টুপি-পাঞ্জাবী হলো ক্ষমতাহীন শ্রেণীর পোশাক

টুপি-পাঞ্জাবী হলো ক্ষমতাহীন শ্রেণীর পোশাক

Other

রাজারা মুকুট ব্যবহার করতেন। ব্যাপারটা এমন নয় যে মুকুট না পরলে তিনি রাজা নন। মুকুটের বদলে সাধারণ টুপি ব্যবহার করলেও তিনি রাজাই থাকেন। সিংহাসনের বদলে চৌকিতে বসলেও তাঁর রাজ-পরিচয় ক্ষুণ্ণ হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু তিনি বসতেন সিংহাসনে, এবং পরতেন রত্নখচিত মুকুট। এর কারণ কী?

এর কারণ, সমাজে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ভালো উপায় হলো দামি পোশাক পরা, এবং দামি আসবাব ব্যবহার করা। ক্ষমতা প্রদর্শন মানে হলো মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া। একটি রত্নখচিত মুকুট, তার চারপাশে যে-পরিমাণ ভয় সৃষ্টি করতে পারে, একটি সাধারণ টুপি তা পারে না।

ইউরোপীয় রাজারা বাহারি পোশাক পরতেন। প্রজারা পরতো স্যুট-কোট। স্যুট-কোট ছিলো শ্রমিকদের পোশাক। স্যুট-কোট পরে দীর্ঘসময় শীতে কাজ করা যেতো। কালো কোটে বারবার ময়লা মুছা যেতো। কিন্তু রাজার পোশাক এরকম হলে অসুবিধা। রাজাকে পরতে হতো এমন পোশাক, যা সচরাচর দেখা যায় না। ওই পোশাক দেখলেই বুঝা যেতো, লোকটি বিশেষ কেউ। লোকটির মানুষকে ভয় দেখানোর সামর্থ্য আছে।  

আবার রাশেদুন খলিফাদের কোনো মুকুট ছিলো না। ফলে ধর্মীয় কারণ ব্যতীত, তাঁদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ মানুষের ছিলো না। তাঁদের শাসনামলে যে নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকতো, এর একটি কারণ আমি মনে করি, তাঁদের সাধারণ জীবন-যাপন। রাজার জীবন যখন প্রজার জীবনের সমান হয়, তখন রাজা আর রাজা থাকেন না। তিনি নিজেও প্রজা হয়ে উঠেন। ম্যাকিয়াভেলি তাঁর রাজাকে, এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলেছিলেন।  

প্রশ্ন হলো, আধুনিক পোশাক-আশাকগুলিও মানুষকে ভয় দেখানোর দায়িত্ব পালন করে কি না? এক্ষেত্রে আমার উত্তর হলো, আধুনিক পৃথিবীতে, মানুষ যে-প্রক্রিয়ায় সমাজে ভয় সৃষ্টি করে, তা রাজা-বাদশাহদের আমলের মতো অতো সরল নয়। একসময় যা ছিলো শ্রমিকদের পোশাক, এখন তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পোশাক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভয় দেখানোর সামর্থ্য একজন শ্রমিকের ভয় দেখানোর সামর্থ্যের সমান। বরং, শ্রমিকের পোশাকে তিনিই এখন সবচেয়ে ভীতিকর রাজা। জাতিসংঘ চার্টারকে তিনি ইচ্ছেমতো পড়তে পারেন, এবং পড়ে ইচ্ছেমতো অর্থ তৈরি করতে পারেন। ব্রুনাইয়ের রাজা এখনও মুকুট পরেন, কিন্তু তাঁর ভয় দেখানোর সামর্থ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভয় দেখানোর সামর্থ্যের এক হাজার ভাগের এক ভাগও নয়।

সুতরাং বলা যায়, পোশাকের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি উল্টো বিবর্তন ঘটে গেছে। শ্রমিক-সুলভ পরিপাটি পোশাকগুলোর ভয় দেখানোর ক্ষমতা এখন, পিএইচডি কনভোকেশনের গাউনের চেয়ে বেশি। লেনিনকে দেখে বুঝা যেতো না যে তিনি লেনিন। তাঁর হাতে এতো ক্ষমতা, এটি বুঝতে হলে তাঁর নামে কিছু একটা বলতে হতো। বললেই বুঝা যেতো যে তাঁর মানুষ খুন করার অসাধারণ ক্ষমতা আছে।  

বিভিন্ন দেশে যে অফিসার শ্রেণীটি আছে, তাদের স্যুটেড বুটেড হওয়ার পেছনের কারণটিও মানুষকে ভয় দেখানো। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। দেশটিতে ক্ষমতাহীন মানুষদের পোশাক একরকম, এবং ক্ষমতাবান মানুষদের পোশাক আরেক রকম। লুঙ্গি পরা কেউ যখন স্যুট-বুট পরা কারও মুখোমুখি হয়, তখন সে নিজের অজান্তেই আত্মসমর্পণ করে বসে। কথা বলতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে, বসতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারগুলো মনস্তাত্বিক। ইউনিফর্ম পরা কারও সাথে আমরা সহজে তর্ক করতে পারি না। ইউনিফর্ম আমাদের জানিয়ে দেয়— লোকটির সাথে খুব হিশেব করে কথা বলতে হবে। সেদিন টুপি-পাঞ্জাবী পরা একজন ইউএনওর ছবি দেখলাম। আমি নিশ্চিত, ওই ইউএনওকে দেখে কেউ ভয় পাবে না। কারণ বাংলাদেশে, টুপি-পাঞ্জাবী হলো ক্ষমতাহীন শ্রেণীর পোশাক।  

