লণ্ডনের সিলোটি ড্রাইভার

পারমিতা হিম

লণ্ডনের সিলোটি ড্রাইভার

Other

লণ্ডনের প্রথম দিন না বলে বলা উচিত প্রথম প্রহর। প্রথম প্রহরেই সাধারণত আজব ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এটা যেহেতু আমি, কিছু না কিছু তো ঘটবেই! সেদিন ঝকঝকে এক দুপুরে আমি প্লেন থেকে নামলাম হিথ্রো বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বের হলাম।

তারপর সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে গেলাম।  

আমি লন্ডনে যাচ্ছি বিবিসির ট্রেনিং এর জন্য। ওরা বলছে ওরা উবার এর পয়সা দিবে না। এয়ারপোর্ট থেকে যেন টিউবে (লণ্ডনের পাতাল রেল) চড়ে হোটেলের কাছে চলে যাই।

আমি আগে থেকেই জানি আমি সেরকম যাব না। কারণ ফ্রান্সের মেট্রোতে চড়ে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। এগুলোর সিসে্টম এমন জটিল যে দীর্ঘ ভ্রমণ করে এসে, সঙ্গে দুইখান লাগেজ নিয়ে হোটেলের পথ ভুল করে নিজেকে শারীরিক কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না। তার উপর আমার আবার দয়ার শরীর। সে কোনো কষ্টই সহ্য করতে পারে না!

আমি ট্যাক্সি/ ভাড়া গাড়ির খোঁজে এদিক ওদিক তাকালাম। কাউন্টার আছে লোক নাই। একদম বাংলাদেশের এয়ারপোর্টের মত অবস্থা। কিছুতেই কিছু বুঝি না। অবশেষে একটা গাড়ি আঁকা কাউন্টারে একজনকে দেখা গেল।  

আমি তাকে গিয়ে বললাম আমি একটা গাড়ি নিতে চাই।  

কাউন্টারের লোক আমাকে বলল, ড্রাইভিং লাইসেন্স দাও।  

আমি তো অবাক! গাড়ি ভাড়া নিতে কেন ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবে?

সে বলল, ওমা, তুমি গাড়ি যে চালাতে পারো তার প্রমাণ লাগবে না?

আমি বুঝলাম সে আমাকে একটা আস্ত গাড়ি ভাড়া দিবে। ড্রাইভার দিবে না।  

আমি ওকে বললাম, ভাই রে আমি তো আসলে একটা ড্রাইভার সহ গাড়ি মানে ট্যাক্সি চাচ্ছি।  

ও বলল, সেটা তো ভেতরে পাবে না। বাইরে চলে যাও। সেখানে দেখবে ট্যাক্সি-উবার সব দাঁড়ায়ে আছে।  

আমি ভেতর থেকেই বাইরে উঁকি দিচ্ছি এমন সময় এক বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে বলল, ওয়ান্ট অ্যা ট্যাক্সি?

আমি বললাম, ইয়েস।

সে বলল, কাম উইথ মি।  

আমি ওর পিছে পিছে গেলাম বটে কিন্তু আমার কমলাপুর রেলস্টেশনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন  মন তো আর মানতে চায় না! 

সে আমাকে নিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে উঠাল। বলল, সে এইমাত্র ইন্ডিয়ান যাত্রী নিয়ে এয়ারপোর্টে আসছে আর যাবার যাত্রীও ইন্ডিয়ান পেয়ে গেল।  

আমি তাকে বললাম, আমি ইন্ডিয়ান না। বাংলাদেশী।  

ওমা এবার সে তো খাঁটি  সিলোটি বাংলায় আমাকে বলল, আরে আমিও তো বেংগলি।  

তারপরে তার প্রশ্ন তো আর শেষ হয় না। আমি কে, বাড়ি কোথায়, কেন এলাম, কয়দিন থাকব, দেশের অবস্থা কী, শেখ হাসিনার ক্যান্সার নাকি যক্ষ্মা, সিলেটের ভাঙা রাস্তা কেন ঠিক হয় না, পদ্মা সেতু হইতে আর কয় বছর লাগবে—এমন কোনো টপিক নাই যেটা সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে নাই।  

আমার ভালোই লাগতেছিল। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে হোটেল পর্যন্ত যাওয়াটাই একটু টেনশনের। এরপরে আস্তে আস্তে পথঘাট, সিস্টেম বুঝে ফেলা যায়। প্রথমেই একজন বাংলাদেশী পেয়ে গেলাম। হোটেল পর্যন্ত যাওয়া নিয়ে টেনশন নাই আর।  

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কখন লণ্ডনে আসছে, কেন আসছে, কত বছর থাকল, কই থাকে, কয়জন ছেলেমেয়ে—এইসব।  

সে বলল, তার বাবা লণ্ডনে আসছে আগে। তার জন্ম সিলেটে। ১৬ বছর বয়সে বাবার সাথে ইংল্যান্ড চলে আসে। আর ফিরে যায় নাই। দেশে বিয়ে করছিল। বউকে সে পরে নিয়ে আসছে। বাচ্চাগুলি এখানেই হইছে।  

