তাহলে কী ক্ষমতা-স্বার্থ-অর্থই আসল, জিহাদ মুখোশ মাত্র?

মো. জাকির হোসেন

তাহলে কী ক্ষমতা-স্বার্থ-অর্থই আসল, জিহাদ মুখোশ মাত্র?

Other

তালেবানরা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য জিহাদ করছে বলে তাদের দাবি। অন্যদিকে, আফগানিস্তানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী উইঘুর যোদ্ধাদের তাদের দেশে আর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে তালেবানের মুখপাত্র। আফগানিস্তান পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে তালেবান।  

সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন জানান, দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তারা চীনের বিনিয়োগের উদ্যোগকে স্বাগত জানাবেন।

শাহিন জানান, বর্তমানে দেশের ৮৫ শতাংশ এলাকা তালেবানদের দখলে আছে। তারা চীনের বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।   

উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে বিশ্বের বৃহত্তম অবিষ্কৃত খনিজ পদার্থের আঁকর আছে। সেখানে আছে তামা, কয়লা, লোহা, গ্যাস, কোবাল্ট, পারদ, সোনা, লিথিয়াম ও থোরিয়ামের খনি।

এসবের আনুমানিক মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।  

শাহিন জানান,  এর আগে, আফগানিস্তানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী উইঘুর যোদ্ধাদের তাদের দেশে আর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আল-কায়েদা কিংবা অন্য কোনো  দল যেন আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, সে বিষয়টিও তারা নিশ্চিত করবেন।

চীন তালেবানদের সঙ্গে কূটনীতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে পরস্পরের বন্ধু হিসেবে নিজেদেরকে  প্রতিষ্ঠিত করেছে। পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর হতে আমাদেরকে বাহির করে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের সহায় নিযুক্ত কর। ”

তাফসিরকারকদের মতে, ‘অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর’বলতে (অবতীর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে) মক্কাকে বুঝানো হয়েছে। হিজরতের পর সেখানে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট মুসলিমগণ - বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট শিশুরা কাফেরদের যুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’আ করতেন। তাই মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, তোমরা ঐ অসহায়-দুর্বল মুসলিমদেরকে কাফেরদের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ কেন কর না? এই আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে আলেমগণ বলেছেন, মুসলিমরা যদি এই ধরনের যুলুম-অত্যাচারের শিকার হয় এবং কাফেরদের বেষ্টনে অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাদেরকে কাফেরদের যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ করা অন্য মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যায়। এটা হল জিহাদের দ্বিতীয় প্রকার। আর প্রথম প্রকার হল, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, প্রচার-প্রসার এবং তাকে জয়যুক্ত করার জন্য জিহাদ করা।

চীনে উইঘুর মুসলিম নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে, ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, বন্দি শিবিরে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো হয়, শরীরে সুই ফুটিয়ে নির্যাতন করা হয়, প্লাইয়ার দিয়ে তুলে নেয়া হয় নখ।  

বিবিসির আরেক প্রতিবেদনে প্রকাশ, চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের জন্য যেসব ‘পুনঃশিক্ষণ’ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে- তাতে নারীরা পরিকল্পিতভবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। এই নারীদের একজন হচ্ছেন তুরসুনে জিয়াউদুন।
বিবিসিকে দেয়া তার এই বর্ণনা তিনি বলেছেন, তখন কোনো মহামারি চলছিল না কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকত। কখনও কখনও তারা আসত মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমতো কোনো একজন নারীকে বেছে নিত। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোনো ক্যামেরা ছিল না।  

তিনি বলছেন, ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তার পর মুখোশপরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করত। জিয়াউদুন বলেন, শিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এই গোপন বন্দি শিবিরে বাস করেছেন মোট ৯ মাস। এই সময়ে তিনি নিজে তিনবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরের দরজায় লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কোড, বসানো হয়েছে মুখ দেখে শনাক্ত করা যায় এরকম ক্যামেরা। ফলে কোন বাড়িতে কারা যাচ্ছেন, থাকছেন বা বের হচ্ছেন তার উপর কর্তৃপক্ষ সতর্ক নজর রাখতে পারছে। তাদেরকে নানা ধরনের বায়োমেট্রিক পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন:


লকডাউন শিথিল থাকবে ৮ দিন

করোনার মধ্যে ডেঙ্গু যেন মাথাব্যথার কারণ না হয়: এলজিআরডি মন্ত্রী

ডিএনসিসির অভিযানে ২১ মামলায় প্রায় ৩ লাখ টাকা জরিমানা


চীনা গবেষক আদ্রিয়ান জেনজের লেখা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে নতুন এক তথ্য। প্রতিবেদনে প্রকাশ, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুসলিম নারীদের দেহে জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্র বাসনো বা বন্ধ্যা করানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে চীন। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় ও অন্য স্বাধীনতার ক্রমে ক্রমে হরণ করেছে এবং গণ-নজরদারি, বন্দিত্ব, ধর্ষণ, মগজ ধোলাই এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণের ভয়ংকর নিপীড়নমূলক এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই নীতির উদগাতা।

এই অবস্থায় চীন-তালেবান বন্ধুত্ব, চীনকে খুশি করতে উইঘুরদের আশ্রয়দান বন্ধের ঘোষণা ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তালেবানী জিহাদের মধ্যে সমীকরণ মেলাতে পারছি না। তাহলে কী ক্ষমতা-স্বার্থ-অর্থ-ই আসল, জিহাদ মুখোশ মাত্র?

লেখাটি অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন (আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv নাজিম