লেখাপড়া না জেনে গান লিখতে গেলে তো এমনই হবে

পারমিতা হিম

লেখাপড়া না জেনে গান লিখতে গেলে তো এমনই হবে

Other

জানালা পরিষ্কার করানোর জন্য লোক ডাকছি। নাম উইলিয়াম। সে যথাসময়ে এসে হাজির। বয়স পঞ্চাশও হতে পারে, ষাটও হতে পারে, আমি এগুলি ভালো বুঝি না, সাদা চামড়াদের আরো না।

বেশ ফিটফাট শরীর, লম্বা চওড়া হাত আর লাল চুল লোকটার।

কথা জমানোর জন্য আমি ওকে বললাম, এতদিন নিশ্চয়ই কোভিডের জন্য কারো বাসায় যাওয়া বন্ধ ছিল, কিভাবে ওই বেকার জীবনটার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ালে? 

উইলিয়াম বলল, প্রথম প্রথম ভালোই ছিল। পরে একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলো কী জানো? বাচ্চাদের যন্ত্রণা। আমার ৪টা সন্তান।

এবার বুঝো ওইঘরে আমরা কত সংখ্যালঘু, খাইতে হয় ওদের ইচ্ছায়, টিভি দেখতে হয় ওদের সাথে। এগুলি খুব কঠিন লাগছিল। ভাগ্যিস আমার পোলাপাইন প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। ওরা বেশিদিন বন্ধ রাখে নাই। খুলে দিছে। পাবলিক স্কুল হলে আমাদের খবর ছিল।  

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। মানুষের বাড়ির জানালা পরিস্কারের কাজ করে কেউ ছেলেমেয়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে পারে? অসম্ভব ব্যাপার।  আমি বললাম, উইলিয়াম তোমার ছেলে মেয়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ে!তোমার বউ তো অনেক ভালো জব করে নিশ্চয়ই! 

ও বলল, হ্যাঁ আমি আর আমার বউ দুজনেই সরকারি চাকরি করি। জানালা পরিস্কার করি বাড়তি আয়ের জন্য। এটা আমার নেশাও বলতে পারো। কলেজে পড়ার সময় পার্টটাইম জব নিছিলাম আর ছাড়ি নাই। আজকে ২৩ বছর ধরে আমি এ বিল্ডিং এর জানালা পরিষ্কার করি। কেমনে ছাড়ি বলো, একটা টানও হয়ে গেছে! ওই যে আমার বাসা ওখানে।  

বলে আঙুল তুলে যে বাসা দেখালো সেটা এ এলাকার সবচেয়ে দামি বাড়িগুলার একটা।  আমি বললাম, বলো কী! ২৩ বছর ধরে! এত ভালো লাগে জানালা পরিষ্কারের কাজ? 

ও বলল, জানো আমাকে এটা যে বুড়া শিখাইছে সে বেশিদিন বাঁচে নাই। একটা রুশ বুড়া আমাকে আমার জীবনের প্রথম চাকরিটা দিছিল। আমি না যতবারই ছেড়ে দিতে চাই, তার কথা মনে পড়ে। কেন যেন মনে হয় আমিই তার উত্তরাধিকারী। কেমনে ছেড়ে যাই! 

কোভিডের সময় এ কাজ ছিল না। অফিস তো ছিল। মাসে মাসে সরকারের ভাতাও পাইছি। তবু আমার এ কাজের কথা মনে পড়লেই ওই বুড়ার কথা ভেবে বুকে ব্যথা করত। টাকার জন্য না এটা।

আমি চুপ। সেও চুপ। এটা কি সম্ভব সে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি” পড়ে এগুলা বানায়ে বানায়ে বলতেছে? 

কাচের উপরে সাবান-পানি লাগানো, এরপর চিকন ঝাড়ু দিয়ে পানিটা উপর থেকে নিচে নামানো, একবার ঘোলাটে উইলিয়াম, একটু পরেই স্বচ্ছ উইলিয়াম- আমরা ছোটবেলায় পানি দিয়ে খেলতে কতই না পছন্দ করতাম! 

ওকে দেখেই যাচ্ছি তবু বুঝলাম না ও মন খারাপ করল কিনা! তাই আমি প্রসঙ্গই বদলায়ে দিলাম। বললাম, জানো আমার দেশে এখনো স্কুল বন্ধ। ছেলেমেয়েরা যে কী কষ্টে আছে। আর অভিভাবকদের অবস্থাও নিশ্চয়ই তোমার মত।  

উইলিয়াম বলল, আরে এইসব একটা ষড়যন্ত্র বুঝলে। কোনো ভাইরাস টাইরাস না।  আমি আবার কুকুরের মত গন্ধ শুঁকে ঢুকে আলাপে পড়লাম। আমেরিকার অনেক লোকে এসব বিশ্বাস করে। এরা ভ্যাকসিন নেয় না।  

বললাম, কিসের ষড়যন্ত্র? উইলিয়াম বলল, নতুন প্রজন্মকে বেকুব প্রজন্ম বানানোর ষড়যন্ত্র। দেখো না গাঁজার দোকান খুলে দিছে (নিউ ইয়র্কে গাঁজা খাওয়া এখন বৈধ, আগে ছিল না) আর স্কুল বন্ধ করে দিছে। এরা চায় ইয়াংরা নেশায় বুঁদ হয়ে থাক, লেখাপড়া না জানুক, একেকটা গাধা হয়ে বড় হোক আর সরকার সে সুযোগে যা খুশি তাই করে বেড়াক।  

বলে সে এমন একটা ভঙ্গি করল, আমি দেখলাম পরীবাগের ভ্যানের উপরে মিলইন্যা গাঁজা খেয়ে পড়ে আছে আর পিংক ফ্লয়েডের গান গাচ্ছে- we don’t need no education. গানটার কথা উইলিয়ামকে বলতেই ও আরো ক্ষেপে গেল।  

বলল, আরে ওই হালার তো আগে ল্যাংগুয়েজ এডুকেশন দরকার। তারপরে রক ব্যান্ড মারাক। we don’t need no education মানে we need education, লেখাপড়া না জেনে গান লিখতে গেলে তো এমনই হবে। এইটা কোনো লাইন হইল! 

লেখাটি সাংবাদিক পারমিতা হিম-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  

news24bd.tv নাজিম