বাঙালিকে বিশ্বজয় করতে হলে তাকে তার পান্তা ভাত দিয়েই এগুতে হবে

বাঙালিকে বিশ্বজয় করতে হলে তাকে তার পান্তা ভাত দিয়েই এগুতে হবে

Other

মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আমার উপরে রাগ করবেন না। আখেরে ফায়দা হবে। এই ছবিটা দেখুন।

ছবিটা তুলেছেন আলফ্রেড স্টিয়েগলিৎস। তিনি আমেরিকার অন্যতম সেরা একজন ফটোগ্রাফার। যারা ফটোগ্রাফিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার কথা আরেকদিন বলবো।
বরং এই ছবির বিষয়টা নিয়ে কথা বলি।

এই ছবিটা হলো একটা ইউরিনালের। ইউরিনাল হলো পুরুষদের মুত্রদানি। তো যেটাতে পুরুষরা মুত্র বিসর্জন করে সেটা কি কখনো আর্ট ওয়ার্ক বা শিল্পকর্ম হতে পারে? পারে। সত্যি বলছি এই প্রশ্নের মিমাংসা আরো শত বছর আগেই হয়ে গেছে। তাহলে ঘটনাটা খুলে বলি। ফ্রেঞ্চ-মার্কিন শিল্পী মার্সেল দ্যুশাম্প শিল্পকলার জগতে এক অদ্ভূত লোক। তিনি একই সঙ্গে চিত্রকর, ভাস্কর, লেখক এবং দাবাড়ু। তো এই দ্যুশাম্প মহাশয় তার শিল্প জীবনে কিউবিজম, দাদাইজিম এবং কনসেপচ্যুয়াল আর্টর চর্চা করেছেন। পাবলো পিকাসো, অঁরি (হেনরি) মাতিসের সঙ্গে একত্র হয়ে তিনি কনসেপচুয়াল আর্ট ও প্লাস্টিক আর্টের বিকাশ করেছেন।

news24bd.tv

কথাগুলো একটু খটমট লাগছে? লাগতেই পারে। ইচ্ছা করেই একটা জটিল আবহ তৈরি করলাম। মোদ্দাকথায় বোঝাতে চাইলাম দ্যুশাম্প বেশ কেউকেটা শিল্পী ছিলেন। অবশ্য বোঝানোর কিছু নেই, তিনি আদতে এই জগতের আধুনিক শিল্পকলার হোমড়াচোমড়া হিসাবেই গণ্য হন।

কিন্তু ১৯১৭ সালে তিনি এক কাজ করলেন। সেই কাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম ভয়াবহ নন। দ্যুশাম্প কী করলেন একটা ইউরিনাল যোগাড় করলেন। সেটাতে "R. Mutt" (একটি কাল্পনিক নাম) স্বাক্ষর করে দিলেন। তারপর এটিকে উল্টো করে নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল প্যালেসের প্রদর্শনীতে বাঘা বাঘা শিল্পীদের ভাস্কর্য আর চিত্রকলার পাশে প্রদর্শনের জন্য এটি পাঠিয়ে দিলেন।

ব্যস, শিল্পকলার ইতিহাসে শুরু হয়ে গেলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভাবা যায়, একটা মূত্রদানিকে এক্সিবিশনে এনে বসিয়ে দেয়া? এ তো মান সম্মানের ব্যাপার। ওই প্রদর্শনীর নীতি অনুযায়ী যারাই নির্দিষ্ট ফি দিয়েছিলো তাদের কাজ তারা দেখাবেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু নীতি নির্ধারকরা এটিকে মূল প্রদর্শনীর স্থানে ঠাঁই দিলেন না। হলের বাইরে প্রতিস্থাপন করলেন। তখন ফটোগ্রাফার আলফ্রেড স্টিয়েগলিৎস দুশ্যাম্পের এই ইউরিনালের ছবি তুললেন তার নিজের স্টুডিওতে এনে। দ্যুশাম্প তার এই ইউরিনালের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ফাউন্টেইন’। তো এই ঝর্ণাখানির ছবি ছাপা হলো ‘দ্য ব্লাইন্ড ম্যান’ নামের নামকরা শিল্প জার্নালে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিশ শতকের সেরা আভা গার্দ (নিরীক্ষাপ্রেমী, অগ্রগামী) সমালোচকরা দ্যুশাম্পের এই কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।

