আমার মতো দেশ ছাড়া বাংলাদেশিরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক বাঙালি?

আমার মতো দেশ ছাড়া বাংলাদেশিরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক বাঙালি?

Other

NHS এ দশ মাসের মত হয়ে গেল।

বিদেশে এটাই প্রথম কাজ করছি তা না। এর আগে মালদ্বীপে কাজ করেছি সাড়ে তিন বছর, ওমানে কাজ করেছি প্রায় চার বছর। কিন্তু NHS এ কাজ শুরু করার পর থেকে একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করছি।

সুযোগ পেলেই লোকজন একটা কথা শুনিয়ে দেয়...

"দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, দেশ নিয়ে এতো প্যাঁচাল পারেন কেন?"

ভাবখানা এমন যেন দেশ ছেড়ে আসার সময় আমার বাংলাদেশী নাগরিকত্ব তার বাবার জমিদারিতে খাজনা হিসেবে জমা দিয়ে এসেছি।

এমনটা যখন মালদ্বীপ বা ওমান ছিলাম তখন শোনা যায়নি, যখনই পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা NHS এ কাজ শুরু করলাম তখন বেশি করে শুনতে লাগলাম। কেন?

জানি না। তবে অনুমান করতে পারি।

"নরকের দরজায় দাড়োয়ান" বিষয়ক একটা গল্প আছে, তার সাথে মিল থাকার সম্ভাবনা বেশি।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, মালদ্বীপে কাজ করতে যাওয়াটা আমার দেশের অনেকের কাছে একটা অপমানজনক ব্যাপার। আমি যখন প্রথম ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তখন আমার আত্মীয় স্বজনই অনেকে বলেছিল - "আরে ঐদেশে গিয়া কি করবি? মাছ ধরবি?"

আর ওদিকে ওমান তথা মধ্যপ্রাচ্য তো গর্বিত বাঙালির জন্যে স্রেফ কামলা খাটার জায়গা।

এই কামলা প্রসঙ্গে পরে ফেরত আসছি।

আজকের এই লেখাটা মূলত তাদের জন্যে, যাদের খুব চুলকায় যখন আমি দেশ নিয়ে কিছু লিখি।

এই লেখাটা লেখার কি খুব দরকার?

না।

না লিখলেও চলে, তবু লিখতে চাচ্ছি কারন ঘাড়ের রগ আমার একটা বরাবরই ত্যাড়া।

তো যারা সময় অসময় এই মহান বাক্য গুলো বলে থাকেন... বিদেশ বসে এতো ফটর ফটর করেন কেন? দেশ নিয়া এতো নেগেটিভ কথা বলেন কেন? তাদের প্রতি প্রশ্ন হচ্ছে... আমি কি নিয়ে বলব বা লিখব সেটা কি আপনার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে? আর আমি আমার জীবনে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি সেগুলো ভুলে গিয়ে মিঠা মিঠা মিথ্যা কথা লিখতে হবে?

আচ্ছা, আমি আপনাকে উল্টো একটা প্রশ্ন করি।

প্রবাসীদের নিয়ে আপনার এতো জ্বলুনি কেন? আপনি দেশে থেকে দেশের জন্যে কি উদ্ধার করেছেন?

পৃথিবীর কয়টা মানুষ আপনার কল্যাণে বাংলাদেশকে চিনেছে?

কিশোয়ার আপুর নাম শুনেছেন? মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার এবারের আসরের ফাইনাল চারজনের মধ্যে আছেন। বিধাতা সহায় থাকলে আশা করি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেন। এই আপু অস্ট্রেলিয়াতে জন্মেছেন, সেখানেই বড় হয়েছেন। উনার বাংলাদেশী পাসপোর্ট আছে কিনা আমি সে বিষয়েও নিশ্চিত নই। কিন্তু এই আপুর কল্যাণে আজ অস্ট্রেলিয়া তো বটেই পৃথিবী জুড়েই মানুষ বাংলাদেশের খাবারের কথা জেনেছে, রাঙামাটির পাহাড়ী রেসিপির কথা জেনেছে।

ফাহিমের কথা জানেন? টিনএজ ছোঁয়ার আগেই দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোন সাহায্য না পেয়ে ফাহিম তার বাবার সাথে ফ্রান্সে পাড়ি দিয়েছিল। সে একজন চেজ প্রোডিজি। ফ্রান্সের বয়সভিত্তিক দাবায় সে পুরো দেশে চ্যাম্পিয়ন অথবা রানারআপ হয়েছিল। তাকে নিয়ে সিনেমাও বানানো হয়েছে। এই ছেলে একদিন আন্তর্জাতিক দাবায় পরিচিত মুখ হবে। সেদিন দেশের পত্রিকাগুলো নির্লজ্জের মত প্রথম পাতায় হয়তো তাকে নিয়ে ফিচার করবে। অথচ সে একটা সময় দেশের দাবা ফেডারেশনে দিনের পর দিন ঘুরেও কারো কোন সাহায্য পায়নি।

