সূরা ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এই সূরার প্রথমে বর্ণিত দুই মুকাত্তায়াত হরফের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরায় রয়েছে ৮৩টি আয়াত।
আজ এই সূরার ৬৬ থেকে ৭০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:وَلَوْ نَشَاءُ لَطَمَسْنَا عَلَى أَعْيُنِهِمْ فَاسْتَبَقُوا الصِّرَاطَ فَأَنَّى يُبْصِرُونَ (66) وَلَوْ نَشَاءُ لَمَسَخْنَاهُمْ عَلَى مَكَانَتِهِمْ فَمَا اسْتَطَاعُوا مُضِيًّا وَلَا يَرْجِعُونَ (67)
“আমি ইচ্ছা করলে তাদের দৃষ্টি শক্তি বিলুপ্ত করে দিতে পারি, তখন তারা রাস্তায় (পরস্পরের আগে) দৌড়ে যেতে চাইলে কেমন করে দেখতে পাবে?” (৩৬:৬৬)
“আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্ব স্ব স্থানে আকার বিকৃত করতে পারি, ফলে তারা আগেও চলতে পারবে না এবং পেছনেও ফিরে যেতে পারবে না। ” (৩৬:৬৭)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর শাস্তি যে শুধু কিয়ামতের দিন দেয়া হবে তা নয়। তিনি চাইলে এই পৃথিবীতেও অপরাধী ও পাপী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে পারেন।
একইভাবে মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে প্রাণহীন মূর্তিতে পরিণত করে দিতে পারেন। এতে করে তারা আর নড়াচড়া করতে পারবে না। তাদের পক্ষে সামনে যাওয়া যেমন সম্ভব হবে না তেমনি তারা পেছনেও ফিরতে পারবে না।
কিয়ামতের দিনও এ ধরনের শাস্তি থেকে থাকতে পারে। ফলে সেখানে অপরাধী ও পাপী ব্যক্তিরা জান্নাতের পথে চলতে অক্ষম হয়ে পড়বে এবং কিয়ামতের ভয়ঙ্কর ময়দানে হতচকিত ও হতবিহ্বল অবস্থায় পড়ে থাকবে। তাদের পক্ষে আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না।
এই দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- এই পার্থিব জীবনেও মানুষ আল্লাহর ক্রোধের আওতার বাইরে নয়। কাজেই আমরা যেন সেই শাস্তিতে পড়ে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কার কথা কখনো ভুলে না যাই।
২- আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনে বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া কাউকে শাস্তি দেন না। মানুষ যাতে স্বাধীনভাবে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ অবলম্বন করতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অপরাধ করার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেয়া হলে কোনো মানুষ অপরাধ করত না।
সূরা ইয়াসিনের ৬৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَمَنْ نُعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ أَفَلَا يَعْقِلُونَ (68)
"আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি, তাকে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেই (অর্থাৎ তার স্মৃতিশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও প্রাণশক্তি লোপ পায়)। তবুও কি তারা চিন্তা করে না?" (৩৬:৬৮)
আগের আয়াতে পার্থিব জীবনের শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: সব মানুষ বৃদ্ধাবস্থায় শারিরীক ও চিন্তাশক্তির দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে আবার শিশু অবস্থায় ফিরে যায়। কাজেই আমরা যদি ঈমানদার হতে ও সৎপথ অবলম্বন করতে চাই তাহলে যৌবনে বা অন্তত মধ্যবয়সের মধ্যেই তা করতে হবে। ‘বয়স হলে ভালো হয়ে যাব’ এটি যে একটি অবান্তর ধারণা তা এই আয়াতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন মহান আল্লাহ।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ যেন একথা না ভাবে যে, অনেক দিন বেঁচে থাকলে তার শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। প্রবল প্রতাপশালী রাজা-বাদশাদেরকেও বৃদ্ধ বয়সে অন্য কেউ খাইয়ে দয়ে এবং অন্য কেউ তাদের পোশাক পরিবর্তন করে দেয়। শারিরীক এই দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ওঠা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই বৃদ্ধাবস্থা চলে আসার আগেই আমাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত মূল্যবান সময়কে কাজে লাগিয়ে বেশি বেশি আমলে সালেহ বা সৎকাজ করতে হবে। এর ফলে আমরা যেমন নিজেদের পারলৌকিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারব তেমনি সমাজও আমাদের দ্বারা উপকৃত হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ তার শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া নয়। বয়স যত বেশি হবে মানুষের শক্তি ও কর্মক্ষমতা তত কমে যাবে।
২- মানুষের আয়ু যত কম তার আকাঙ্ক্ষা তত বেশি। তবে এই জীবনে সেই মানুষ সফল যে তার ক্ষণকালীন আয়ুকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সৎকাজে ব্যবহার করেছে। বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত করেছে।
৩- যৌবনকাল মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়। একজন মানুষ পরকালে জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার যৌবনকালেই নির্ধারিত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
অযথা ঘোরাঘুরি করলেই গ্রেপ্তার, হতে পারে ৬ মাসের জেল ও অর্থদণ্ড
কঠোর অবস্থানে প্রশাসন, মাঠে থাকবে শতাধিক ম্যাজিস্ট্রেট
প্রেমের অপরাধে পরিবারের ৫ জনকে পুড়িয়ে মাটিচাপা দিল বাড়িওয়ালা!
