কর্মসংস্থানের নামে মানুষের ছোটাছুটি বন্ধ হোক

মুম রহমান

কর্মসংস্থানের নামে মানুষের ছোটাছুটি বন্ধ হোক

Other

মানুষ তার সারা জীবন লড়াই করে, পরিশ্রম করে, অন্ন- বস্ত্র-বাসস্থান আর প্রিয়জনের জন্য। কাল এক প্রিয়জনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো; সে বললো- ভাই, আমি কষ্ট করি, কারণ ভাতের কষ্ট কি আমি জানি। আমার সন্তানকে আমি এই কষ্ট জানাতে চাই না।

মানুষ সব সময়ই চায় ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।

দুধ-ভাত মানে আয়েশ করে খাওয়া। এই নগরে, ঢাকা নগরে, প্রতিদিন লক্ষ মানুষ ছুটছে, লড়াই করছে, সাধনা করছে দুটো ভাত-কাপড়ের জন্যই। কিন্তু তারা এই নগরের নয়।  

বড় শহর, রাজধানী, সেই কারণে এখানে এসেছে দিনমজুর, রিকশাঅলা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা বাধা-ধরা চাকরিজীবি।

এদের কারো জীবন কিন্তু এই নগরের সঙ্গে কোনো মায়ার টানে জড়িত নয়। এরা অনেকটা সাময়িক উদ্বাস্তু কিন্তু আংশিক শরণার্থী। নিজের ছোট্ট শহরে বা গ্রামে নেই তার উপার্জনের উপায়। সেই উপায় খুঁজতেই এখানে ট্রাফিক জ্যাম আর পরিবেশ দূষণ ঠেলে ঘুরছে সে। কখনো-বা দিকভ্রান্ত।  

এই দিকভ্রান্ত মানুষের শেকড় আছে, নাড়ির টান আছে, মায়ের মায়া আছে। সেটা আমরা বলি ‘দেশ’; দেশের বাড়ি। কি অদ্ভূত আর বিস্ময়কর ব্যাপার! আপনার দেশ কোথায়? বাংলাদেশ। দেশ তো আমাদের একটাই। অথচ কি অবলীলায় আমরা সবাই প্রশ্ন করি ‘আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?’ কিংবা ‘আপনার দেশ কোথায়’।  

আর উত্তরদাতা বলেন, কুমিল্লা কিংবা সরিষাবাড়ি, কিংবা পঞ্চগড়, কিংবা শ্যামনগর, কিংবা কালাচাঁদপুর কিংবা সাতকানিয়া। যারা উত্তর দেন, নিঃসন্দেহে তারা প্রথমেই বাংলাদেশী। কিন্তু তাদের বুকের ভেতরে যে বাংলাদেশের ছবি তারা এঁকেছেন সেটা তার নিজের জন্ম শহর কিংবা গ্রামের ছবি। যেখানে তার মা আছে, বাবা আছে, আছে পরিবার পরিজন, তারচেয়েও বেশি করে আছে তার বেড়ে ওঠার স্মৃতি, শৈশবের প্রথম পাঠ, কৈাশোরের প্রথম প্রেম, আরো সব প্রথম স্বাদ-গন্ধের আনন্দ-বিষাদ।  

সারাদিন-রাত এই বিরাট দালান, অনেক দামী গাড়ি আর বড় বড় মার্কেটের চক্করে পাক খেয়েও এই দেশের অধিকাংশ মানুষ একটু ছুটি পেলে, আয়-রোজগারের ফাঁকে সামান্য অবসর পেলে ছুটে যায় তাই তার দেশে। দিনের পর দিন এই ঢাকায় বাস করলেও ঢাকা তার দেশের বাড়ি হয় না। কেউ কেউ হয়তো অতি উচ্চাকাঙ্খায় স্বপ্ন দেখেন- এই ঢাকায় তার একটা বাড়ি হবে, নিদেন পক্ষে ফ্লাট। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বড় হবে রাজধানীতে।

কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ফারাকটা বাড়তেই থাকে। বাপ-দাদার ভিটা থেকে সরতে থাকে মানুষ। এই সরতে থাকা মানুষ শৌখিন নয়। দুটো উপার্জন, খাদ্য, পোশাক, মাথা গোজার স্থায়ী নিরাপত্তার কারণেই মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। এই স্থানান্তর তীব্র হয়ে আমাদের চোখে পড়েনি তেমন। ঈদে টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় নদীপথে ফেরিতে বা সড়কপথে তীব্র যানজটের ছবি বা প্রতিবেদনে প্রতি বছর ধরা পড়ে।  

