জীবন শুধু কেড়েই নেয় না, ফিরিয়েও দেয়

জীবন শুধু কেড়েই নেয় না, ফিরিয়েও দেয়

Other

আজ থেকে ঠিক বাইশ বছর আগে আমি প্রথম আমেরিকা ভ্রমন করি। আমেরিকা সম্পর্কে বই পড়ে যতটুকু জেনেছি এই যা। শঙ্করের এপার বাংলা ওপার বাংলা, নীল লোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদী, সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে, সমরেশের বিনে সুতোয় ইত্যাদি বই পড়ে আমেরিকার প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয় আমার। বিশেষকরে নিউইয়র্কের প্রতি।

আমেরিকা বলতেই যেনো নিউইয়র্ক। বিশ্বের রাজধানী বলে খ্যাত। তখন থেকেই মনে মনে ভাবতাম সত্যি কি ওরকম একটা দেশ পৃথিবীতে আছে! আমি কি কখনও যেতে পারব ওই বিস্ময়কর দেশে! কিন্তু জানতাম কখনও যেতে পারব না। বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে পারব কিনা তাও নিশ্চিত ছিলাম না।
কাউকে তো কোথাও চিনিনা। আমাকে কেউ চেনেনা। দূরের জার্নি বলতে শুধু মায়ের সাথে ঢাপরকাঠি যেতাম বছরান্তে একবার। তাও লঞ্চে মাত্র তিন ঘন্টার পথ। কিন্তু আমি অনেক দুরে কোথাও যেতে চাইতাম। কিন্তু কোথায় যাব, কেমন করে যাব জানা ছিল না। কিন্তু মনে স্বপ্ন ছিল। বই আমাকে স্বপ্ন দেখাতে উস্কে দিত।

তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রবাস থেকে নামে একটা বিভাগ ছিল। প্রবল জনপ্রিয় ছিল সেই বিভাগ। বরিশাল বসেই আমি বিচিত্রা পড়তাম। একদিন আমি ঢাকা আসলাম পড়াশুনা করতে। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সাংবাদিকতা করব, লেখক হবো। জানি উদ্ভট সব স্বপ্ন। এই শহরে আমি কল্কে পাবো না। কিন্তু অবাক কান্ড বিচিত্রার মতো পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম একদিন। বরিশাল থেকেই আমার পত্র পত্রিকায় লেখার হাতেখড়ি। বিচিত্রায়ও লিখতাম। লেখালেখির প্রতিও আগ্রহী হই বই পড়ে। এসব আমি একা একাই শিখেছিলাম। নিয়তি মফস্বলের নির্বান্ধব এক তরুনের সাথে খেলা খেলেছিল। আটকা পড়ে গেলাম এক স্বপ্নের মায়াজালে। বিচিত্রায় সুযোগ পাওয়া তারই অংশ ছিল। প্রবাস থেকে বিভাগে সেই সময় নিউইয়র্কের কয়েকজন নিয়মিত লিখতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শফিউদ্দিন কামাল এবং নাসরিন চৌধুরী। আমি আগ্রহ নিয়ে প্রবাস থেকে বিভাগের লেখা পড়ি। আমার ভিতরে একটা অজানার ডাক শুনতে পাই। আমার সবসময় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। দুরে কোথাও মনটা চলে যেতো। শৈশবকাল থেকেই এমন মনে হতো।  

একদিন আকস্মিক বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেলো। এরপর সাপ্তাহিক২০০০ প্রকাশিত হলো। বিচিত্রার মতোই সাপ্তাহিক২০০০ এও প্রবাস থেকে বিভাগ চালু হলো এবং সেই বিভাগের দ্বায়িত্ব পেলাম আমি। বিচিত্রার মতোই জনপ্রিয় হয়েছিল সেই বিভাগ। প্রতি সপ্তাহে প্রবাসীদের শত শত চিঠি আসত এবং সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম আমি এবং এডিট করতাম। সেখানে নিউইয়র্কের চিঠি থাকত। নিউইয়ৰ্ক আমাকে টানত খুব। যেনো আমি কল্পনায় চলে গেছি সেখানে।

বাইশ বছর আগে আমি প্রথম আমেরিকা ভ্রমন করি


আমার মধ্যে কিছু উদ্ভট ব্যাপার আছে। আমার যখন যা করতে মন চায় আমি করি। পূর্বাপর পরিণতির কথা ভাবি না। আমার কোনো পরিকল্পনাও নাই জীবনে। মনে করি যখন যা ঘটবে তাই জীবনের অংশ। একদিন কিছু না বুঝেই এক ভোরে দুরু দুরু বক্ষে আমেরিকান এম্বেসিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানি আমাকে ভিসা দেবে না, দেয়ার কোনো কারনও নাই। আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি না, কোনো সেলিব্রেটি না, পলিটিশিয়ান না। একজন ক্ষুদে সাংবাদিক মাত্র। আমি সাংবাদিকতার কোনো প্রমানপত্রও সাথে আনিনি। শুধু একজনের একটা চিঠি সাথে।  

