তাসের ঘরের সন্ধানে

তাসের ঘরের সন্ধানে

Other

আমি তখন ১ম বা ২য় শ্রেণিতে পড়ি। সময়টা সেই হিসেব ১৯৮৪ বা ৮৫ সাল হবে। আমরা থাকি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়, আব্বুর চাকুরিসূত্রে। একদিন দেখলাম, আম্মা কি যেন শব্দ করে পড়ছেন আর হাপুসনয়নে কাঁদছেন।

দুই আপা তাকে ঘিরে শুনছে আর কান্নায় সঙ্গত করছে। আমিও যোগ দিলাম-শ্রোতা, দর্শক উভয় হিসেবেই।

বিষয়টা ছিলো, বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট বা পাউরুটি আনার কাগজের ঠোঙ্গা, যা আসলে ছিলো ‘তাসের ঘর’ নামক উপন্যাসের কয়েকটা পাতা। খুবই আবেগাক্রান্ত আর বিয়োগাত্মক ছিলো এটা মনে আছে, তবে কাহিনী কী ছিলো সেটা মনে নেই।

 

কিছুক্ষণ পর শহর থেকে মেজোমামা আসলেন বেড়াতে। তিনি তখন চিটাগাং পলিটেকনিকের ছাত্র।

মামাকে, কথ্য ভাষার লাইব্রেরিতে (আসলে বইয়ের দোকান) পাঠিয়ে দেয়া হলো তাসের ঘর খুঁজে আনতে। না পেলে বেকারি থেকে আরো কিছু বিস্কুট ঠোঙ্গায় করে কিনে আনতে বলা হলো। বই মেলেনি, ঠোঙ্গায় আরো কয়েকটা পাতা এলো তাসের ঘরের। কান্নাভেজা পাঠের পুনরাবৃত্তি চললো আরেকদিন। এরপর, বেকারি থেকে পুরো বইটাই আনতে গেলে ৮/১০ পাতার মতো পাওয়া গেলো। তীব্র অতৃপ্তিতে বেশ কিছু দিন খোঁজাখুঁজি চলেছিলো। পাওয়া যায়নি। এক সময় যথারীতি সবাই ভুলে গেলেন।

মেজোমামা অনেকদিন এই পৃথিবীতে নেই; আর এই ঘটনাটাও সম্ভবতঃ আমি ছাড়া আর কারো স্মৃতিতেই অবশিষ্ট নেই। আমি ভুললাম না। মাঝেমাঝেই 'তাসের ঘর' উঁকি দেয় আমার মনের ঘরে, স্মৃতির চিলেকোঠায়।

একটু বয়েস হলে খুঁজে পেতে রবীন্দ্রনাথের "তাসের দেশ" পাই, কিন্তু 'তাসের ঘর' পাই না কিছুতেই। আরো পরে একবার রোখ চেপে গেলো। না, এই বার 'তাসের ঘর' খুঁজে বার করতেই হবে!

খোঁজ, খোঁজ, নেমে পড়লাম তাসের ঘরের সন্ধানে। না, এই নামের কোন বইয়ের হদিস পাই না। বুঝলাম, নেহাত সার্চে কাজ হবে না, রিসার্চই করতে হবে।

সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ধরনের ঢাউস মার্কা বই ধরে খুঁজতে হবে। ক'দিন পরে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এর "তাসের ঘর" নামের ছোটগল্প পেলাম। তিনি সমগ্র বাংলারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, তাঁর লেখায় ঢলঢল আবেগ থাকার কথা না। পেলামও না পড়ে। মোটে ৩ পৃষ্ঠায় শেষ নির্মেদ গল্পের ওস্তাদির। এটা ইপ্সিত "তাসের ঘর" যে না, সেটা নিশ্চিত হয়ে আগে বাড়লাম।

এরপর "তাসের ঘর" নামের সিনেমার খোঁজ পেলাম। তাতে মহানায়ক উত্তমকুমারের দ্বৈত চরিত্র। প্রচণ্ড ধনী ও সমপরিমাণ অসুখী একজনের বেকারত্বের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে যাওয়া look alike এর সাথে জীবনবদলের গল্প। এতেও আবেগ/বেদনা হাত ধরাধরি করে আছে। এই সিনেমাটাই কি 'তাসের ঘর' উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছে? তাহলে বই একটা তো থাকার উচিত। কিন্তু এ তো সিনেমা, আমারটাতো ছাপা বই। সেটা কই? এই রকম কোনো বইয়ের হদিস পাইনি।

একবার মনে হলো, এমন যদি হয় এই বইটা কোন নামগোত্রহীন লেখকের? অনেকেই তো নিজ উদ্যোগে লেখক হিসেবে নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য বই ছাপান। কেউ কেউ সিনেমার গল্প নিয়েই সস্তা বই ফেঁদে বসেন। তেমন বই হলে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি।

সর্বশেষ  রাডারে ধরা পড়লো বন্দে আলী মিয়া'র এই নামের একটা বই আছে। তিনি উঁচুমাপের বা জনপ্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন না এবং ১৯৮৪/৮৫ সালের দিকে তার বিষাদে ভরপুর কোন বই ঠোঙ্গা হিসেবে পাওয়ার সম্ভাবনা মিলিয়ে আমার মনে হলো- ইউরেকা! ইউরেকা!!

কিন্তু আমার উচ্ছ্বাসে কিছুটা জল ঢলে পড়লো যখন জানলাম যে, ওটা উপন্যাস নয় গল্পগ্রন্থ, যার একটা গল্পের নাম "তাসের ঘর"।

আবার মনে হলো, ২০/২৫ পৃষ্টার বড়্গল্পও'তো হতে পারে। কিন্তু, বন্দে আলী মিয়ার বই আজ আর বইয়ের দোকানে মেলে না। পরে জানা গেলো বাংলা একাডেমি তাঁর রচনাবলী প্রকাশ করেছে। ২য় খণ্ডে আছে "তাসের ঘর"। একুশে বইমেলায় গিয়ে কয়েকবার বাংলা একাডেমিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এটা আউট অভ প্রিন্ট অনেকদিন ধরে। রচনাবলীর ২য় খণ্ডটি এখনো সংগ্রহ করতে পারিনি...'তাসের ঘর'ও এখনো অক্ষত আছে।

আমি সেই গল্পের পাঠক নয়, শ্রোতা ছিলাম মাত্র। তাও এমন শ্রোতা, কাহিনীও যার মনে নাই! ফলে, শেষ হইয়াও শেষ না হওয়ারও ৬৫/৩৫% সম্ভাবনা আছে।

মিল্লাত হোসেন, বিচারক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv / তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক