সূরা ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এই সূরার প্রথমে বর্ণিত দুই মুকাত্তায়াত হরফের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরায় রয়েছে ৮৩টি আয়াত।
আজ এই সূরার ৫৯ থেকে ৬৫ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:وَامْتَازُوا الْيَوْمَ أَيُّهَا الْمُجْرِمُونَ (59)
“হে অপরাধী ও গোনাহগাররা! আজ তোমরা (সৎকর্মশীল লোকদের থেকে) আলাদা হয়ে যাও। ” (৩৬:৫৯)
আমরা এর আগের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছি যে, সেখানে জান্নাতে মুমিন ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জান্নাতে তারা পূর্ণ শারিরীক সুস্থতায় ও চরম মানসিক প্রশান্তিতে অবস্থান করবেন।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
১. কিয়ামত হচ্ছে বিশ্বাস ও কর্মের ভিত্তিতে মানুষের আলাদা হয়ে যাওয়ার দিবস। সেদিন যেমন বহু পিতামাতা তাদের সন্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে তেমনি অনেক দূরের মানুষ জান্নাত ও জাহান্নামে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসবে।
২. পুণ্যবান ও পাপী ব্যক্তিদের পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বহুবার দিয়েছেন কিয়ামতের দিন সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।
সূরা ইয়াসিনের ৬০ থেকে ৬২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آَدَمَ أَنْ لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ (60) وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ (61) وَلَقَدْ أَضَلَّ مِنْكُمْ جِبِلًّا كَثِيرًا أَفَلَمْ تَكُونُوا تَعْقِلُونَ (62)
“হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেইনি যে, শয়তানের এবাদত (বা আনুগত্য) করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?” (৩৬:৬০)
“এবং আমার এবাদত কর। এটাই সরল পথ?” (৩৬:৬১)
“কিন্তু শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বোঝনি?” (৩৬:৬২)
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার দরবারে উপস্থিত গোনাহগার বান্দারের উদ্দেশ করে এই কথা বলা হবে। এসব মানুষকে পুণ্যবান ও সৎকর্মশীল বান্দাদের কাছ থেকে আলাদা করে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করার পর এই প্রশ্ন করা হবে। মহান আল্লাহ অত্যন্ত ধমক ও ভর্ৎসনার স্বরে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, তোমরা কেন আমার নির্দেশ উপেক্ষা করে শয়তানের আনুগত্য করেছিলে?
এখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে একটি প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। সৃষ্টির শুরুতে তিনি মানুষের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। আদি পিতা হযরত আদম ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া যখন শয়তানের ধোকায় পড়ে যান তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা কেন শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে যা খেতে নিষেধ করেছিলাম তা খেয়ে ফেলেছো? তোমরা কি জানো না যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?
বিবেক ও সহজাত প্রবৃত্তির ভিত্তিতে মানুষ জানে যে, খারাপ কাজ তার চরিত্রের সঙ্গে মানায় না এবং যে কেউ তাকে খারাপ কাজের দিকে আহ্বান করে সে যদি মানুষও হয়ে থাকে তাহলে সে শয়তানের কাজই করছে। মানুষের সুস্থ প্রবৃত্তি তাকে সব সময় খারাপ কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের আহ্বান জানায়।
শুধু মানুষের প্রবৃত্তি বা বিবেক নয় সেইসঙ্গে অতীত জাতিগুলোর পরিণতির দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখা যায়, বহু জাতি শয়তানের পথ অবলম্বন করে মন্দ কাজ করার কারণে চরম পরিণতি ভোগ করে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা যদি এ ধরনের মানুষের জীবন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে উপলব্ধি করব যে, তারা সমাজে প্রচলিত কুসংষ্কারের অন্ধ অনুসরণ করে এবং পথভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন মানুষকে অনুসরণ করতে গিয়ে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. মহান আল্লাহ মানুষকে সহজাত প্রবৃত্তি, আকল বা বিবেক প্রদান এবং তার কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়ে এই প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন যে, সে যেন কোনো অবস্থায় শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে।
২. আনুগত্যের দিক দিয়ে সব মানুষ দু’টি ভাগে বিভক্ত। হয় সে আল্লাহর আনুগত্য করছে অথবা শয়তানের আনুগত্য করছে। এর বাইরে তৃতীয় কোনো দল নেই।
৩. আমরা প্রতিটি নামাজে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় আল্লাহর কাছে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথে পরিচালিত হওয়ার আবেদন জানাই। সূরা ইয়াসিনের এই ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তাঁর আনুগত্য ও ইবাদতের পথই হচ্ছে সরল পথ।
আরও পড়ুন
লকডাউনে খোলা থাকবে পোশাক কারখানা
১ জুলাই থেকে সব সরকারি অফিস বন্ধ
প্রথমে সীমিত এরপর সর্বাত্মক লকডাউন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম আর নেই
এই সূরার ৬৩ থেকে ৬৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন:
هَذِهِ جَهَنَّمُ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (63) اصْلَوْهَا الْيَوْمَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ (64) الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (65)
“এই সেই জাহান্নাম, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হতো। ” (৩৬:৬৩)
“তোমাদের কুফরের কারণে আজ এতে প্রবেশ করো (এবং এর আগুনে জ্বলতে থাকো)। " (৩৬:৬৪)
“আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে। ” (৩৬:৬৫)
আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিন গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতির কথা বর্ণনা করার পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা যে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরস্কার ও গোনাহগার বান্দাদের শাস্তি দেবেন সেকথা নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে সুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বহু মানুষ আল্লাহর সে প্রতিশ্রুতির কথা বিশ্বাস করেনি এবং বিষয়টিকে তারা উপহাসের পাত্র বানিয়েছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের চোখে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে পাবে। সেদিন তারা শুধু জাহান্নাম দেখতেই পাবে না সেইসঙ্গে জাহান্নামে প্রবেশ করে এর ভয়াবহ শাস্তিও আস্বাদন করবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার আদালতে অপরাধী ব্যক্তিদের অপরাধ স্বীকার বা অস্বীকার করার জন্য কথা বলার কোনো প্রয়োজন হবে না। কারণ, সেদিন মানুষের মুখের পরিবর্তে হাত ও পা’সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কথা বলতে শুরু করবে। তারা পাপী ব্যক্তির সব কৃতকর্মের কথা অবলীলায় আল্লাহর সামনে বলতে থাকবে।
এই তিন আয়াত থেকে আমরা শিখতে পারি:
১. নবী-রাসূলগণ সকল মানুষের কাছে তাদের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন।
২. মানুষের কথা বলার অঙ্গ মুখ কিয়ামতের দিন বন্ধ হয়ে যাবে এবং মুখের পরিবর্তে হাত ও পা কথা বলবে।
৩. মানুষের প্রতিটি অঙ্গের উপলব্ধি করার ক্ষমতা রয়েছে। তাদেরকে ব্যবহার করে মানুষ যা কিছু করে তা তারা মনে রাখে এবং এসব কাজের কথা তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার সামনে বলে দেবে।
news24bd.tv এসএম