হংলৌমেঙ: জিনলিঙের বারোজন সুন্দরী নারীর শোকগাথা

আহমদ ইহসানুল কবীর, ব্যারিষ্টার এট ল (লিংকনস ইন, ইউ.কে.), সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

হংলৌমেঙ: জিনলিঙের বারোজন সুন্দরী নারীর শোকগাথা

Other
২০১৭ সালের মার্চ মাসে চায়না ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সাইন্স এন্ড ল (সিইউপিএল)-এর নিমন্ত্রনে সমুদ্র বিষয়ক আইনের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে যাই চায়নার রাজধানী বেইজিং শহরে। কনফারেন্স শেষে দেশে ফেরার দিন সকালে পার্ক টাউন হোটেলের ছোট্ট সুভেনির সপে দেখতে পাই অনিন্দ্য সুন্দর একটি শোপিস - যাতে অঙ্কিত আছে বারো জন সুন্দরী চীনা নারীর চিত্র এবং সংক্ষিপ্ত আকারে বিধৃত আছে তাঁদের জীবনের শোকগাথা।
 
প্রথম দেখাতেই শোপিসটি হৃদয়গ্রাহী হওয়ায় সামন্য দরদাম করে কিনে ফেলি। মূলত, জিনলিঙ শহরের বারো জন সুন্দরী নারীর ঘটনাটি নেওয়া হয়েছে চীনের বিখ্যাত ধ্রæপদী উপন্যাস ‘হংলৌমেঙ’ থেকে - যা কিনা আঠারোশ শতকের মাঝামাঝি কিং রাজবংশের শাসনামলে বিখ্যাত উপন্যাসিক কাও জিয়েকিনের লেখা।
পরবর্তীতে এই উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ‘এ ড্রিম অব মেনশন’ বা ‘এ ড্রিম অব রেড চেম্বার’ নামে, যদিও উপন্যাসটি ‘দ্য স্টোরি অব স্টোন’ নামেও বিখ্যাত।
 
‘হংলৌমেঙ’ - একটি আধো-আন্মজৈবনিক উপন্যাস হিসাবে পরিচিত, যেখানে লেখক তাঁর তরুন বয়সে পরিচিত হওয়া নারীদের সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন অকপটে। তাঁদের কেউ ছিলেন লেখকের আত্মীয়, বান্ধবী বা গৃহকর্মী। এই উপন্যাসে প্রায় চল্লিশজন প্রধাণ চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, প¦ার্শ চরিত্র রয়েছে চারশতাধিক।
মানব চরিত্রের বিশ্লেষণ করতে যেয়ে লেখক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রতিটি মানুষ সবটাই ভালো বা পুরোটাই মন্দ -এমনটা নয়। পৃথিবীর বাস্তবতায় প্রত্যেকে অংশ নিচ্ছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে, আর তাতেই ফুটে উঠেছে মানব চরিত্রের বৈচিত্র্য আর ভালো-মন্দের এক অভ‚তপূর্ব সমন্বয়।
 
উপন্যাসে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে তৎকালীন চীনের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, রন্ধনশিল্প, চা-পানের অভ্যাস, উৎসব উদযাপন, প্রবাদের ব্যবহার, মিথের শক্তি, কনফুশিয়াসের আদর্শ, বৌদ্ধ ধর্ম, তাও মতাদর্শ, অপেরা, সংগীত, স্থাপত্যকলা, মৃতব্যক্তির সৎকার, চিত্রাঙ্কন, ‘ফিলাই পিটি’ বা পিতা-মাতা ও পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ধারনা। উপন্যাসের শুরুতেই বলা আছে নিম্নোক্ত পঙক্তি দু’টি:
‘সত্য হয়ে উঠে কল্পকাহিনী যখন কল্পকাহিনী হয় সত্য,
বাস্তব হয়ে যায় অবাস্তব যেখানে অবাস্তব হয় বাস্তব। ’
news24bd.tv
 
