গতকালের ঘটনায় আবারো মনে পড়লো

কাজী শরিফ

গতকালের ঘটনায় আবারো মনে পড়লো

Other

একজন লাইলির গল্প কিংবা এদেশের শ্রমিকদের সাধারণ চিত্র। "স্যার, আমি লাইলি । হ্যালো স্যার, আমি লাইলি। হ্যালো স্যার, হ্যালো স্যার শুনছেন না! আমি লাইলি।

স্যার, কালকে রাইতে আমার মা মারা গেছে। আমার বেতনটা স্যার বারো নাম্বার লাইনের নারগিসরে একটু দিবেন ! স্যার ,আমার মায় ত মইরা গেছে, মউতা বাড়িত কিছু খরছ আছে।

স্যার, আমার হাতে কোনও টাকা নাই। স্যার, আমি আরেকজনের কাছ থেইকা পাঁচশ টাকা হাওলাত করে বাড়িত যাইতাছি।

হ্যালো স্যার, আমি আজ অফিসে আসুম না। আমি চাঁনপুর যাইতাছি। স্যার,আপনি আমার বাপ স্যার! দিয়েন স্যার! আমি আর কোনদিন তো কই নাই। স্যার নারগিসরে দিলে ও আমারে বিকাশ কইরা দিব। আমি এখন একটা অ্যাম্বুলেন্সে যাইতেছি।  

দশজন মানুষরে নিছে। স্যার, ১২ নাম্বার লাইনের নারগিসরে টাকাটা দিয়েন। স্যার গাইল দিতাছেন! আমার মায় মইরা গেছে। হ্যালো হ্যালো স্যার!"

ব্যাগের ভেতর থাকা একটা কাগজ বের করলেন লাইলি। নামটা অবশ্য ফোনে কথা বলার সময় শুনেছি। দেখছি ওখান থেকে দেখে দেখে আর একজনকে ফোন করছেন।
"আফা, আমি লাইলি। হ্যালো আফা আমারে চিনছেন? গাড়ীর আওয়াজে ভালমত শোনা যায় না...
ও চিনছেন? আমি লাইলি। বাড়িত যাইতাছি আফা...

আমার আম্মা কালকে রাত্রে মারা গেছে। আমিতো আইতে পারতাছিনা অফিসে। আপনি একটু কষ্ট কইরা রাজিব স্যাররে বইলেন আমার বেতনটা নারগিসরে দিতে।

ঐ ১২ নাম্বার লাইনের নারগিস । নোয়াখালী বাড়ি যে ঐ মাইয়াটা। আফা, বুঝেনই ত মায় মারা গেছে বাড়িত কিছু খরছ আছে না !

মারে মাটি দেওনের পইষাটাও আমার নাই। ওইটা নাহয় আমার ভাইয়ে দিবো...কিন্তু সবাই জানে আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। কিছু খরছ ত দিতে অইব।

আফা আমারে মাফ করেন না! রাগ কইরেন না... আমি কি করমু কন। আমি! আমি আইজ অফিসে আমু কেমনে ? কইলাম না অ্যাম্বুলেন্সে কইরা বাড়িত আই। আল্লায় জানে মার মউতা মুখটা দেখি কি না!"

ভাবলেশহীন লাইলির ফোনে ক্রমাগত আলাপ আমি শুনছি। একই অ্যাম্বুলেন্সে করে কুমিল্লা ফিরছি চট্টগ্রাম থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। অবরোধ কিংবা হরতাল মানে না চাকুরি। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর নয়জন যাত্রীর মত আমার ঠিকানা অ্যাম্বুলেন্সে।

লাইলি আবার মগ্ন হয়ে পড়ল তার মোবাইল ফোনখানা নিয়ে। কাউকে ফোন করছে হয়ত। বেশ কিছুক্ষন পর মনে হলো ধরল ওপাশের মানুষটি । "হ্যালো নারগিস বইন কেমন আছস? আমি ভালা নাই । আমার মায় কাইল রাইতে মারা গেছে। আমি এখন অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িত যাই । "

ঠোঁট ফুলে উঠছে লাইলির। যেকোনো মুহূর্তে কান্নার ফোয়ারা ছড়িয়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে । "নারগিসরে বইন পারলে আমার বেতনটা আইজ নিয়া নিস। আমি স্যার রে কইসি । তরে দিলে আমারে বিকাশ কইরা দিস। বইন এই কামটা করিস আমার জন্য। হ হ আমি স্যার রে কইছি ত। তুই আমার ঘর থেইকা আমার আইডি কার্ডটা নিয়া জাইস। আমি আফারেও কইছি। তরে দিব কইছে ।

তুই একটু বুঝাই কইসরে বইন। হ্যালো নারগিস, হ্যালো । "লাইনটা মনে হয় কেটে গেছে। তার দৃষ্টি বলছে ফোনের টাকাটা শেষ হয়ে গেছে।