দ্যুশাম্পও বললেন, কেন একটা ভাস্কর্য, ছবি আঁকতেই হবে, কেন শিল্পকলাকে তৈরিই করতে হবে। তৈরি হওয়া কোন একটা বস্তুকে নতুন দৃষ্টিতে দেখাতে পারাও তো শিল্পকলার কাজ। প্রচলিত মূল্যবোধ আর শিল্প ধারণার বাইরে দ্যুশাম্প প্রমাণ করলেন, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু থেকেও শিল্পকর্ম তৈরি করা যায়। শোনা যায়, এরপর দুশ্যাম্প এই ফাউন্টেন তার অনুমতিক্রমে আরো ১৬টি রেপলিকা তৈরি করা হয়েছিলো নানা গ্যালারির জন্য। পরবর্তীকালে Marcel Duchamp খুঁজে পাওয়া বস্তু দিয়ে (ফাউন্ড অবজেক্ট) আরো অনেক শিল্পকর্ম করেছেন। কখনো বা সেই বস্তুর তেমন কোন অদলবদলও করেননি। তো ওই যে বলছিলাম কনসেপচুয়াল আর্ট সেটা আসলে দুশ্যাম্পের মতো সাহসীরা প্রতিষ্ঠা করেছে। আজকের দিনে শিল্পকলা চর্চার স্বাধীনতা এনেছে দুশ্যাম্পের উদ্যোগ।

ধান বানতে শিবের গীত শেষ হলো। এইবার আসি কিশোয়ারের কথায়। শিল্পকলার মতো রান্নাবান্নাতেও অনেক প্রচলিত ধারণা আছে, নাক উঁচু ব্যাপার আছে। অন্তত এই বঙ্গদেশে ঘরে ঘরে নারীরা প্রতিদিন রাঁধেন। তাদের কারো হাতের লাউয়ের ঘন্ট, কারো কচুর লতি, কারো কাঁঠালের বিচির ভর্তা সত্যিই বিশ্বমানের। কিন্তু আমরা স্বীকৃতি দিতে রাজি না। এ আর এমন কি! এ তো যে কেউই বানাতে পারে। জনাব, যে কেউ ঠিক মতো হাঁটতেও পারে না, বসতেও পারে না। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না এ দেশের ৯৮ ভাগ লোক জানেই না কিভাবে বসা, কিভাবে হাঁটাটা যথার্থ এবং স্বাস্থ্যকর। অথচ এই আটানব্বই ভাগ লোক ভুল ধরায় ব্যস্ত।

আমি নিজে রান্নাবান্না করি শখে। বিশ্বাস করুন, আমার বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক স্থান রান্নাঘর। ধারালো ছুরি, বটি, দা, বিপদজনক গ্যাস, আগুন, তেল, ম্যাচ, লাইটার এই সব কিছুর মাঝখানে ঠিকঠাক রান্না করা সত্যিই একটা বড় কাজ। তো এই কাজটা যারা নিয়মিত ঠিকঠাক করেন তাদের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা। আমি পারতপক্ষে কারো রান্নাকে খারাপ বলি না। কারণ আমি জানি, এর মাঝখানে যেমন আগুনে, গরমে, কাজের কষ্ট আছে তেমনি তীব্র ভালোবাসা, মায়া না-থাকলে একটা রান্না উতরায় না।

তো বিশ্বব্যাপী এই ঘরোয়া প্রতিদিনের রান্নাটাও ব্যবসায়িকভাবে জটিল আকার ধারণ করেছে। ফ্রান্সে যে হ্যয়টে কুজিন তৈরি হয়েছে তা কেবল বিশাল বড়লোকদের জন্য। বড় বড় রেঁস্তোরায় রান্নার চেয়ে পরিবেশন, দামী ও দূর্লভ উপাদানের ব্যবহার রান্না ব্যাপারটাকে জটিল করে তুলেছে। বিষয়টা ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক। এই প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলার ঘরের সাধারণ রাঁধুনি থেকে সেফ হয়ে ওঠা যেন মহল্লার মেয়েটির এভারেস্ট জয়ের সমানই। কিশোয়ার সেই এভারেস্ট জয় করেছেন। তবে তার জয় এসেছে দ্যুশাম্পের মতো সাহসী কনসেপচুলয়াল ধারণা থেকে। জটিল জটিল সব রান্নার সামনে বিশ্বের সেরা একটি রান্না প্রতিযোগিতায় সে পরিবেশন করছে জাও ভাত, লাউ-চিংড়ি, খাসির পায়া (নেহারি), এমনকি পান্তা ভাত, আলু ভর্তা, মাছ ঝোল! এই পরিবেশন করতে সাহস লাগে, মেধা লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে। আপনি আমি তো হীনমন্য। শুরুতেই ভাবতাম, সে কি, এতোবড় প্লাটফর্মে আমার এই সামান্য জিনিস কেউ খাবে।  