কল্পকাহিনীর সত্যে পরিনত হওয়া আর অবাস্তবের বাস্তবতায় রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় যেন জিনলিঙের বারোজন সুন্দরী নারীর জীবন চক্র আবর্তিত হয়েছে। জীবনের পরতে পরতে তাঁরা দগ্ধ হয়েছে সামন্তবাদী সমাজের নির্মমতায়। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর দৈব নির্ধারিত ভাগ্যপরিক্রমায়, জিনলিঙের সুন্দরী নারীরা বরণ করেছে অকাল মৃত্যু নয়তো শোকের মাতম। তাদের শোক কাহিনীর মাঝেই নিহিত আছে তৎকালীন চীনের বাস্তবতা, নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের রূঢ়তা। জিনলিঙের ভাগ্যাহতা নারীরা তাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাঁদের অসহায়ত্ব যেন কাঁদায় আমাদের এখনও এদেশের সমাজ বাস্তবতায়।
প্রথম নারী, লিন দাইয়ু কাটিয়ে দিয়েছিলেন একাকী এক জীবন। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রথাবিরোধী এই নারী পরিচিতি পেয়েছিলেন বিদ্রোহিনী হিসেবে। শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগতেন লিন। আধ্যাতিকতা ও বুদ্বিমত্তায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
দ্বিতীয় নারী, জু বাওচাই ছিল অপূর্ব সুন্দরী ও মেধাবিনী। তাঁর গোলাকার মুখ, বড় চোখ, ফর্সা ত্বক সবাইকে আকৃষ্ট করতো। উচ্চাকাঙ্খী এই নারীর জীবনেও নেমে আসে করুণ পরিনতি।
 
সামন্ত প্রথার নির্মম যাতাকলে তাঁর বৈবাহিক জীবন হয়ে যায় দুঃসহ। তৎকালীন নির্মম বৈবাহিক ব্যবস্থার ভুক্তভোগী নারী ছিলেন জু বাওচাই। জু’র গলায় সবসময় ঝুলতো বৌদ্ধ সন্নাসীর দেওয়া একটি মাদুলি। যদিও সেই মাদুলি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস থেকে পরিত্রান পেতে তাঁকে মোটেই সাহায্য করেনি।
তৃতীয় নারী, ওয়াং জিফেং বহু সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন। বহুগুনে গুনান্বিতা ওয়াং ছিল অপূর্ব সুন্দরী। সংসার সামলানোর গুরু দায়িত্ব পালন থেকে গরীব দুখীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল উদার মন।
 
অন্যদিকে, এতটাই কঠোর স্বভাব ছিল তাঁর যে, রাগান্বিত হলে যে কাউকে হত্যা করতে পারতো অবলীলায়। ব্যক্তি জীবনের দুঃখগুলো মেনে নিতে পারতো না ওয়াং। পরিবাররের সকল সম্পদ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হলে কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যু ঘটে।
 
চতুর্থ নারী, জিয়া কিয়াওজি বাল্যকাল থেকে কনফুশিয়াসের মতাদর্শ ও পিতা-মাতার আনুগত্য মেনে বড় হয়ে উঠেন। পারিবারিক ধার পরিশোধের জন্য ভাগ্যহতা কিয়াওজিকে তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা পতিতালয়ে বিক্রি করে দিতে উদ্যত হয়। পরিশেষে, গ্রানি লিউ তাঁকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে।
 
পঞ্চম নারী, জিয়া ইউআনচুন সৌভাগ্যক্রমে রাজ অন্তঃপুরে ঠাঁই পান এবং রাজার উপপত্মীর মর্যাদা লাভ করেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে রাজা তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রাসাদ জীবনে জিয়া নিজেকে বন্দী ভাবতে শুরু করে এবং চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন।
 
ষষ্ঠ নারী, জিয়া তানচুন ছিলেন পিতার উপপত্মীর সন্তান, তাই সামাজিকভাবে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। কিন্তুু তাঁর ছিল হাস্যরসাতœক গল্প বলার প্রতিভা। অপরূপ সুন্দরী এই নারীর ডাকনাম ছিল ‘রোজ’ বা গোলাপ। গোলাপের মতই ছিল তাঁর ভুবনভুলানো সৌন্দর্য। তাঁর বিয়ে হয়েছিল অনেক দূরে দক্ষিন সমুদ্রের তীরে এক সামরিক পরিবারে, যে কারণে নিজ পরিবার ও আপনজনদের থেকে আজীবন বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে এই দুঃখী নারীকে।
 
সপ্তম নারী, চিত্রাঙ্কনশিল্পে প্রতিভাধারিনী জিয়া জিচুন তাঁর বোনদের জীবনে ঘটে যাওয়া দূর্ভাগ্যের ঘটনা দ্বারা সর্বদা তাড়িত হতেন। জীবনের নির্মমতা থেকে রেহাই পেতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বুদ্ধের পুরনো মূর্তির পাদদেশে।
 
অষ্টম নারী, সুন্দরী ও সুশিক্ষিতা জিয়া ইঙচুন পার্থিব বিষয়ে ছিল সম্পূর্ন অনাগ্রহী। বিয়ের এক বছর অতিবাহিত না হতেই শ্বশুরালয়ের অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতনে প্রাণ হারান ইঙচুন।
 
