সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৩৬-৪৪, সৃষ্টিজগতের অন্যতম মৌলিক বিধান

সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৩৬-৪৪, সৃষ্টিজগতের অন্যতম মৌলিক বিধান

অনলাইন ডেস্ক

সূরা ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এই সূরার প্রথমে বর্ণিত দুই মুকাত্তায়াত হরফের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরায় রয়েছে ৮৩টি আয়াত।

আজ এই সূরার ৩৬ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে।

এই সূরার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ (36)

“পবিত্র তিনি যিনি যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, তাদেরই মানুষকে এবং যা তারা জানে না, তার প্রত্যেককে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন। ” (৩৬:৩৬)

গত আসরে এই প্রকৃতিতে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের কিছু নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আজকের এই আয়াতে সৃষ্টিজগতের অন্যতম মৌলিক বিধান অর্থাৎ সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: প্রাণী, উদ্ভিদ ও মানুষকে যে আল্লাহ তায়ালা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন তা তোমরা জানো।

এর পাশাপাশি আল্লাহ এমন অনেক কিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন যা তোমাদের জানা নেই। সৃষ্টিতে যে আল্লাহর এত বিশাল ক্ষমতা এবং যিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করে সব সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণ করেছেন তিনি সব ধরনের অপূর্ণতা ও ত্রুটির ঊর্ধ্বে। সৃষ্টি করার জন্য তার কোনো শরিক বা সহযোগীর প্রয়োজন হয় না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. যিনি জোড়ায় জোড়ায় সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তার কোনো জোড়া বা শরিকের প্রয়োজন নেই। তিনি একক এবং তাঁর কোনো শরিক নেই।

২. শারিরীক চাহিদা ও প্রবৃত্তির দিক দিয়ে মানুষ অন্য সব সৃষ্টির সমান এবং এদিক দিয়ে তার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

৩. মানুষের জ্ঞান সীমিত এবং এখনো সৃষ্টিজগতের বহু রহস্য তার জানতে বাকি রয়েছে।

সূরা ইয়াসিনের ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَآَيَةٌ لَهُمُ اللَّيْلُ نَسْلَخُ مِنْهُ النَّهَارَ فَإِذَا هُمْ مُظْلِمُونَ (37) وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (38) وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ (39) لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ (40)

“তাদের জন্য আরেক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে অপসারণ করি, তখনই তারা (নিজেদের অজান্তে) অন্ধকারে তলিয়ে যায়। ” (৩৬:৩৭)  

“এবং সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর বিধান (ও পরিমাপ) অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। ” (৩৬:৩৮)

“এবং চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারণ করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে যায় (এবং ক্রমেই পূর্ণ চন্দ্রে পরিণত হয়)। ” (৩৬:৩৯)

“না সূর্য নাগাল পেতে পারে চন্দ্রের, না রাত্রি অগ্রে চলে দিনের এবং প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। ” (৩৬:৪০)

এই চার আয়াতে আকাশে সূর্য ও চন্দ্রের আবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোকে মহান আল্লাহ নির্ধারিত কক্ষপথে এবং নির্দিষ্ট গতিতে স্থাপন করে দিয়েছেন। মানুষ রাত ও দিনে নিজেদের চোখে চন্দ্র ও সূর্যকে দেখতে পায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী সার্বক্ষণিকভাবে যার যার কক্ষপথে আবর্তন করে এবং কখনোই পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না এবং কখনো এই আবর্তনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না।   আমাদের এই পৃথিবীর পৃষ্ঠ অন্ধকারে পরিপূর্ণ এবং এর নিজস্ব কোনো আলো নেই।   পৃথিবীর যে অর্ধাংশে সূর্যের আলো পতিত হয় সেই অংশ কেবলমাত্র আলোকিত হয়। কিন্তু নিজ অক্ষের ওপর পৃথিবীর ঘুর্ণয়নের ফলে ওই অংশ ধীরে ধীরে সূর্য থেকে দূরে চলে যায় এবং সেখানে রাতের অন্ধকার নেমে আসে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অন্ধকারও যেন ঘুটঘুটে না হয় সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা। তিনি চন্দ্র নামক একটি আয়নাকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে স্থাপন করেছেন যার ওপর সূর্যের আলো নিক্ষিপ্ত হয়ে তার প্রতিবিম্ব পৃথিবীতে এসে পড়ে। চাঁদের এই মিটিমিটি আলো রাতের অন্ধকারে মানুষকে প্রশান্তি দেয় যাতে সে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর ঘুর্ণয়ণ এবং রাত ও দিনের সৃষ্টি মহান আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