কিশোয়ার কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছে, আমি আপনাদেরকে এমন জিনিস খাওয়াবো যা কোন হোটেলে পাওয়া যায় না। এ কেবল ঘরে হয়, আমাদের ঘরে। এই যে নিজের জিনিস, নিজের ঘরের জিনিস উপস্থাপনের শক্তি আর সাহস এটা বড় গভীর বোধ থেকে আসে।

আরও পড়ুন


সাতক্ষীরায় মেডিকেলে আজও ৯ জনের মৃত্যু

তাঁর কবিতা পড়ে বুঝলাম উনি শব্দ নয়, বাক্যকে আক্রমণ করে

সংলাপের ওপর নির্ভর করছে তালেবানের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা: ইরান

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষকসহ নিহত ২


আমাদের অধিকাংশ লেখক নোবেল পুরস্কার পেতে চান, সিনেমার লোকেরা অস্কার পেতে চান। এই চাওয়াটা দোষের না। কিন্তু দোষটা হলো অন্যসব অস্কারজয়ী বা নোবেল জয়ীর মতো করে ভাবতে চাওয়া। আপনার সবচেয়ে বড় শক্তিটা আপনার নিজস্বতা, সেটা আসে আপনার সমাজ, পরিবার, দেশ থেকেই। বাংলাদেশে বসে মুম্বাইয়ের ভঙ্গিতে ক্রাইম থ্রিলার যদি বানাই তা যতোই ভালো হোক অনুরাগ কাশ্যপকে ছাড়িয়ে যাবো না। যেতে পারবো না। সেটা পারলেও কখনোই রোমান পোলানস্কি বা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলাকে ছাড়িয়ে যাবো না।

বাংলাদেশের মানুষের শক্তি হলো পথের পাঁচালি, মেঘে ঢাকা তারা কিংবা মাটির ময়নাতে। তেমনি বাংলাদেশকে খুঁজে পাবো বিভূতিভূষণ কিংবা হাসান আজিজুল হকে। তারা যদি মেজিকফ্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে মেতে থাকতেন তারা বড় জোর একজন ভালো অনুসারী হতেন। তো রান্নার ক্ষেত্রে কিশোয়ারের কাছ থেকে এটাই আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে যে পাস্তা, পিৎজা শখ করে আমরা খেতেই পারি। বানানোতেও দক্ষতা অর্জন করতে পারি। কিন্তু ইতালির সেরা সেফকে ছাড়িয়ে যেতে পারবো না। কারণ এটা ইতালির মানুষের রক্তে, জিনে মিশে আছে। ঠিক বাঙালিকে বিশ্বজয় করতে হলে তাকে তার পান্তা ভাত, জাও ভাত, লাউ, মাছ দিয়েই এগুতে হবে। কথাটা শুধু রান্নায় নয়, সিনেমায়, সাহিত্যেও প্রযোজ্য।  

আমি দ্যুশাম্পের মতো, কিশোয়ারের মতো, সাদের মতো সাহসীদের সালাম জানাই। সাদের ছবিটি আমি দেখিনি, এখনও দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু আমার কমন সেন্স থেকে ধারণা করতে পারি সে কোন থ্রিলার ফিলার বানায়নি। এমন কোন গল্পই বানিয়েছে যা বাংলাদেশের। যে ছবিতে, গল্পে, রান্নায় আমার দেশের গন্ধ আছে তাই দেখবে, খাবে মানুষ। এখনও আমাদের দেশে যেমন অকর্ষিত জমি রয়ে গেছে প্রচুর, তেমনি অনেক অজানা ক্ষেত্র রয়ে গেছে বিশ্ব জয়ের অপেক্ষায়। অপেক্ষার ফল মধুর হোক।

news24bd.tv এসএম