নবম নারী, অভিজাত পরিবারে সন্তান কিন কেকিং। অপরূপ সুন্দরী এই নারী সহজেই পরপুরুষদের আকৃষ্ট করতে পারতেন। নিজ শ্বশুরের সাথে ছিল তাঁর অবৈধ সম্পর্ক। তাঁর শয়ন কক্ষ সুসজ্জিত ছিল মূল্যবান আসবাবপত্র ও শৈল্পিক উপকরণ দিয়ে। প্রখর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এই নারীর ঘটে রহস্যজনক মৃত্যু। কথিত আছে, দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিলেন কিন।
 
দশম নারী, লি ওয়ান বৈধব্য বরন করেন মাত্র কুড়ি বছর বয়সে। আজীবন মেনে চলেছেন অনুগত্যের তিন নীতি ও পূণ্যের চার নীতি। তাঁর পুত্র সন্তানের অকাল মৃত্যু হলে শোকচ্ছন্ন জীবন অতিবাহিত করেন। অনুগত্যের তিন নীতি ও পূণ্যের চার নীতি হচ্ছে একটি আচরন বিধি যা মূলত প্রাচীন চীনের কুমারী ও বিবাহিত নারীরা অনুসরন করতো। একজন নারীর জন্য আনুগত্যের তিন নীতিগুলো নিম্মোক্ত: এক, পিতার প্রতি কুমারী কন্যা হিসাবে, দুই, স্বামীর প্রতি সতী স্ত্রী হিসাবে, তিন, পুত্রের প্রতি আদর্শ মাতা হিসাবে। অন্যদিকে পূণ্যের চার নীতিগুলো হচ্ছে: এক, বৈবাহিক নৈতিকতা মেনে চলা, দুই, বৈবাহিক জীবনে কথোপকথনের নৈতিকতা, তিন, আচার-আচরন ও বাহ্যিক অবয়বের নৈতিকতা, চার, সতীত্ব ও এক বিবাহে নিজেকে আবদ্ধ রাখা।
 
একাদশতম নারী, মিয়াও উ জন্ম নিয়েছিল উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার পরিবারে। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম আকর্ষণ। একলা থাকতে পছন্দ করতেন আর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ছিলেন বাতিকগ্রস্থ মিয়াও উ। বৌদ্ধ উপাসনালয়ে সন্নাসিনী হিসাবে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। হঠাৎ একদিন দস্যুদল হানা দিয়ে তাঁকে অপহরন করে নিয়ে যায়। তাঁর পরিনতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না।
 
দ্বাদশতম নারী, শি জিয়ান গাইউন শৈশবেই তাঁর পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে বেড়ে উঠে চাচার পরিবারে অনাদরে, অযতেœ। পুরুষদের পোষাক পরিধানে তাঁেক সুন্দর দেখাতো, তাই প্রায়শই শি পুরুষদের পোষাক পরে নিজেকে পুরুষ ভাবতো। তিনি ছিলেন কাব্য অনুরাগী। শৈশবের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে নি তাঁর, বিবাহের অল্পকিছুদিন পরেই শি স্বামীকে হারায় এবং বাকি জীবন বৈধব্যের অনুশাসন মেনে কাটিয়ে দেয়।
 
পরিশেষ বলতে চাই, বাংলা সাহিত্যের নারীদেরভাগ্য‘হংলৌমেঙ’ এ উল্লেখিত নারীদের ভাগ্য থেকে খুব বেশী ভিন্ন নয়। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র, বিভ‚তিভ‚ষন, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নারীরা পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, দূর্ভাগ্য তাড়া করেছে তাঁদের প্রতিনিয়ত। নিজ পরিবারে নারী কতটা অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, অযতেœ ও অনাদরে লালিত তাঁর হাজারো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বাংলা সাহিত্যের পাতায়। সাহিত্য হচ্ছে সমাজের প্রতিচ্ছবি, সব অসঙ্গতি যেন নির্লিপ্তভাবে প্রতিবিম্বিত হয় সাহিত্যিকের কলমের ছোঁয়ায়। সাহিত্য সময়কে ধারন করে, যেমনটি দেখতে পাই আঠারোশ শতকের মাঝামাঝি চীনে রচিত ‘হংলৌমেঙ’ উপন্যাসে বর্ণিত ভাগ্যাহতা দ্বাদশ নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরাম্পরায়। আমার সোনার বাংলায় নারীরা কি এখনও মুক্তি পেয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলের নাগপাশ থেকে? গঠন করতে পেরেছি কি আমরা নারী-পুরুষে বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী, পারষ্পরিক সম্মান ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে একটি সুষম সমাজ, যেখানে নেই কোন ভাগ্যহতা নারীর শোকগাথা?
 
(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )
 
 
news24bd.tv/এমিজান্নাত