বলেছিলাম কামলা প্রসঙ্গে ফিরে আসবো।

আজকাল আমাদের স্মার্ট প্রজন্মকে খুব দেখি প্রবাসীদের নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে। "রেমিট্যান্স যোদ্ধা" শব্দটা নিয়ে তো রীতিমত হাসাহাসি লেগে যায় তাদের মাঝে। তাদের কাছে আমরা "কামলা"।

আমরা নিজের কিংবা পরিবারের পেটের ধান্দায় বিদেশ এসেছি। দেশে টাকা পাঠাই নিজের পরিবারের জন্যে, দেশের জন্যে না।

ঘটনা সত্যি। আমরা বিদেশী মুদ্রা যা রোজগার করি তা দেশে পাঠাই আপনজনের দেখভালের জন্যেই। কিন্তু দেশ সেখান থেকে কমিশন নেয়। রেমিট্যান্স শব্দটা শুনতে ভাল লাগে না?

দেশ আমার পাঠানো টাকা থেকে কমিশন কেটে নেয়- এটা শুনতে ভাল লাগছে? সেই কমিশনের টাকায় আপনিও ভাগ বসাচ্ছেন- এটা শুনতে ভাল লাগছে?

আট বছরে আমার স্ত্রী এবং আমি মিলে দেশে অর্ধ কোটির বেশি টাকা পাঠিয়েছি। পাঁচ টাকা কামালে আমার দশ টাকা খরচ করার অভ্যাস বলে হয়তো কিছুই জমাতে পারিনি কিন্তু টাকা বাংলাদেশের বাজারে খরচ হয়েছে এটা নিপাট সত্যি।

আমরা দু‘জন মিলে এখনো পর্যন্ত সাত/আটটা অনাথ বাচ্চার পড়াশোনার খরচ দিয়ে আসছি প্রায় পাঁচ ছয় বছর ধরে। মাঝখানে চাকরি বাকরি বিহীন ছিলাম বিধায় চালিয়ে যেতে পারিনি কিন্তু আল্লাহর রহমতে আবার শুরু করেছি। আপাদত তিনটা বাচ্চাকে দিয়ে, সামনে বাড়াবো এবং বিধাতা চায় তো ওরা বড় হওয়া পর্যন্ত এটা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করব। এসব কথা বলে বেড়ানোর জন্যে না, আবার ভাবি বললে ক্ষতি কি? আরো কেউ যদি এগিয়ে আসে তবে তো আরো কিছু বাচ্চার জীবন গড়ে যাবে।

এখন আবার প্রশ্ন করি, আপনি কি করেছেন? উত্তর দিতে পারলে ভাল, নাহলে একটু পর আমি দিয়ে দিচ্ছি। ধৈর্য্য ধরে আরেকটু পড়তে থাকুন।

একটু আগে কিশোয়ার আপু আর ফাহিমের কথা বললাম, তাদের তুলনায় আমি-আমার স্ত্রী কিংবা আমাদের অর্জন হয়তো ধুলিসম তবু আরেকটু নিজেদের ঢোল পিটাবো।

পুরো মালদ্বীপের ভিতর সবচেয়ে বড় এবং প্রধান সরকারি হাসপাতালে যখন আমরা দুজন কাজ করতে যাই ২০১৩ সালে তখন সে হাসপাতালে একজন মাত্র বাংলাদেশী ডাক্তার ছিলেন। তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় পলাশ ভাই। আমরা এক বছর পুরো করার আগেই আমার ডিপার্টমেন্টের প্রধান আমাকে ডেকে বললেন - "সাইফুল, আমরা ঠিক করেছি তোমাদের দেশে যাব, ওখান থেকে শ'খানেক ডাক্তার আনব। তোমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছি। এখন আমাকে বল তো তোমার মত অসাধারন আরো কিছু ডাক্তার কিভাবে বাছাই করব?"

বলা বাহুল্য সেদিন খুব লজ্জা যেমন পেয়েছিলাম তেমনি গর্বে বুকটা ভরেও গিয়েছিল।

কালক্রমে মালদ্বীপের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টিমটা যখন কয়েক মাস পর বাংলাদেশে গিয়েছিল ইন্টারভিউ নিতে, আমার স্ত্রী আর আমি তখন বাৎসরিক ছুটিতে বাংলাদেশেই। ঢাকায় অবস্থানরত আমার ডিপার্টমেন্টের প্রধানের সাথে দেখা করে আমরা তাঁকে আড়ং থেকে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে একটা নকশী কাঁথা কিনে দিয়েছিলাম। কেন? উনারা জানুক আমার দেশ শুধু যানজটের দেশ না, আমার দেশ শুধু হতদরিদ্রের দেশ না।

আজকে একটু খবর নিয়ে দেখুন ২০১৪ সালের পর থেকে মালদ্বীপের ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতালে কতজন বাংলাদেশী ডাক্তার নিয়োগ পেয়েছে। এর সব কৃতিত্বের দাবি করছি না, তবে কিছু অংশের দাবী আমরা ছাড়ছিও না। আমার স্ত্রী আর আমি সেই হাসপাতাল ছেড়েছি পাঁচ বছরের বেশি হল, তবু আপনি সেখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন ডাঃ নাজিয়া অথবা ডাঃ সাইফুলকে চেনে কি না।

