুধু মুসলিমদের জন্য নয়। সব ধর্মের, সব মতের মানুষ যেন শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে হবে। নিজের মত, নিজের বিশ্বাস, কারও উপর চাপিয়ে দেয়া কোনো ভালো কাজ নয়। কারও কোনো কথা আমলে নেয়ার আগে, আবেগের পরিবর্তে যুক্তির মানদন্ডটিকে একটু ব্যবহার করতে হবে।

আবু ত্বহার পরিবার যে দুর্ভোগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে, তার দ্রুত অবসান হোক।

(এই লেখাটি ফেইসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের। স্যোশাল মিডিয়া পাতায় প্রকাশিত লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv / নকিব