পরীমনি এবং....

পরীমনি এবং....

Other

জাঁ জ্যাক রুশো ১৭৬১ এ-র দিকে ‘জুলি বা ল্য নোভেল এলোইজ’ নামে একটি উপন্যাস লিখেন। সেখানে তিনি নারীর প্রকৃতি, ভুমিকা, অবস্থা নির্দেশ ও ব্যাখা করেন। রুশোর দর্শনে নারী হবে সুন্দরী, প্রেমপূর্ণ তবে অযৌন ও শীতল সতী। নারী পরিপূর্ণ থাকবে লাজনম্র সতীত্বে।

নারী আবেদনময়ী হবে কিন্তু সবার জন্য নয় শুধু স্বামীর জন্য। তার মতে সতীত্বের উপর কোনো গুণ থাকতে পারে না। সঠিক পিতৃত্বের ব্যাপারে তিনি তার দর্শন চর্চায় খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে রুশো নিজে ছিলেন কামার্ত ও অনেক অবৈধ সন্তানের দায়িত্বহীন জনক।

সাম্প্রতিক পরীমনি কাণ্ডে আমাদের মধ্যে অনেকে আছি যারা পরীমনির নাচ উপভোগ করি, তার সিনেমা দেখে ফ্যান্টাসিতে ভুগী,  নিদেন পক্ষে পরীমনির লাস্যময়ী ছবি জুম করে দেখে-টেখে  মন্তব্যের ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড অশ্লীলভাবে ট্রিট করে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করছি।   এই ব্যাপারটির মধ্যে কেমন জানি একটা ‌‘রুশো রুশো’ গন্ধ আছে।

চর্চিত সংস্কৃতির কথা বলে, যাপিত প্রণালীর দোহাই দিয়ে কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ কোনো দিক থেকেই এটা করার সুযোগ নাই। ইসলামে অপ্রয়োজনে কোনো নারীর ছবি দেখা, নাচ-গান উপভোগ করা কিংবা কল্পনাতেও কিছু  আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রশ্ন আসতে পারে, সবাই তাকে এসবের কোনোভাবেই দেখছেন না শুধু তার কাজের জন্য গালি দিচ্ছেন। তাহলে শুনুন। ইসলামে অন্যকে গালি দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যেকোনো কারণেই হোক, কাউকে গালি দেওয়ার অনুমতি নেই।

হাদিসে আছে, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপদাতা, অশ্লীলভাষী ও গালিগালাজকারী হয় না। (তিরমিজি, হাদিস নং : ২০৪৩)।

যারা মনে করছেন এ ধরনের কাজ করে ‘জিহাদ’ করার মতো অশেষ নেকি হাসিল করে ফেলছেন তারা একটি জীবন ব্যাবস্থাকে অন্যদের নিকট হাস্যকরূপে উপস্থাপন করছেন। অথচ ইসলাম  কোনোভাবেই তার অনুমোদন দেয় না।   ইসলাম আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর কোনো ধর্ম নয়। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিষয়ে ইসলামের ইন্টারফেয়ারেন্স থাকে এবং তা একদম সুস্পষ্টভাবে। সুতরাং পরীমনির বিষয়ে এত সিরিয়াস না-হয়ে নিজের বিষয়ে ভাবি।

আরও পড়ুন:


যে কারণে গাজার ‘আগুনে বেলুন’কে এত ভয় ইসরাইলের

ঠাকুরগাঁওয়ে ঋণের চাপে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা

মালয়েশিয়ায় করোনায় প্রবাসীর মৃত্যু


আর যারা পরীমনির এসব ব্যাপার- স্যাপার কে আমাদের কৃষ্টি কালচারের সাথে যায় না বলে গালিগালাজ করছেন কিংবা প্রগতিশীলতার কথা বলে সাপোর্ট করছেন তাদের মধ্যেও শত শত বিভাজন বিদ্যমান। যে ধরনের জীবনবোধে অভ্যস্ত সেভাবেই আমাদের সংস্কৃতিকে দেখছেন। ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচের মতে, প্রতিটি জাতির এমন কিছু সামাজিক আবেগ আছে যার মাধ্যমে জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্যাসের আকারে পুরোমাত্রায় বিরাজমান থাকে। কিন্তু সেটা আমাদের ক্ষেত্রে  তা কখনো হয়নি।  

নারীবাদীরা বলছেন, ‘পরীমনিকে সাপোর্ট করুন নাহলে একদম চুপ থাকুন। ’ এদের কারণে কতিপয়  সাংবাদিকদের অবস্থা হয়েছে দেখার মতো।

তাদের পরীমনিকে খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, এত রাতে আপনি ওখানে কেন গিয়েছিলেন? কিনতু তা তারা করছে না কারণ এ প্রশ্ন করলে এ সাংবাদিকের  ক্যারিয়ারই শেষ করে দিবে নারীবাদীরা।