বাড়ি যাওয়া, নাড়ির টানে ঘরে ফেরা, দেশে গিয়ে ঈদ-পূজা করার এই যাতায়াত প্রবণতায় ঝরে গেছে অনেকের প্রাণ; দুর্ঘটনায়। কিন্তু পৃথিবী এখন বড় অসুস্থ। সড়ক-নদী কিংবা বিমানপথের দুর্ঘটনার চেয়েও বেশি মানুষ এখন নতুন ভাইরাসের কারণে হিমশিম খাচ্ছে।  

সার্বক্ষণিক মুখোশ, নিয়মিত হাত ধোয়ার অবধারিত এই সংকটকালেও মানুষ মানছে না নৈকট্যের বাধা। গায়ে গা ঘেঁষে ছুটে চলছে দেশের টানে, স্বজন আর স্মৃতির পানে। এই ছুটে চলায় বাড়ছে কোভিড ১৯-এর ঝুঁকি। সকলের মাঝে একজন দুজনের অসচেতনতায় ছড়িয়ে পড়ছে করোনা নামের অসুখ। আর আমরা, ঘরে বসে দুষছি একে অপরকে।  

কিন্তু সহজ জিনিসগুলো আমরা ভুলতে বসেছি এই কঠিন সময়ে। প্রথম কথাটাই তো- মানুষ হবে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। মানুষ মানুষের কথাই ভাববে আগে। সেটা যদি ভাবি, তবে এখন ভেবে দেখার সময়, এই যে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশ, এর প্রতিটি কোণা দেশ হয়ে উঠুক। যেখানে জন্মেছে যে, সে সেখানেই তার বেঁচে থাকার উপাদান খুঁজে পাক।  

কর্মসংস্থানের নামে মানুষের ছোটাছুটি বন্ধ হোক। তাতে করে সকল দুর্ঘটনা আর রোগের বিস্তার যেমন কমবে তেমনি বাড়বে স্থানীয় উন্নয়ন। হ্যাঁ, আজকের একবিংশ শতাব্দীর প্রান্তে এসে আমাদের ভাবতে হবে, উন্নয়ন কোনো প্রক্ষিপ্ত ব্যাপার নয়। খালি বেশি বেশি খেয়ে ভূঁড়ি বানালে যেমন সুস্থ থাকা যায় না, তেমনি কেন্দ্রীভূত উন্নয়নের জোয়াড় দিয়ে দেশকে, দেশের মানুষকে সুস্থ রাখা যায় না।  

বিকেন্দ্রীকরণের কথাটা আমাদের মুরব্বীরা বহু বছর ধরেই বলে আসছে। কিন্তু শুনছে কি কেউ? এমন তো হতেই পারতো ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে নানা রকম পেশার মানুষ। ধরা যাক, কুমিল্লা কিংবা ময়মনসিংহে গড়ে উঠলো তথ্য-প্রযুক্তির প্রধান প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনাগুলো। খুলনা কিংবা রাজশাহীতে গড়ে উঠলো পোশাক শিল্প। রংপুর কিংবা চট্টগ্রামকে করা হলো খাদ্য ও ওষুধ শিল্প। ইত্যাদি ইত্যাদি।  

আরও পড়ুন:


এবার তিউনিসিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বহিষ্কার করলেন প্রেসিডেন্ট

মাহফুজ আনামের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সম্পাদক পরিষদ থেকে নঈম নিজামের পদত্যাগ

গ্রামীণফোনকে হু্মায়ূন পরিবারের আইনি নোটিশ


এভাবে অন্তত পক্ষে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতা থাকবে না। বাস করবে এক জায়গায়, পরান পড়ে থাকবে আরেক জায়গায়- এভাবে তো কোনো মানুষ নিজেও শান্তি পায় না, অন্যকেও শান্তি দেয় না। শান্তি আর স্বস্তির জন্য মানুষ যদি তার নিজের সীমানাতেই দুটো ভালো খেতে পারে, সুন্দরভাবে বসবাসের সুযোগ করে নিতে পারে তবে সে তো ছুটবে না। তখন সে হয়তো ঢাকা আসবে বেড়াতে, কুমিল্লা কিংবা পাবনা যাবে বেড়াতে। আত্মীয়তা, বেড়ানো, ভ্রমণ তার মধ্যেই একদিন বিনিময় হবে ভালোবাসার।  

অহেতুক এই দেশে নগরীতে ফেরার টানাপড়েন স্বীকার করে দুর্ঘটনায় কিংবা রোগ বিস্তারে মরবে না এই দেশের মানুষ। এমন একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়তো করা যায়, যাবে, কোনো একদিন।

লেখাটি মুম রহমান-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  (সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv নাজিম