আমার ইন্টারভিউর ডাক আসল। আমি কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। একজন সুদর্শন তরুন অফিসার আমাকে বলল, তুমি আমেরিকা কেনো যাবা! 
আমি বললাম বেড়াতে। বই পড়ে আমেরিকা সম্পর্কে জেনেছি, আমেরিকা একটা মহান দেশ।  

তোমার কে আছে ওখানে! 
বললাম, বন্ধুরা আছে।  
যাওয়া আসার খরচ কে দেবেন মি.খান! 
আমি কিছু না ভেবেই বললাম,হ্যাঁ।  
তা তুমি একলা যাবা কেনো, ওয়াইফকে নিবা না কেনো! 
আমি কল্পনাও করিনি অফিসার এই কথা বলতে পারে। তার মানে কি আজও জানিনা।  
আমি বুদ্ধি করে বললাম, আমার বাচ্চারাতো ছোট তাই সে যেতে পারবে না। নেক্সট টাইম যাবে।  

আমেরিকান অফিসারটি আমাকে অবাক করে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ইনশাল্লাহ। তারপর বলল, বিকেলে এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও। বিকেলে পাসপোর্ট পিক করতে গেলাম। জানি ভিসা রিফিউজ হয়েছে। তাই ওটার দিকে তাকালাম না। বাইরে বের হয়ে ভালমতো দেখলাম। দেখি আমার পাসপোর্টে ভিসা সীল। এক বছর মাল্টিপল! নিজের চোখকেই বশ্বিাস করতে পারলাম না। অথচ এর আগে আমি বিদেশ বলতে একবার মাত্র কোলকাতা গিয়েছি। তাও বাসে। প্লেনে চড়া বলতে একবারই ঢাকা-সৈয়দপুর ছাড়া কোথাও যাইনি। কোলকাতাকে ঠিক বিদেশ বলা যায় না। চোখ ডলে বারবার পাসপোর্ট দেখছি ঘটনা ঠিক তো! 

মজার ঘটনা হচ্ছে সেবার আমি একই সাথে ইউকের ভিসাও নিয়েছিলাম। সাথে ছিল একই মানুষের চিঠি। এ যেনো মেঘ না চাইতেই জল। ইউকের ভিসা অফিসারও প্রায় একই প্রশ্ন করেছিল আমাকে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে সেটাই হয়েছিল। আমি আমেরিকা এবং লন্ডন একই সাথে ভ্রমণ করেছিলাম সেবার।

মহা উত্তেজিত এবং ভীতু অবস্থায় এক বিকেলে জেএফকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামলাম আমি। বিস্মিত হয়ে চারদিক দেখছি। ইয়া মোটা সাদা রঙের গম্ভীর ধরণের ইমিগ্রেশন অফিসার কিন্তু নরমভাবে কথা বলছে। লম্বা লাইন। কনভেয়ার বেল্টে শত শত লাগেজ। কাস্টমস ডিঙ্গিয়ে বাইরে বের হয়ে দেখি বিস্ময়কর এক শহর আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিউইয়ৰ্ক! এরিনা আপা এসেছেন আমাকে পিক করতে। বিশাল বিশাল হাইওয়ে আর শত শত গাড়ির মিছিল দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। বইতে যেমন পড়েছিলাম তেমনই তো মনে হচ্ছে! পথে আমরা ডানকিন ডোনাটস নামে একটা ফাষ্টফুডের দোকানে থামলাম। ইয়া ভোমা সাইজের বার্গার যা তিনজনে খেয়েও শেষ করা যাবে না আর বিরাট বড় কফির কাপ। এই সাইজ নাকি স্মল! হায় আল্লাহ আমেরিকানরা এতো বড় বড় বার্গার খায়! মানুষগুলোও ওভারসাইজ মনে হলো।