ওমানে খুব বড় কোন হাসপাতালে কাজ করিনি, করেছি মফস্বলের একটা ছোট ক্লিনিকে। সেখানে আরবের মানুষ যখন শুনত বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন চক্ষু কপালে উঠে যেত। তাদের ধারনা ছিল বাংলাদেশে শুধু অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিংবা ফকির মিসকিনদের বসবাস। আমার স্বদেশী লোকজন অনেকেই বলত - স্যার আপনারা এখানে ডাক্তার হিসেবে আছেন এটা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের একটা ব্যাপার! ওমানিদের সামনে গর্ব করে বলতে পারি।

ওমান ছেড়েছি প্রায় দেড় বছর হল। গত সপ্তাহে এক ওমানি ভদ্রলোক হঠাৎ করে আমার ইউকের নাম্বারে মেসেজ পাঠিয়েছেন... "ডাক্তার আপনি কেমন আছেন? আপনার কথা আমার মা মাঝে মধ্যেই বলে। "

NHS এ কাজ শুরু করেছিলাম জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে। একটা গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের মাঝে একদম হট জোনে, আইসিইউ তে। খুব নার্ভাস ছিলাম শুরুতে, কারন- অনেকটা চৌবাচ্চা থেকে হঠাৎ করে যেন সাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছি।

গত দুই মাসের ভিতর দুইজন কনসালট্যান্ট আমার হাতে নতুন জয়েন করা দুই ডাক্তারকে ছেড়ে দিয়েছেন আর বলেছেন ওদেরকে সুপারভাইজ কর, সেন্ট্রাল লাইন করা দেখিয়ে দাও, আমিই দেখিয়ে দিতাম কিন্তু আমার জরুরী মিটিং এ যেতে হবে।

গেল সপ্তাহে এক কনসালট্যান্ট তার চেম্বারে ডেকে নিয়ে বললেন... আমরা তোমাকে রেজিস্ট্রার পদে প্রমোট করব বলে ভাবছি, তুমি কি বল?

যুক্তরাজ্যের খুব উত্তরের এই হাসপাতালে আমার স্ত্রী আর আমিই আমাদের জানামতে দুইমাত্র বাংলাদেশী ডাক্তার।

দুঃখিত, লম্বা লেখা লিখে আপনার ধৈর্য্য নষ্ট করার জন্যে। একটু আগে প্রশ্ন রেখেছিলাম - দেশ ছেড়েছি বলে আমি বা আমরা না হয় বাংলাদেশের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবি না কিংবা ভাবার অধিকার রাখি না কিন্তু আপনি দেশে থেকে কি উদ্ধার করেছেন? কি দিয়েছেন দেশকে?

আমি বলে দিচ্ছি...

দেশের অক্সিজেন নিয়েছেন, দিয়েছেন কার্বনডাই অক্সাইড। দেশের অন্নে উদরপূর্তি করেছেন আর দেশকে দিয়েছেন পুরিষ। রাগ করবেন না, কিছুই দেননি তা তো বলিনি। পুরিষ তো জৈব সার হিসেবে উত্তম।

তো এই যে বিশাল বড় লেকচার দিয়ে ফেললাম এর অর্থ কি দাঁড়ালো? আমি কিংবা আমার মতো দেশ ছাড়া বাংলাদেশিরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক বাঙালি, আর দেশে যারা বাস করে তারা দুধভাত?

পুরো লেখা পরে আপনি যদি এই সারাংশ দাঁড় করিয়ে থাকেন তবে ঐ যে একটু আগে পুরিষ ত্যাগের কথা বললাম সেটা কেবল মলদ্বারই নয়, আপনার মাথার খুলির ভিতরেও শোভা বর্ধন করছে। তাই আপনার খুব রাগ হচ্ছে, আমাকে অকথ্য গালাগাল দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। হাতের কাছে পেলে হয়তো নাকমুখ থ্যাবড়া করে দিতেন।


আরও পড়ুনঃ

আফগানিস্তান যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে যা বললেন বাইডেন

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনালের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঠে থাকবে পুলিশ

বহু প্রেম করেছি, তবে মা-বাবার পছন্দেই বিয়ে করবো: তাপসী

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের নিয়ে বুবলির ফুটবল দর্শন


আশার কথা হল -

সবাই আপনার মত না।

কেউ কেউ আছেন তারা আপনার মত হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে না। বাংলাদেশের কেউ ভিনদেশে গিয়ে কিছু অর্জন করতে পারলে তারা আনন্দিত হন, গর্বিত হন। তারা ভাবেন ... ওরা আমার দেশের মানুষ, আমার আপনজন। পৃথিবীর একটি মানুষও যদি ওদের কারো কল্যাণে "বাংলাদেশ" কে চেনে, দেশটাকে নিয়ে ভাল কিছু ভাবে তবে সেটা তারা নিজেদের অর্জনের মতোই দেখে। দেখে একজন বাংলাদেশীর অর্জন হিসেবে।

news24bd.tv / নকিব