তীব্র বেগে মহাকাশে ছুটল ‘বঙ্গবন্ধু-১' (ভিডিও)

তীব্র বেগে ছুটল ‘বঙ্গবন্ধু-১I ছবি: স্পেস ফ্লাইট ইনসাইডার

মহাশূন্যে লাল-সবুজের বাংলাদেশ

তীব্র বেগে মহাকাশে ছুটল ‘বঙ্গবন্ধু-১' (ভিডিও)

দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বপ্ন হলো সত্যি। মহাকাশে গেল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট 'বঙ্গবন্ধু-১'। উন্নয়ন ও সাফল্যের মুকুটে যোগ হলো আরও একটি পালক। ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠাল বাংলাদেশ।

সবকিছু ঠিক থাকলে ১০ দিন পর মহাকাশের নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে পৌঁছাবে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক বঙ্গবন্ধু-১। এক মাস পর পাওয়া যাবে এর পূর্ণাঙ্গ সেবা।

গত রাতে দেশে-বিদেশে কোটি বাংলাদেশি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। মহাকাশে যাবে লাল সবুজের গৌরবগাথা।

নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হবে প্রিয় দেশ। প্রিয় মাতৃভূমি।  

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ২টা ১৪ মিনিট। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে তারও আগে। গোটা দেশের কোটি কোটি চোখ তখন টিভি পর্দায়। কেউ আবার বিছানায় শুয়ে মোবাইলে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের লাইভ সম্প্রচার চালু করে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই স্বপ্ন হলো সত্যি! যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে তীব্র বেগে মহাকাশে ছুটল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ রকেটে চেপে আকাশে উড়াল দেয় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের এই স্যাটেলাইট। রকেটটি মহাকাশে বাংলাদেশের ভাড়া নেওয়া অরবিটার স্লট ১১৯.৯ ডিগ্রিতে নিয়ে যাবে স্যাটেলাইটটিকে।  

আরও পড়ুন: যে সুবিধা দেবে বঙ্গবন্ধু-১

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে সফল উৎক্ষেপণের জন্য দেশবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, এ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করল। জাতি হিসেবে এটা অনেক গর্বের ও আনন্দের। তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের স্থায়িত্ব কামনা করেন।

উৎক্ষেপণের পর দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধন্যবাদ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে উৎক্ষেপণের সময়সূচি নির্ধারিত ছিল। সব প্রস্তুতি সেরে উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু মিনিটখানেক আগে সমস্যা দেখা দেওয়ায় স্যাটেলাইটটি আর ওড়েনি লঞ্চ প্যাড থেকে।

উৎক্ষেপণের সময় কেনেডি স্পেস সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘উৎক্ষেপণের শেষ মিনিট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে। কম্পিউটারের হিসাবে কোনো কিছু স্বাভাবিকের বাইরে ধরা পড়লে তা উৎক্ষেপণ কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়।

বৃহস্পতিবার উৎক্ষেপণের মাত্র ৪২ সেকেন্ড আগে তা বন্ধ করে দেয়। স্পেসএক্স আবার সবকিছু পরীক্ষা করবে এবং শুক্রবার একই সময়ে আবার উৎক্ষেপণের চেষ্টা করবে। রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেওয়া হয় না। তাই এ রকম হওয়াটা ‘খুবই স্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন জয়।

বহু আগেই বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। অবিস্মরণীয় এক অর্জন হলো লাল-সবুজের। কৃত্রিম স্যাটেলাইটটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ২২ হাজার মাইল ওপরে অবস্থান করে প্রায় ৪০ ধরনের সেবা দিয়ে যাবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে। এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কেপ ক্যানাভেরালের স্যাটেলাইট লঞ্চ প্যাডে পৌঁছেন।  

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে প্রকল্প পরিচালক মেজবাহুজ্জামান জানিয়েছিলেন, এই স্যাটেলাইটটির বহনকারী প্রায় সাত টন ওজনের রকেট সোজা আকাশে উঠে যাবে। দুটি পর্যায় শেষে এটি কার্যকর হবে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে উৎক্ষেপণ ও প্রাক্-কক্ষপথ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কক্ষপথে স্যাটেলাইটটি বসানোর কাজ। কক্ষপথে যাওয়ার আগে এটিকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার যেতে হবে। প্রথম পর্যায়টি সম্পন্ন হতে লাগবে ১০ দিন। দ্বিতীয় পর্যায়টি সম্পন্ন হতে লাগবে ২০ দিনের মতো। স্যাটেলাইটটি কার্যকরের পর এর নিয়ন্ত্রণ যাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ায় অবস্থিত তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে। এ তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করে একে ৩০০ কিলোমিটার দূরে কক্ষপথের ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমায় নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করবে। তবে ফ্যালকন রকেটের চারটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে স্যাটেলাইট এবং এরপর অ্যাডাপটর। অ্যাডাপটরের নিচের অংশটিকে বলা হয় স্টেজ-২ এবং শেষের অংশকে স্টেজ-১। শুরুতে প্রচণ্ড গতিতে রকেটটি আকাশের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় আগুনের গোলা দেখা যাওয়ার কথা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-১ খসে পড়বে। এরপর স্টেজ-২ রকেটটিকে নিয়ে যাবে ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। কক্ষপথে পৌঁছানোর আগে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা হবে স্যাটেলাইটটিকে। যখন এটি সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে তখন এর নিয়ন্ত্রণভার হস্তান্তর করা হবে বাংলাদেশে অবস্থিত গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোয়।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের যে ৭ তথ্য জানা দরকার

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে বাংলায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি লেখা রয়েছে। এ স্লোগান নিয়েই কক্ষপথের দিকে ছুটবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাকাশে উৎক্ষেপণে প্রস্তুত হওয়া বঙ্গবন্ধু-১ কক্ষপথে পৌঁছলে বাংলাদেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইট কাজে লাগানো যাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণও করা সম্ভব হবে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, এ স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্যাটেলাইটের স্বপ্ন দেখলেও বাংলাদেশে স্যাটেলাইট নিয়ে প্রথম কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এ আপত্তির বিষয়টি এখনো সমাধান হয়নি। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়। পরে শুরু হয় স্যাটেলাইট তৈরির কর্মযজ্ঞ। পুরো প্রক্রিয়া দেশের বাইরে হলেও এর বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এ কাজ হয়েছে। এগুলো হলো— স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে রওনা দেয়।

আকাশে বালাদেশের স্যাটেলাইটটির ফলে টেলিভিশন সম্প্রচার পদ্ধতি আরও সহজ হবে। পাশাপাশি খরচও কমবে। ফলে খরচ কমবে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর। আবার বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া নিতে হয় বলে যে বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যায়, সেটিও আর যাবে না।

সরকার আশা করছে, এ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পর বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১৩ কোটি টাকা) সাশ্রয় হবে বাংলাদেশের।

এটি থেকে বিদেশি মুদ্রাও আসবে। স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকিগুলো ভাড়া দেয়া হবে।

স্যাটেলাইটির নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করার জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত খবর