আপনার বিরুদ্ধেও হতে পারে হত্যা মামলা!

সৈয়দ বোরহান কবীর

আপনার বিরুদ্ধেও হতে পারে হত্যা মামলা!

Other

আপনি নির্বিবাদী, কাজ পাগল মানুষ। কারো সাতে পাচে নেই। কিন্তু এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার চোখে চড়কগাছ। একটি হত্যা মামলায় আপনি আসামী।

যিনি মারা গেছেন, তাকে আপনি চেনেনও না। তবুও আপনি আসামী। আপনি কিছুটা বিরক্ত হলেন, কিছুটা উদ্বিগ্নও বটে। পরিচিত কাউকে দিয়ে মামলার কপি তুললেন।
আপনি যেন একটা বিস্ময়ের জগতে।

এই হত্যাকান্ডে আপনার সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতে আপনি ক্লান্ত। তাতে কি? মিডিয়া বিশেষ করে সামাজিক মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে হুলস্থল শুরু হলো। সোশাল মিডিয়া আপনার গায়ের চামড়া ছিড়ে লবন লাগাতে লাগলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই সোশাল মিডিয়ায় আপনি হয়ে গেলেন ‘খুনী’, হত্যাকারী, ঘাতক। বিচার দরকার নেই, তদন্ত দরকার নেই আপনি ‘খুনী’, অন্তত এক শ্রেনীর অতি উৎসাহী মিডিয়ার কাছে। এরপর ঐ মামলা নিয়ে শুরু হলো তদন্ত, দৌড়ঝাপ। আপনি কি কাজ করবেন, ব্যবসা চুলোয় গেল।

 তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, ভাই আমি তো সব জানি। ঘটনার আশে পাশে আপনি ছিলেন না। আপনি এই সবের বিন্দু বিসর্গও জানেন না। কিন্তু কি করবো, কোট তো আমাকে তদন্ত করতে বলেছেন, তদন্ত না করলে তো সমস্যা। আবার আপনার সাথে কথা না বললে ফেসবুকে লিখবে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যানেজ। কিছুক্ষন খোশ গল্প করে তদন্তকারী কর্মকর্তা চলে গেল।

 এদিকে দিন যায়, মাস যায়। আপনি বেকুব হয়ে বসে পরছেন। অবশেষে একদিন রিপোর্ট দিলো, না এটি হত্যা নয়, স্বাভাবিক মৃত্যু। আপনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু আসলে বাচলেন কি? এরপর ইউটিউবে, ফেসবুকে আপনাকে কচলানো শুরু হলো। কোন কিছু না করেও আপনি কিছুদিন আসামীর জীবন যাপন করলেন। দুএকটা মিডিয়া আপনার বিচার করে ফেললো। আপনার উপর যে তীব্র মানসিক অত্যাচার, আপনার যে সম্মান হানি- তার বিচার কে করবে?

পাঠক, এটি কল্পিত কোন গল্প নয়। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে আপনার জীবনেও। প্রমান টমান দরকার নেই, মামলা করেই অর্ধ্বেক বিচার করা সম্ভব এখন এই দেশে ফেসবুক, ইউটিউব পেলো ভিউ, লাইকের খাদ্য। কিভাবে? দেখুন না, গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ৮ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের মামলাটি। মুনিয়া মারা গেছে ১৯ এপ্রিল। প্রথম মুনিয়ার বোন মামলা করলেন, আত্মহত্যা প্ররোচনার। এই মামলায় তিনি একজনকে অভিযুক্ত করলেন। তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হলো হৈ চৈ, হুলস্থল। সবাই যেন বিচারক। পারলে এক্ষুনি বসুন্ধরার এমডিকে ফাঁসি দেয়। একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন যারা মিডিয়া ট্রায়াল করছে এরা তো সবাই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার গোষ্ঠী। মুহুর্তে বুঝবেন মুনিয়ার বিচার নয়, এটা সরকারকে বিপদে ফেলতে চায়। একটি কিশোরীর লাশকে ঘিরে শুরু হলো ষড়যন্ত্রের পৈশাচিক নৃত্য। শেষ পর্যন্ত ঐ মামলা নিস্পত্তি হলো। কিন্তু তিনটা মাস একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কুৎসিত নোংরা খেলা হলো তার বিচার কে করবে?
 
নাটকের শেষ এখানেই নয়। ৬ সেপ্টেম্বর মুনিয়ার বোন একই বিষয়ে ধর্ষন এবং হত্যা মামলা করলেন। আত্মহত্যা হয়ে গেলো হত্যাকান্ড। এবার আসামী করা হলো ৮ জনকে। এদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানও আছেন। মুনিয়ার মৃত্যুর সাথে তার সম্পর্ক কি, এটা খুঁজতে খুঁজতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিচার করা হচ্ছে। আবার সেই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার। আশ্চর্য এবং দুভাগ্য জনক ব্যপার হলো এই মামলায় ৫জন নারীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্ষনের মামলায় নারী আসামী। কি অদ্ভুত।

বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক মামলা করতেই পারেন। কিন্তু আদালতকে অবশ্যই একটি মামলা তদন্তে দেয়ার আগে তার মেরিট দেখতে হবে। যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘প্রাইমা ফেসিয়া কেস। ’ আদালত যদি কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই যে কোন মামলা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়, তাহলে প্রতিহিংসা এবং ব্লাকমেইলিং এর এক সর্বনাশের খেলা শুরু হবে। কালকে আপনার উপর রাগ করে, কোটে গিয়ে আপনার বিরুদ্ধে ঠুকে দেবে মামলা। এরপর মিডিয়া ট্রায়ালে আপনি বিচার তদন্তের আগেই ক্ষত বিক্ষত হবেন। লংঘিত হবে সংবিধান।

আমাদের সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ’ আদালত হয়তো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার জন্যই মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আদালতের আনুষ্ঠানিকতা কিছু মানুষকে যে কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে তা কি কেউ ভেবেছে? আদালতের আনুষ্ঠানিকতা একটি গোষ্ঠীর কাাছে চরিত্র হননের অস্ত্র তুলে দেয়া।

এই মামলার সূত্র ধরে কাউকে বিপদে ফেলতে একটা মামলা করে, সোশাল মিডিয়াতে গল্প ছড়ালেই হলো। বিচার লাগবে না। এখন এই মামলার উদাহরণ টেনে যদি, জামাত-যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী বিভিন্ন কথিত গুমের অভিযোগকে হত্যাকান্ড বলে মামলা করে, আর এগুলো যদি তথাকথিত তদন্তে পাঠানো নির্দেশ দেয়া হয়, তখন কি সরকার একটা অস্বস্তিতে পরবে না? এই মামলার দেখানো পথে যদি দেশের ১০টি প্রধান শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী মামলা করে তাদের হয়রানি করে, তাহলে কি অর্থনীতির চাকা থমকে যাবে না?

সবচেয়ে বড় কথা এই মামলা কি মিডিয়া ট্রায়ালের (নাকি সোশাল মিডিয়া) পথ উন্মুক্ত করে দিলো না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী যার বিরুদ্ধে অসহায় বলে নিজেই কবুল করেছেন।

লেখাটি সৈয়দ বোরহান কবীর-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া (সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv/এমি-জান্নাত