আমি সরাসরি তার দিকে তাকাচ্ছি না। পাছে তিনি বিব্রত হন। বরং আমিই অবাক হচ্ছি। মানুষটাকে দেখে একবারও মনে হচ্ছে না যে তিনি তার মায়ের লাশটি দেখতে যাচ্ছেন। মা হারানোর শোকের চেয়ে তার কাছে বেতন প্রাপ্তিটিই প্রধান বলে প্রতীয়মান হচ্ছে আমার কাছে।

মাত্র সোয়া ঘণ্টায় আমরা ফেণী পৌঁছে গেলাম। হরতালে রাস্তা খালি। দেরি হলো না। শুধু অ্যাম্বুলেন্সে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমাদের এবারের যাত্রা কুমিল্লার পথে। মহিপাল মোড় থেকে একটা সিএনজি ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ভাড়া জনপ্রতি একশ ত্রিশ টাকা। ভাই, আপনি কি কুমিল্লা যাইবেন?

লাইলির প্রশ্নে ভড়কে গেলাম। লাইলি প্রথমবারের মত কিছু একটা বলল । হ্যাঁ যাব। আপনি যাবেন? প্রশ্ন ও জবাব একসাথেই দিলাম। জি, আমিও যাবো। ঐখান থেকে যাব চাঁদপুর।  

আমি ও লাইলি ট্যাক্সির সামনে পেছনে আরো তিন যাত্রীসহ কুমিল্লার পথে ছুটছি। নিরবতা ভেঙ্গে আমিই জিজ্ঞেস করলাম তার মায়ের জানাজা কবে হবে। উত্তরে তিনি বললেন তার ভাই নাকি তাকে বলেছে মা এখনও আছে ,শরীর খুবই খারাপ ।  

তবে ভাইয়ের বারবার ফোন করা ও লাইলির আসার সুনির্দিষ্ট সময় জানতে চাওয়ার উদ্দেশ্য যে ভিন্ন তা আমার কিংবা লাইলির বুঝতে কঠিন হওয়ার কথা নয়। আমার মনে হচ্ছিল লাইলির মা’র জানাজার সময় সকাল ১০টা-১১টা নাগাদ। তাই ভাই বারবার তার আসার সময় জানতে চাচ্ছে।

হরতাল অবরোধে বাস না থাকায় ট্যাক্সিতে যে গতিতে আমরা যাচ্ছিলাম তাতে নির্ধারিত সময় লাইলি পৌঁছাবে না বলেই আমি নিশ্চিত ছিলাম। তাই তাকে বললাম ভাই বোনে এ লুকোছাপা না করে সরাসরি কথা বলতে। এ নিয়ে যখন এক সদ্য মাতৃহারার সাথে কথা বলছি তখনি লাইলির ভাই আবার ফোন করে লাইলির আসতে আর কতক্ষণ লাগবে তা জানতে চাইল। আমার পরামর্শেই লাইলি রাগ ঢাক না রেখে সরাসরি বলে ফেলল জোহরের আগে যেন কিছু না করে। হঠাৎই দুমড়ে মুচড়ে কেঁদে উঠল সে।  

আমি বুঝে গেলাম ভাই বোনের মাঝখানের এতক্ষণের অভিনয়ের দেয়াল উঠে যাওয়ায় তা শ্রাবণ হয়ে ঝড়ছে। এরপর কী বলল তা আমি শুনিনি। আমার চোখ ভরে তখন জল এসে গেছে। চোখের পানি মুছতে মুছতেই লাইলি বলতে শুরু করল দারিদ্র্যের সঙ্গে কতটা সংগ্রাম করতে হয় তাকে । তার মা নাকি বহুদিন ধরে অসুস্থ। শেষ রোযার ঈদে মা মেয়ের দেখা হয়েছিল। আমি বোকার মত প্রশ্ন করে বসলাম ‘কোরবানে দেখা হয়নি?’

উত্তরে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলল ‘কোরবান দিবার সামর্থ্য ত আমরার নাই ভাইজান !’ তাই কোরবানের ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে ওভারটাইম করে। ওভারটাইমে টাকা বেশি। ঐ টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা হরলিক্স পাঠিয়েছিল।

কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না । আমাকে বেশিক্ষণ অস্বস্তিতে না রেখে লাইলি বলতে শুরু করল , তার মা নাকি তাকে খুব দেখতে চেয়েছিল। হরতাল, অবরোধে আসতে পারেনি। মাকে একপলক দেখাটাও তাই হলো না। যে মা খেয়ে না খেয়ে তাকে খাইয়েছে তাকে একপলক দেখতে না পারার আক্ষেপ করছিলেন। যাকাতে পাওয়া কাপড় কেটে কিভাবে তাকে ঈদের জামা বানিয়ে দিত সে গল্পও করছিল লাইলি।   টানা এতদিনের হরতাল আর অবরোধের কারণে মাকে দেখতেই পারল না । গতকাল দুপুরেও তার ভাইঝি ফোন করে বলেছিলো ওর ফুফুকে নাকি দাদি দেখতে চায়। তখন লাইলির ছোটবোনটা নাকি মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল মা আমি লাইলি। আমি আইছি মা...মা নাকি চোখ খুলতে পারছিল না তবু বলছিল মারে তরে খুব দেখবার মন চায়।

