করোনা পরবর্তী জটিলতায় কী করণীয়

করোনা পরবর্তী জটিলতায় কী করণীয়

Other

প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা ক্ষেত্রের নানা বিপর্যয়কে পরাজিত করে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজতর করেছে। উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে বহু জটিল রোগের নিরাময়ের সন্ধান খুঁজে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে নতুন জীবনের আলো দেখিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্ব এক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে।

ইতোমধ্যেই করোনার ছোবলে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে অনেককেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি মানুষের দেহকোষের ভেতরে মিউটেট করছে অর্থাৎ গঠনগত পরিবর্তন এনে নতুন রুপ নিচ্ছে যা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

সাধারণত যে ব্যক্তিটি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়েছে। কিংবা মৃদ্যু উপসর্গ নিয়ে বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন, করোনা থেকে সেরে উঠার পরও তার মধ্যে যদি সেই উপসর্গগুলো থাকে এবং তার সাথে অন্যান্য নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে এগুলোকে বলা হয় করোনা পরবর্তী জটিলতা / Post Covid Complication ।

পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোম তখনই বলা হয়, যখন করোনা পজেটিভ বা করোনা আক্রান্ত হওয়ার ১৪-২১ দিন পরও তার বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ শরীরে অবস্থান করে। করোনা পরবর্তী জটিলতাসমূহ ৩-৪ মাস পযর্ন্তও দীর্ঘায়িত হতে পারে। করোনা পরবর্তী জটিলতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্নতর হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন হবে। করোনা পরবর্তী জটিলতা সমূহ -

মারাত্মক দুর্বলতা

করোনা থেকে সেরে উঠার পরও রোগীদের মধ্যে যেই সমস্যাটি সবথেকে বেশি দেখা যায়, তা হল প্রচন্ড বা মারাত্মক দুর্বলতা। অনেকে অল্প হাঁটা-চলা বা অল্প পরিশ্রমেই অনেক বেশি দুর্বলতা অনুভব করেন। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, ভিটামিনযুক্ত খাবার ও প্রোটিন জাতীয় খাবার করোনা পরবর্তী শরীর পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাবারের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাল্টিভিটামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।

ঘুমের সমস্যা

করোনা আক্রান্ত হবার পর থেকেই রোগীদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে থাকে (কাশি, চিন্তা ও অন্যান্য কারণে)। পরবর্তীতে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও রোগীরা নিদ্রাহীনতায় ভুগেন। প্রতিদিন নিদিষ্ট সময় করে ঘুমাতে যাওয়া, রাতে ঘুমের আগে নিয়ম মেনে সহনীয় মাত্রায় অল্প ব্যয়াম করে ঘুমাতে যাওয়া ও চিকিৎসকের পরার্মশ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ সেবন ঘুুমের সমস্যা থেকে মুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

চুল পড়ে যাওয়া

করোনা পরবর্তী জটিলতায় পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই (অনেকের মধ্যেই) চুল পড়ার সমস্যাটি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ভিটামিন “ই” জাতীয় ক্যাপসুল, বায়োটিন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে চুল পড়া সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপনড়ব হওয়া প্রয়োজন।

স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া

করোনা পরবর্তী সময় অনেকেই স্বল্প সময়ের স্মৃতি ভুলে যাওয়া কিংবা পূর্বের অনেক কথাই সঠিকভাবে স্মরণ করতে না পারা - এ ধরণের জটিলতায় ভুগছেন। এক্ষেত্রে পূর্ণ বিশ্রাম, অবসর সময়ে বিনোদন, পারিবারিক সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব।

শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা

শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শ্বাস আটকে আটকে যাওয়া, বুকে চাপ ধরে থাকা কিংবা মৃদ্যু কাশি - মূলত শ্বাসতন্ত্রের এই সমস্যাগুলোই বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে ফুসফুসের সাধারণ ব্যায়াম অর্থাৎ নাক দিয়ে নিশ্বাস নিয়ে ৭-১০ সেকেন্ড ধরে রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস বের করা- এই ব্যয়ামটি শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় সাময়িক প্রশান্তি দিবে। এছাড়া যারা ধুমপায়ী, তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধূমপান পরিহার করতে হবে।

হার্টের সমস্যা

এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত হবার পর প্রায় ৬০-৮০ ভাগ রোগীর হৃদপিন্ড করোনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বুকে এক ধরনের চাপা ব্যথা অনুভব করা, বুক ধরফর করা, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, এই ধরণের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপনড়ব হতে হবে।

মস্তিষ্কের সমস্যা

মাথা ব্যথা, দুশ্চিতা, ব্রেন স্ট্রোক সহ মস্তিষ্কের সমস্যাও করোনার পরবর্তী জটিলতা হিসেবে দেখা দিতে পারে। খাবারে অরুচি, গ্যাসের সমস্যা, এলার্জির সমস্যাগুলোসহ নতুন নতুন কিছু জটিলতা বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে। যাদের ধুলাবালি ও খাবারে এলার্জির সমস্যা রয়েছে, তাদের ধুলাবালি থেকে বাচঁতে মাস্ক ব্যবহার করা ও এলার্জী জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় শ্বাসতন্ত্রের ব্যয়ামের সাথে স্পাইরোমিটার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে স্পাইরোমিটার এর ব্যবহার পদ্বতি সঠিকভাবে জেনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ জনিত জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন, তাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

করোনা পরবর্তী জটিলতা এড়াতে রোগীকে অবশ্যই উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। রোগীর নির্দিষ্ট সময় পর পর ফলোআপ নিশ্চিত করতে হবে, তবে উপর্সগ জটিল আকার ধারণ করলে দ্রুত চিকিৎসক ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে।

নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে করোনা পরবর্তী জটিলতা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। করোনা পরবর্তী জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

লেখক: ডাঃ সামিউল আউয়াল সাক্ষর, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, এভারকেয়ার হাসপাতাল ঢাকা।

news24bd.tv এসএম