একজন সাধারণ মানুষের কথা ভাবছি | খুব সাধারণ মানুষ | মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে খাওয়া মানুষ | জীবন যাকে পাগলা ঘোড়ার মতো তাড়িয়ে বেড়ায় | জীবন থেকে পালাবার পথ খুঁজে প্রতিদিন | অথচ জীবনের বাস্তবতা যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন পালাবার কোনো গোপন দুয়ার সে খুঁজে পায়না | খুব অসহায় হয় সাধারণ মানুষটা তখন | সে কাঁদতেও পারেনা, হাসতেও পারেনা | থামতেও পারেনা, চলতেও পারেনা |
রেল লাইনের মতো সমান্তরাল সে জীবন | যা জীবনের পথে পা বাড়িয়েও আবার জীবনকে বিপরীত স্রোতের দিকে টানে | যেখানে প্রশ্ন আছে অনেক, তার কোনো উত্তর নেই | যেখানে যাত্রাপথ আছে অগণিত , তার গন্তব্যের কোনো ঠিকানা নেই | জীবনে স্বপ্ন আছে অনেক তবে সেসব স্বপ্নের কাছাকাছি কোনোদিন পৌঁছানো যাবে কিনা সে মানুষটা তা জানেনা | তারপরও কঠিন জীবনের বোঝা মাথায় নিয়ে মানুষটা স্বপ্ন দেখতে জানে, কারণ স্বপ্ন দেখতে তো আর টাকা পয়সা লাগেনা, রাজনীতির শক্তি লাগেনা, ধনসম্পদ লাগেনা |
তার সাধারণ পৃথিবীর রাজা সে নিজেই হয় | তার পরিবারের ঘানি টানা বউটা হয় তার রানী | আর তার কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ছেলে মেয়েরা হয় রাজপুত্র-রাজকন্যা | আমি ইতিহাসের কোনো বড় বড় রাজাদের কথা বলছিনা, সাধারণ মানুষ ক্রমে ক্রমে তার নিজের পৃথিবীতে কিভাবে রাজা হয়ে উঠে সে কথাই বলছি |
আপাতদৃষ্টিতে আমরা যাদের এমন সাধারণ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করি, তাদের জীবনেও ঘটে অনেক অসাধারণ ঘটনা | যা তারা হয়তো কখনো ভাবেনি, ভাবতেও পারেনি | আবার অনেক সময় সাধারণ মানুষরা অসাধারণ অনেক কিছু ঘটিয়ে থাকে, তারা যে এমনটা করতে পারে তা কখনো তাদের মাথাতেও হয়তো আসেনি | তারপরও সে অঘটন ঘটানোর মতো ঘটনার জন্ম দেয় তারা | খুব অদ্ভুত জীবনের কিছু কিছু সমীকরণ হয় | যা অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েও তা উন্মোচন করতে পারেনা | অনেক জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করেও তার রহস্যভেদ করতে পারেনা |
সাধারণ মানুষদের জীবনে অনেক চাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েন থাকে, সে টানাপোড়েনে একটা আনন্দের পৃথিবীও থাকে | কারণ অপূর্ণতার মধ্যেই পূর্ণতার স্বাদ থাকে, গন্ধ থাকে, রস থাকে , যা পূর্ণতার মধ্যে থাকেনা | সেটা বোঝার মতো শক্তি খুব বেশি মানুষের মধ্যে থাকেনা তবে যার জীবনে এমনটা ঘটে সে সাধারণ মানুষটা সেটা বুঝে | সে সাধারণ মানুষটার অনেক টাকা পয়সা থাকেনা, বড় বড় পদধারী ব্যক্তিবর্গ , রাজনীতিবিদ বা তাদের মতো বিত্ত বৈভবে ঠাসা মানুষদের মতো তার ক্ষমতাও থাকেনা | দামি দামি প্রাচুর্যের মায়াজালও তার থাকেনা, মায়াবী পৃথিবীর হাতছানিও তার জীবনে বসন্ত হয়ে ধরা দেয়না | বরং সারাজীবন তার অভাব লেগেই থাকে |
এই অভাববোধ থাকে বলেই সাধারণ মানুষটা তার জীবনকে নিজের মতো করে সাজাতে পারে | সেটা খুব ছোট হয়, খুব নগন্য হয়, অনেকের কাছে অবহেলার বস্তু হয় | অথচ সে মানুষটার কাছে সেটা একটা স্বর্গ হয়, স্বস্তির জায়গা হয়, গৌরবের বস্তু হয় | এই অভাববোধ তাকে শেখায় জীবনকে কিভাবে ছোট ছোট অনুভূতির পরশ পাথরে ঘষে ঘষে সুখের সন্ধান করতে হয় | সুখ কেনা যায়না, সুখ তৈরী করাও যায়না, সুখকে মনে প্রাণে ধারণ করতে হয় | সাধারণ মানুষদের না চাইলেও সেই সুখকে ধারণ করার মন্ত্রটা জানতে হয় |
কারণ অভাব কখনো দরিদ্র হয়না বরং দারিদ্র্যকে মহান করেই অভাব মর্যাদাবান হয়ে উঠে | তার বিন্দু বিন্দু জলকণা যখন সাধারণ মানুষটার গায়ে পড়ে আলো হয়ে উঠে তখন সে মানুষটাই বদলে যায় | পৃথিবীতে অভাবী মানুষরা যতটা সুখী হয়, ধনী মানুষেরা ততটাই অসুখী হয় | সুখ সাধারণ মানুষের ঘরে বাস করে, ধনীদের ঘর থেকে বের হয়ে যায় | কথাটা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য | তার প্রমান পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা | সমাজের প্রতিদিনের চালচিত্রের ছবি | গবেষণার ফলাফল |
আমি একজন সাধারণ মানুষের কথা বলছি | যার পায়ের নিচে আছে শক্ত মাটি, মাথার উপরে আছে আকাশ | সে আকাশটা মানুষটার কাছে ছাতার মতো | যে ছাতার নিচে নিজের দেহটা কোনোমতে গুঁজে মানুষটা নিজেকে যতটা ছোট করে ভাবতে শিখে, মানুষটা তত বড় হয়ে উঠে | সাধারণ মানুষের সে বড়ত্বের কাছে অসাধারণ মানুষদেরও হার মানতে হয় |
লেখক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, বিভাগীয় প্রধান, শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগ, ডুয়েট
(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )
news24bd.tv/আলী