২. নিজ নিজ কক্ষপথে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর আবর্তন সুনির্দিষ্ট ও সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশের ফসল যা কেবল মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার পক্ষেই সম্ভব। দৈবক্রমে এমন সুবিন্যস্ত প্রকৃতি সৃষ্টি হয়নি।

৩. ক্ষুদ্রাকৃতির চাঁদের ক্রমেই পরিপূর্ণ চাঁদ হয়ে ওঠা আল্লাহ তায়ালার একটি মহান নিদর্শন। কুরআনে কারিমের অন্যত্র বলা হয়েছে, দিন, মাস ও বছর গণনার জন্য মহান আল্লাহ এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন


পটিয়া আওয়ামী লীগ নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ, ভেঙে দেওয়া কমিটি পুনর্বহালের দাবি

ভারতকে উড়িয়ে টেস্টের রাজা নিউজিল্যান্ড

আ.লীগের ওপর যতবার আঘাত এসেছে, ততবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে: প্রধানমন্ত্রী

মহাসড়কে যেভাবে ছিনতাই করতো বুস্টার গ্যাং


এই সূরার ৪১ থেকে ৪৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে:

وَآَيَةٌ لَهُمْ أَنَّا حَمَلْنَا ذُرِّيَّتَهُمْ فِي الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ (41) وَخَلَقْنَا لَهُمْ مِنْ مِثْلِهِ مَا يَرْكَبُونَ (42) وَإِنْ نَشَأْ نُغْرِقْهُمْ فَلَا صَرِيخَ لَهُمْ وَلَا هُمْ يُنْقَذُونَ (43) إِلَّا رَحْمَةً مِنَّا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ (44)

“এবং তাদের জন্যে আরেকটি নিদর্শন এই যে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিকে পণ্যবোঝাই জাহাজে আরোহণ করিয়েছি। ” (৩৬:৪১)     

“এবং তাদের জন্যে জাহাজের অনুরূপ যানবাহন সৃষ্টি করেছি, যাতে তারা আরোহণ করে। ” (৩৬:৪২)

“আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে নিমজ্জিত করতে পারি, তখন তাদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই এবং তারা পরিত্রাণও পাবে না। ” (৩৬:৪৩)  

“কিন্তু আমারই পক্ষ থেকে (আরেকবার তাদের জন্য) কৃপা (প্রদর্শন) এবং তাদেরকে (আরো) কিছু কাল জীবনে উপভোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তা করি না। ” (৩৬:৪৪)

এই চার আয়াতে সাগর ও মহাসাগরের কিছু ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: যেসব জাহাজ সাগরে চলাচল করে এবং মানুষ ও মালামাল পরিবহন করে তাতেও আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন রয়েছে। কারণ তিনি এমনভাবে জলরাশি সৃষ্টি করেছেন যাতে জাহাজের আরোহীরা পানিতে ডুবে না গিয়ে দূর-দূরান্তের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য বর্তমানে ট্রেন ও বিমানসহ নানা ধরনের আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আজও সবচেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন করা হয় জাহাজের মাধ্যমে।   বর্তমানে খাদ্য ও জরুরি পণ্যের পাশাপাশি তেল ও তরল গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ যদি জাহাজে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নেয়া না যেত তাহলে মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। যদি আল্লাহ তায়ালা জাহাজ ভাসিয়ে রাখার ব্যাপারে পানির এ বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য তুলে নেন তাহলে সব জাহাজ তলিয়ে যাবে এবং তখন এসব জাহাজের যাত্রীদেরকে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হচ্ছে:

১. ভূপৃষ্ঠ ও সাগরে চলাচলকারী নানা ধরনের বাহন মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়। এসব বাহন চলাচলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির শুরুতেই তৈরি করে রেখেছেন।

২. আল্লাহ আমাদেরকে যত নেয়ামত দান করেছেন তার সবগুলোকে মহান প্রভুর দান মনে করতে হবে। এর কোনোটিই আমরা তাঁর কাছ থেকে চেয়ে পাইনি, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আল্লাহ দান করেছেন। কাজেই আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে যেন অহঙ্কার না করি কারণ তাতে আল্লাহর মহাক্রোধের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।

news24bd.tv এসএম