আমি যতোবার লুঙ্গি পরে বিদেশ যাতায়াত করেছি, ততোবারই বিমানে, বাংলাদেশী মানুষ দ্বারা হাসি-তামাশার শিকার হয়েছি। একবার ইমিগ্রেশন অফিসার ভেবেছিলো, আমার দুই উরুর চিপায় বুঝি ঘা হয়েছে, এজন্য লুঙ্গি পরে এয়ারপোর্টে ঢুকেছি। এর কারণ, লুঙ্গি কোনো ভীতিকর পোশাক নয়। লুঙ্গির ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য। শেখ মুজিব ও ভাসানী লুঙ্গি পরতেন, এজন্য তাঁদের কেউ ভয় পেতো না। গান্ধীর চেয়ে নেহরুর পোশাক ভীতিকর ছিলো।  

সিমলা কনফারেন্সে, মাওলানা আজাদ যখন ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাতে বসেছিলেন, তখন ভাইসরয়ের পোশাক আর মাওলানা আজাদের পোশাক এক ছিলো না। জেলখানায় কয়েদীদের যে-পোশাক দেয়া হয়, তা একজন মানুষকে ভেঙ্গে ফেলার পোশাক। ওই পোশাক কয়েদীদের একটি বার্তা দেয়। বার্তাটি হলো— মানুষ হিশেবে তোমার ক্ষমতা ও মূল্য, এখন শূন্য। মিলিটারিতে সৈনিক এবং অফিসার ক্লাসের যে-পার্থক্য, তা মুলত পোশাকের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়। পোশাক দেখলেই একজন সৈনিক বুঝে যান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসছেন, তার কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। একই কথা অন্য বাহিনীগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  

পোশাক, এক প্রকার সামাজিক দেয়াল হিশেবে কাজ করে। বিচারপতি যদি বিশেষ পোশাক না পরেন, এবং বিশেষ চৌকিতে না বসেন, তাহলে তার আইনি কর্তৃত্ব আমরা সহজে মানতে চাইবো না। পুলিশ যদি লুঙ্গি পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মারামারি থামাতে যায়, তাহলে মারামারি থামবে বলে মনে হয় না। বিয়ের আসরে যদি জামাই একটু বিশেষ পোশাক না পরেন, তাহলে তার দিকে কেউ আগ্রহ নিয়ে তাকাবে না। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি শক্তিশালী উপায় হলো পোশাক।

আমাদের নারীরা যে প্রায়ই শাড়ি-গয়না নিয়ে তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলে, তার মূল কারণও মনোযোগ আকর্ষণ। তারা চায়, চারপাশের সমাজ তাদের দেখুক, এবং দেখে হিংসায় জ্বলে মরুক। হিংসাও এক প্রকার ভয়, কারণ হিংসা মানুষে মানুষে বিকর্ষণ তৈরি করতে পারে। আমরা যখন কাউকে হিংসা করি, তখন তার কাছে সহজে যেতে চাই না। আবার আমরা যখন কাউকে ভয় করি, তখন তার কাছেও সহজে যেতে চাই না।  

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পোশাক অনেকটা বন্দুকের বিকল্প হিশেবে কাজ করে। কোনো সমাজে, পোশাকের আশ্রয় নিয়ে, নিজেকে ক্ষমতাধর হিশেবে প্রচার করা সম্ভব। অবশ্য এ কাজে অনেকে, পোশাকের সাথে একটি দামি গাড়ির সমাহারও ঘটান। বাংলাদেশে যে ড্রাইভার প্রথাটি আছে, তা মূলত মানুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে। ক্ষমতাধর মানুষ, অথচ তার একজন চাকর নেই, এটা হতে পারে না।  

এ ধারণা থেকেই, বাংলাদেশের অধিকাংশ স্যুট-বুট সদস্য, নিজে গাড়ি চালানো শেখেন না। তারা রাখেন ড্রাইভার নামক একজন চাকর, যিনি সিট থেকে নেমে গাড়ির দরজাটি একটু খুলে দেবেন, আর মানুষের সামনে স্যার স্যার, ম্যাডাম ম্যাডাম করবেন। এতে নিজেকে একটু রাজা রাজা মনে হয়। অথচ ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ড্রাইভার সুবিধা পান না। যতো বড় অফিসারই হোন না কেন, নিজের গাড়ি নিজেকেই চালাতে হবে।   (‘মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা’ থেকে)

লেখাটি মহিউদ্দিন মোহাম্মদ-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া (সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/আলী