এদিকে সাধারণ জনগণ এটাকে দেখছেন আমাদের ‘যাপীত জীবনের সাথে কোনোভাবেই যায় না’ সে কনসেপ্ট থেকে। আবার যারা সো হোয়াট, ডোন্ট মাইন্ড আর খোলামেলা জীবনে অভ্যস্থ তারা বলছে, ‘অসুবিধা কি!’ আসলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে  দিনের পর দিনে এদেশে নতুন নতুন ভাবাদর্শ তরঙ্গ তুলেছে কিন্তু আমরা মনের দিক থেকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতো বারবার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছি। আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানদের মন’ এ লিখছেন, ‘অনেক কিছুর সংবাদ সে জানে কিন্তু কোন কিছুকে যুক্তি দিয়ে,মনীষা দিয়ে আপনার করতে জানে না। কোনো অসঙ্গতি দেখা দিলে গোঁজামিল দিয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়। বাঙালি মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এ কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয়  প্রয়াসকে তারা কৃষ্টি- কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না’।

যদিও সো -কল্ড  নারীবাদিদের কথাগুলোকে তেমন গুরত্ব দেওয়ার কিছু নেই তারপরেও এদের দ্বিচারিতাার নীতিটা সামনে আনার জন্য বলি। এদেরই কোনো আত্মজা, ভগিনী, মাতাকে কখনোই এরা রাত দুটোয় কোনো ক্লাবে যেতে দিবেন না। প্রকৃতিগত হোক  বা বৈষয়িক কোনো কারণেই হোক, তারা তা দেবে না। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদিতা ও ফাঁপরবাজির জন্য তারা গলা ছড়াবেই। প্র্যাকটিক্যাল প্রমানের কথাই যদি বলি, যিনি ছবি বানায় সে রকম একজন পরিচালক সোনানুর রহমানই বলছেন, পরীমনি অহরহ রাত বারটার পর বের হয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। বোঝা যাচ্ছে এ জীবনাচরণে তাদেরও প্রশ্ন আছে।

এরাই ডলি সায়নন্তির সাড়া জাগানো - জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা,
লাল শার্ট গায়ে তার বুক খোলা,
সানগ্লাস কপালে.আছে তোলা,
রাখনা কেন ঢেকে ওই দুটি চোখ,
হেই যুবক  গানে কোমর দোলালেও নিজের বোন বা কন্যা কে পাত্রস্থ করতে  ই. ইন্জিনিয়ারিংএ পি. এইচ. ডি. করা বোস্টন ফেরত ছেলেকেই খুঁজবে; ওই যুবককে নয়।

তাই ধর্মীয়ভাবে নিজের পরিশুদ্ধতার বিষয়ে যত্নবান না হয়ে আর সংস্কৃতির ধোঁয়াটে ভন্ডামি করে পরীমনির জীবনাচরণের এনাটমি বাদ দেওয়া উচিত। এটা চূড়ান্তভাবে মানুষ কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না। অন্য একটা ঘটনায় তা বোঝা যায় সহজেই। একজন ইসলামি স্কলার নিখোঁজ হওয়ায় অনেকেই তাঁর কোনো বক্তব্য না শুনেই তার জীবনাচার, মানুষকে সঠিক পথে আহবান করার প্রয়াস তাঁকে তাদের  কাছে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। এতেই তো পরীমনির জীবনাচরণের পরাজয় ঘটে গেছে। আপনি এত ‘গাইল পারেন ক্যা?’ বরং এ প্রশ্ন করুন পরীমনির জীবনাচরণে দোষ দেখলেন আর ওই স্কলারে স্বস্তি দেখলেন কোন জাস্টিফিকেশনে? উত্তর দেওয়ার আগে চেমফোর্ডের একটা কথা বলে নেই- নারীরা ফাঁসিতে ঝুলার আগেও প্রসাধনটা একটু দেখে নেয়। এটা নারীর স্বভাবজাত কিন্তু  কেউ যখন বেলেল্লাপনায় সবকিছুই উম্মুক্ত করে দেয় সেক্ষেত্রে অন্যদের কথা বলতে পারছি না তবে তা আমার ও আমার সন্তানদের  মনোজগতকে  Toxic করে নিঃসন্হেহে আর ওই স্কলারের ফিলোসোফি মানুষ হিসেবে আমার ভুলগুলো কোথায় এবং তা  রিফর্ম করার চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। উত্তরটা এখানেই।  

অতএব, নিজ নিজ আত্মার পরিশোধনের পর সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে বাস্তব জীবনে তার কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিন আর সে বার্তাটিই আপনি যার জীব।

লেখক- সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv / তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর