অর্থনীতির চাহিদা-সরবরাহ তত্ত্বের কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত

অর্থনীতির চাহিদা-সরবরাহ তত্ত্বের কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত

Other

২০১১ সালে Louis Vuitton ব্র্যান্ডের মহিলাদের হাতব্যাগের বিজ্ঞাপনে হলিউডের বিখ্যাত চিত্রতারকা এঞ্জেলিনা জলির একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে প্রগতিশীল গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। ছবিটিতে তাঁকে ওই ব্র্যান্ডের একটি ব্যাগ কাঁধে ক্যামবোডিয়ার পাণ্ডববর্জিত একটি জলাভূমিতে একলা নৌকায় বসে থাকতে দেখা যায়। ফ্যাশন জগতে আবেদন সৃষ্টির উদ্দ্যেশে তৈরি ওই বিজ্ঞাপনকে একটি গরীব দেশের দারিদ্র্যকে উপহাস করার সামিল বলে অভিযোগ করা হয়।

বিলাতের The Guardin পত্রিকা একটি প্রতিবেদনের  শিরোনাম দিয়েছিলো: What’s Angelina Jolie doing in a swamp with a £7,000 bag? (১৪ জুন ২০১১) অবশ্য, এঞ্জেলিনা জলির নিজের মতে ক্যামবোডিয়ার ওই ভ্রমণ ছিল তাঁর জীবনের একটি বড় অভিজ্ঞতা যা তাঁর জীবনবোধকে বদলে দিয়েছিল। এমনকি ওই বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া তাঁর অর্থের অর্ধেক তিনি চ্যারিটিতে দান করেছিলেন বলে শোনা যায়।

মূল্যবান ব্র্যান্ডের পণ্যের চাহিদা:

দেখা গেছে কিছু কিছু অতি দামী ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম এতো বেশী রাখা হয় বলেই ওই সব পণ্যের চাহিদা তৈরী হয়, যা অর্থনীতির চাহিদা তত্বের (দাম বাড়লে চাহিদা কমে) ঠিক উল্টো। সুইজারল্যাণ্ডের Patek Phillippe ব্র্যান্ডের সব চেয়ে কম দামের হাতঘড়ির দামও সাড়ে বারো হাজার মার্কিন ডলার, কিন্তু সে তুলনায় একশ’ ডলারের একটি জাপানী Citizen বা Casio ব্র্যান্ডের ঘড়ি তেমন কোন খারাপ সময় দেবে না।

সমাজের বিত্তবানদের নিজেদেরকে আলাদা শ্রেণী হিসাবে জাহির করার প্রবণতা থেকেই এ ধরনের অতি দামী ব্র্যান্ডের পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়। একই কারণেই Louis Vuitton ব্র্যান্ডের মহিলাদের একটি হাতব্যাগের দাম প্রায় এক হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে; আর তার থেকেও নামীদামী Hermes হাতব্যাগের দাম দশ হাজার থেকে এক শ’ হাজার ডলারের বেশী হতে পারে, যদিও অনেক কম দামের একটি সাধারণ ব্যাগের তুলনায় এদের গুণগত মানে এমন কোন বেশী পার্থক্য আছে বলা যায় না।

news24bd.tv

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থনীতি

আভিজাত ক্লাবের সদস্য পদের মূল্য নির্ধারণ:

দেখা যায় যে কলিকাতার ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ক্লাব "ক্যালকাটা ক্লাব" বা ঢাকার "ঢাকা ক্লাব"-এর সদস্য পদ পেতে হলে এককালীন ও নিয়মিত যে ফী দিতে হয় তা ঐসব ক্লাবের সদস্য হিসাবে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার তুলনায় অনেক বেশী। তবে ক্লাবের পরিচালকরা ইচ্ছা করলে তার থেকে অনেক বেশী ফী নির্ধারণ করলেও সদস্য পদ পেতে আগ্রহী মানুষের অভাব হবে না; অর্থাৎ, বাজার দামের থেকে কম মূল্য তাঁরা ইচ্ছা করেই নির্ধারণ করছেন। কেন?

এধরনের ক্লাবে মোটা দাগে দুই শ্রেনীর সদস্য থাকেন: এক, সমাজের নামীদামী প্রভাবশালী ব্যক্তি, যথেস্ট সচ্ছল হলেও যাঁদের সহায়-সম্পত্তি অফুরন্ত নয়। দুই, খুবই বিত্তশালী হলেও সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে আছেন, যাঁরা সামাজিক কৌলিন্য অর্জন এবং প্রথম শ্রেনীর ব্যাক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা অর্জনের একটা উপায় হিসাবে সদস্য পদ লাভের জন্য অনেক বেশী ব্যয় করতে সক্ষম ও আগ্রহী।   কিন্তু অতো বেশী ফী নির্ধারণ করলে প্রথম শ্রেনীর সদস্যদের আনুপাতিক সংখ্যা ক্রমে কমে যাবে, যার ফলে ক্লাবটির সদস্য পদের সামাজিক মর্যাদাও কমতে থাকবে। পরিনামে দ্বিতীয় শ্রেনীর সদস্যরাও অত বেশী খরচ করে সদস্য পদ পেতে বা ধরে রাখতে আর আগ্রহী থাকবেন না।

জাতীয় পদক-পুরস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি:

সব দেশেই সামাজের নানা ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে কিছু অগ্রগন্য ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের উপাধি ও পদক দিয়ে ভূষিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে টাকার অঙ্কে ঐসব পদক ও সন্মানীর মুল্য যা, অনেক আগ্রহী পদক প্রার্থীরা তার থেকে অনেক বেশী দাম দিয়ে সেগুলো কিনতে চাইতেন। তবে সামাজিক অবদানের একটা মাপকাঠির বিচারেই পদকগুলো দেওয়া হয়, আর সেজন্যই এগুলো মর্যাদার দিক থেকে মূল্যবান।

আরও পড়ুন


সাতক্ষীরা মেডিকেলে আরও ৯ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৬৪

আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়ার শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকার (ভিডিও)

‘পরমাণু সমঝোতা সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন হবে না’

‘সিলিকন ফুয়েল প্লেট’ তৈরির কাজে হাত দিয়েছে ইরান


তবে যে কোন সরকারের পদক প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ দুটি বিবেচনা মাথায় রাখে: এক, সত্যিকার উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করে পদকগুলোর মর্যাদা ধরে রাখা; দুই, ক্ষমতাশীন সরকারের প্রতি সমর্থন বা আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃত করা। এ দুটি বিবেচনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়।   দ্বিতীয় বিবেচনা অতিরিক্ত প্রাধান্য পেলে পদকগুলোর মর্যাদাও কমতে থাকে এবং এক সময় দেখা যেতে পারে যে পদকগুলোর এত অবমূল্যায়ন ঘটেছে যে সরকারের অনুগ্রহভাজনদেরও এগুলো পাওয়ার আগ্রহ কমে গেছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সেরকমটা হতে দেখা যায়, কারণ ব্যক্তিখাতের  উদ্যোক্তারা আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে যে রকম পারদর্শী, সরকারের  প্রশাসনযন্ত্র  রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের বিষয়ে সেরকম পারদর্শিতা সাধারণত দেখাতে পারে না। ফলে এসব পদক-পুরস্কার প্রদানের পেছনে সরকারের যে দুটি উদ্দেশ্য থাকে তার কোনটিই হয়তো শেষ পর্যন্ত আর তেমন পূরণ হয় না।

এই শেষোক্ত উদাহরণটি অর্থনীতির public choice তত্ত্বের আওতায় পড়ে, যে তত্ত্বের সূচনা করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস বুকানান (James Buchanan)। এই তত্ত্ব আনুসারে অর্থনীতির আচরণ যেমন ব্যক্তিস্বার্থ ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তেমনি জনস্বার্থে নয় বরং রাজনীতিক ও আমলাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থেই গৃহীত হতে পারে।

(বাংলায় অর্থনীতির যে বইটি লিখছি: "অর্থনীতি কেনো পড়ি; উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিত"; সেখান থেকে উদ্ধৃত। )

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

news24bd.tv এসএম