সেবার এক মাসের মতো নিউইয়র্ক ছিলাম। তেমন চেনা কেউ নাই। এরিনা আপাদের সাথে ঘুরে বেড়াই। এরিনা আপা আমার কোনো আত্মীয় না কিন্তু আত্মীয়র চেয়ে বেশি করেছেন আমার জন্য। নায়াগ্রাফলস গেলাম একদিন, সে এক বিস্ময়! স্টাচু অব লিবার্টি, জাতিসংঘের সদর দপ্তর, ন্যাশনাল পার্ক- ম্যানহাটন যেনো দৈত্যের মতো আলোকমালায় সজ্জিত এক শহর, ফিফথ এভিনিউ, যেখানে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এক কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান বাংলাদেশ.. বাাংলাদেশ..। বড় বড় শপিং মল। ম্যাসিজ নামে একটা শপিং সেন্টারে গেলাম যা একটা পুরো ব্লক জুড়ে বিস্তৃত। অবাক কান্ড সব। সেবার আকবর হায়দার কিরনের সাথে কেনো যেনো দেখা হলো না। কিরন ভাই প্রথমে বিচিত্রা তারপর সাপ্তহিক২০০০ ও আনন্দধারার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি তখন। নাসরিন চৌধুরী, গীতি, চৌধুরী হাসান, কামাল ভাই সহ আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় হলো। তাদের সাথে আগে থেকেই চিঠির যোগাযোগ ছিল। কামাল ভাইয়ের সাথে একদিন খুব ঘুরেছি। তার বাসায় গিয়েছি। নাসরিন আপাও ঘুরিয়েছেন। কনি আইল্যান্ড নিয়ে গিয়েছিলেন। নিউইয়র্কের মানুষের আতিথেয়তায় বিমোহিত হয়েছিলাম। সেবার ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড ঘুরেছিলাম। বিচিত্রার কবিতা আপার আতিথেয়তা নিয়েছিলাম।  

কামাল ভাইকে বললাম, আমার নিউইয়র্ক খুব ভাল লেগেছে। আমি আমেরিকা চলে আসতে চাই।  
কামাল ভাই বললেন, থেকে যান। আমি বললাম, বাচ্চাদের রেখে আমি কোথাও থাকতে পারব না। আমার মেয়ে অরিত্রি তখন ছোট। ওর কথা মনে করে আমি চোখের পানি ফেলি। তখনও ৯/১১ হয়নি। আমেরিকা স্বর্গ তখনও।  

কামাল ভাই বললেন, তাহলে আপনি এক কাজ করেন, দেশে গিয়ে কানাডার জন্য এপ্লাই করেন।  

তখনও আমি জানতামই না কানাডায় ইমিগ্রেশন হয়। কামাল ভাই আমাকে প্রথম বিষয়টা মাথায় ঢুকিয়েছিলেন এবং আমি সত্যি সত্যি ঢাকায় ফিরে কানাডায় ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করলাম। পরেরবার আমাকে আর একবার অবাক করে দিয়ে পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা দিয়েছিল আমেরিকান এম্বেসি। সেই ভিসা দিয়েই আমি লসএলসএঞ্জেলেসে ২০০৩ এ কানাডার ইমিগ্রেশনের জন্য ইন্টারভিউ দিতে পেরেছিলাম। সে বছর জুনে আমি সপবারে কানাডা আসি।  

আমি প্রতি বছর নিউইয়র্ক গিয়েছি
তারপর আমি প্রতি বছর নিউইয়র্ক গিয়েছি। নিউইয়র্ক সবসময় আমার প্রিয় শহর, ভালবাসার শহর। নিউইয়র্কে আমার অনেক বন্ধু, স্বজন রয়েছে। সবার সাথেই দেখা হয় কিন্তু গত বাইশ বছরে একবারও কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। কেনো যে হলো না জানি না। কিন্তু হঠাৎ একদিন কামাল ভাইকে পেয়ে গেলাম ফেসবুকের কল্যানে। সেই কারনেই এই লেখার অবতারনা। জীবন এমনই। শুধু কেড়েই নেয়না আবার ফিরিয়েও দেয়। কামাল ভাই আপনার সাথে দেখা হবে শীঘ্রই। আপনার আতিথ্য গ্রহন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি আমি।

(ছবির ক্যাপশনঃ প্রথম ছবি নায়াগ্রফলসে আমার আমেরিকান বন্ধু ক্যাথরিনের সাথে। ক্যাথরিন বস্টন ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক। ক্যাথরিনকে নিয়ে পরে কখনও লিখব। দ্বিতীয় ছবি লন্ডন টাওয়ার ব্রীজে  আমার বন্ধু বাবলীর সাথে। বাবলী চমৎকার ফটোগ্রাফী করে। লন্ডন শহর দাপিয়ে বেড়ায়। ) টরন্টো ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

লেখাটি জসিম মল্লিক -এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  লেখক, জসিম মল্লিক, সাংবাদিক, কানাডা

news24bd.tv/আলী