সূরা ইয়াসিনের ৬৯ ও ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَا عَلَّمْنَاهُ الشِّعْرَ وَمَا يَنْبَغِي لَهُ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآَنٌ مُبِينٌ (69) لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ (70)
“আমি (কখনোই) রাসূলকে কবিতা শিক্ষা দেইনি এবং এটা তার জন্য শোভনীয়ও নয়। এই (কিতাব) উপদেশ ও সুস্পষ্ট কুরআন ছাড়া আর কিছু নয়। ” (৩৬:৬৯)
“যাতে তিনি সতর্ক করেন তাকে যার অন্তর জীবিত এবং যাতে কাফেরদের সম্পর্কে (আল্লাহর) বক্তব্য বাস্তবায়িত হয়। ” (৩৬:৭০)
মহান আল্লাহ এই দুই আয়াতে বলছেন, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যেমন কোনো কবি নন তেমনি তার প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে তাও কবিতা নয়; যদিও পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত বিশেষ করে এর শেষদিকের সূরাগুলোতে কবিতার পংক্তির মতো মিল রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর রাসূল কবি ছিলেন না এবং তিনি নিজে থেকে কোনো কবিতাও লেখেননি।
অবশ্য মক্কার কাফেররা নবীজীর প্রতি কবি হওয়ার যে অপবাদ দিয়েছিল তা পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোর কবিতার ঢংয়ের জন্য ছিল না। বরং তাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারনা ছিল যে, কবিদের সঙ্গে জিনের সম্পর্ক আছে এবং জিনের কাছ থেকে তারা কবিতা শেখেন। পবিত্র কুরআনের বাণী কাফেরদের জন্য অভিনব ছিল বলে তারা মনে করত জিনদের কাছ থেকে এসব কথা শিখে নবীজী তা মানুষের সামনে তুলে ধরছেন।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: রাসূলের মুখ থেকে যা নিসৃত হয় তা আল্লাহর বাণী। মানুষকে কিয়ামত সম্পর্কে সতর্ক করতে এ বাণী নাজিল হয়েছে। সত্য অনুসন্ধিৎসু প্রতিটি মানুষ এই কুরআনের মাধ্যমে শয়তানের প্রতারণা ও ঋপুর তাড়না থেকে মুক্ত হয়ে মহা সাফল্য অর্জন করতে পারে।
অবশ্য কুরআনের আয়াত কাফেরদের চিন্তাজগতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। কারণ, তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে তাঁর সঙ্গে এত বেশি জেদ ও গোঁয়াতুমি করে যে, তাদের অন্তর পাথরের মতো কঠিন হয়ে যায়। ফলে সত্যবাণী সেই অন্তরে কোনো দাগ কাটে না। তবে তারপরও তাদের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দিতে হবে এ কারণে যে, তারা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পারে যে, সত্যবাণী তাদের কানে পৌঁছায়নি।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কুরআনে সুস্থ কবিতা চর্চাকে নিষেধ করা হয়নি বরং বলা হয়েছে আল্লাহর রাসূল কবি ছিলেন না।
২- যারা সত্যবাণী গ্রহণ করে না তাদের অন্তর মৃত। অথচ যতক্ষণ অন্তর জীবিত ও পবিত্র থাকে ততক্ষণ মানুষ মানবীয় মর্যাদায় ভূষিত থাকে। কাজেই উন্নত মানবীয় গুণাবলী অর্জন করতে হলে আমাদেরকে কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে।
news24bd.tv এসএম