লাইলি কাঁদছে। কাঁদছে আমার বাংলাদেশ। এই দেশের অর্থনীতির গতিশীল চাকাটিতে সবচেয়ে বেশি গতির সঞ্চার করে যে গার্মেন্টস শিল্প সে শিল্পের একজন শ্রমিক আজ মৃত্যুশয্যায় থাকা মায়ের জীবিত মুখ দেখতে পারে না রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে! আমি প্রচণ্ড আবেগ ও ক্ষোভে তখন ফুঁসছি । লাইলি কথা বলেই যাচ্ছে। আমি তার কথা বুঝতে পারছি না ...আমার চোখে জল।

লাইলির ফোন বাজে । বরাবরের মত সে বলতেই থাকে আমি আসছি। আমি আসছি। আমার স্থবির বাংলাদেশ লাইলির না ফুরানো পথের পানে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য দেখে কাঁদে । থমকে থাকে বাংলাদেশ। আগায় না আমার আর লাইলির বসা ট্যাক্সিটার মত।  

আমার মুখে কথা সরে না। এমন সময় কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয় আমি জানিনা ...আমার নিজেরতো আর এমন অভিজ্ঞতা নাই যে আমি তাকে সান্ত্বনা দিব। আমার মা প্রায়ই বলেন একমাত্র মাই বোঝে সন্তান প্রশবের কী যন্ত্রণা আর কেউ বুঝবেনা বুঝতে পারেও না। আমিও তাই অনুভব করতে পারিনা লাইলিকে বা তার প্রকৃত অনুভূতিকে।

শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় আমরা যখন কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে এসে পৌঁছোই তখন সকাল ৯ টা বেজে ৩ মিনিট । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় হয়ে গেছে। ট্যাক্সি একপাশে দাঁড়াতেই দুজনের ভাড়া দিতে চাইলাম । লাইলি শত দারিদ্রের মাঝেও আমাকে তার ভাড়াটা দিতে দিল না। আমি আত্মসম্মানে বলিয়ান এক লাইলির মাঝে বাংলাদেশকে দেখছি। যে চরম দারিদ্রেও অপরের কাছে মাথা নত করে না।

আরও পড়ুন


খুলনার চার হাসপাতালে মৃত্যু কিছুটা কমেছে

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন পিটার হাস

গোপালগ‌ঞ্জে ট্রা‌কচাপায় এক পু‌লিশ সদস্য নিহত

মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজিতে কেউ সাময়িক সাফল্য পেলেও শেষ অবধি টিকে থাকে ক্লাস


বলে ভাইজান হরতাল অবরোধে বাড়িত আসি নাই কেন জানেন? আমি জানতাম তিনি কেন আসেন নি, অবরোধে অনেক বেশি গাড়িভাড়া লাগে, আমি জানতাম অপরের কাছে ধার করা পাঁচশত টাকা আজ তার বাড়ি যেতে গাড়িভাড়া দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাবে। আমি জানতাম চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর তিনি এর চেয়ে অনেক কম খরচে ট্রেনে যেতে পারতেন। আমি বলিনি। পাছে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে যান। আমার না বলা কথাগুলোই অকপটে বলে ফেললেন লাইলি। তাকে আমার শোকের ভারে ভাবলেশহীন মনে হল। আমি অবাক হলাম তিনি কারো প্রতি কোন অভিযোগই করলেন না! 

পদুয়ার বাজার থকে গৌরীপুরের আর একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিলাম লাইলিকে। ওখান থেকে নাকি চাঁদপুরের গাড়ি পাওয়া যায়। জানিনা লাইলি শেষ পর্যন্ত তার মায়ের লাশটি দেখতে পেরেছিলো কি না। জানিনা তার প্রাপ্য বেতন নারগিস উঠাতে পেরেছিল কি না। আমি এও জানিনা হরতাল, অবরোধ শেষে লাইলি আবার চাকুরিতে ফিরতে পারবে কি না। তবে শেষবার যখন লাইলি আমার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল তখন আমি তাঁর মাঝে আত্মসম্মানে বলীয়ান এক বাংলাদেশকে জেনেছি। আমার মত এক নগণ্য শিক্ষকের জন্য এটা খুব কম জানা নয়।

( লেখাটা সাড়ে সাত বছর আগে লিখেছিলাম। সাড়ে সাত বছরে আমি পেশা বদলেছি, বাংলাদেশে হরতাল নেই বললেই চলে। কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি লাইলিদের। এখনো কারখানার কলাপসিবল গেইট বন্ধ থাকে। আগুনে পুড়ে মরে এদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মানুষেরা। গতকালের অগ্নিদগ্ধ শ্রমিকদের কথা ভেবে পুরনো লেখা আবার দিলাম)।  

লেখাটি কাজী শরীফ (সহকারী জজ ,নোয়াখালী)-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া। (মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv নাজিম