এইসব বলতে গিয়ে ইংল্যান্ডের রানীর খুব প্রশংসা করল সে। বলল ভাগ্যিস রানী বুদ্ধি করে মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের পরিবারসহ আনার অনুমতি দিছিল। আমি মনে মনে হাসলাম। ব্রিটিশরা মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের পরিবার ব্রিটেনে আনতে দিছে যাতে শ্রমিকদের আয়ের অর্থ বিদেশে মানে শ্রমিকদের নিজেদের দেশে না যায়। ব্রিটেনের পয়সা ব্রিটেনেই থাকে।  

কথাটা ভদ্রলোককে বলতে গিয়েও বললাম না। বয়স্ক লোক। তার দুনিয়ায় থাকে। রাজা রানীর প্রতি অযথা ভক্তি বোধ করে। আমার কী দরকার তার চিন্তার সাজানো সংসারে মই নিয়ে ঢুকার।

উনি আমাকে বললেন, সিলেটের সবচেয়ে দামি জায়গায় তার ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে। সেই বাড়ি এত পয়সা খরচ করে বানানো আর এত চোখ ধাঁধাঁনো সুন্দর যে সেটা নিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশনে রিপোর্ট হইছে।  

এটা শুনে আমি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। বললাম, সেখানে কে থাকে?

উনি বললেন, কেউ না। একজন কেয়ারটেকার আছে। সে দেখাশোনা করে। তাকে প্রতি মাসে বেতন দেয়া হয়।  

আমি বললাম, আপনারা দেশে যান?

উনি বললেন, না আসলে অনেক বছর ধরেই যাওয়া হয় না। দেশে যাওয়া অনেক ঝামেলা। তাছাড়া দেশের যা অবস্থা, যেতে ইচ্ছাও করে না।  

আমি বললাম, তাহলে এত টাকা খরচ করে দেশে বাড়ি বানালেন কেন? টিভি রিপোর্টের জন্য?
 
উনি বললেন, না, ভাবছিলাম বুড়া হইলে বিবিরে নিয়া দেশে চলে যাব। সেখানে থাকব। বুড়া হইলে আর পরের দেশে থাকতে চাই নাই। নিজের দেশে থাকব ভাবছিলাম কিন্তু এখন তো আর থাকা যাইবো বলে মনে হয় না।  

আমি বললাম, কেন?

উনি বলল, ছেলেরা যেতে চায় না। ওরা এদেশে বড় হইছে তো। ওরা দুনিয়ার প্যাঁচপুচ বুঝে না। ২ নম্বরি কী জিনিস জানে না। ওরা কোনোদিন বাংলাদেশে টিকতে পারবে না।  

আমি বললাম, বাংলাদেশে কি সবাই দুর্নীতি করেই টিকে আছে? কোনো ভালো লোক নাই?

উনি বলল, না নাই। তুমি তো থাকো ওখানে তুমিই বল। আমার ছেলেরা জানে না চুরি কাকে বলে। মানুষকে কিভাবে ঠকাতে হয় এগুলি ওরা শিখে নাই। ওরা অন্যভাবে বড় হইছে। ওদের পক্ষে খারাপ কাজ করা, মিথ্যা বলা সম্ভব না। ওরা জানে না কিভাবে চালাকি করে বেঁচে থাকতে হয়। এদেশটা অন্যরকম। আমাদের দেশের মত না।  

ব্রিটিশরা চালাকি জানে না? মানুষকে কিভাবে ঠকাতে হয় জানে না? চুরি জানে না? ব্রিটিশদের ইতিহাস জেনেশুনে, ব্রিটিশদের চুরিচামারি-শয়তানির অন্যতম পীঠস্থান ভারতবর্ষের একজন হয়ে আমাকে এইসব কথা শুনতে হবে? 

অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও আমি কিছুই বললাম না। ওই যে বুড়া মানুষের সাদা চামড়া প্রীতিতে দাগ দিয়ে তার রাতের ঘুম হারাম করতে ইচ্ছা করল না। বাকি পুরোটা সময় উনি বকবক করে গেলেন বাংলাদেশের মানুষ কত খারাপ আর উনার ছেলে দুইজন এদেশে বড় হয়েছে বলে কতটা ধোঁয়া তুলসিপাতা।

অক্সফোর্ড স্ট্রিটে আমার হোটেলের সামনে নেমে গেলাম। লাগেজ নামাতে নামাতে আমার মাথায় আসল দুইটা কথা।  

১. আমাকে অফিস থেকে একটা সিম দেয়া হইছে। সেটা রিচার্জ করতে হবে।  
২. আমাকে বলা হইছে যেন টিউবের পাস/টিকিট কিনে ফেলি। যে কোনো জায়গায় যেতে সুবিধা হবে।  

তখন সন্ধ্যা হবে হবে আর পরদিন সকালেই অফিস ধরতে হবে। আমি ভাবলাম আমার এ কাজগুলি কিভাবে করব সেটা এই বাংলাদেশি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি।  

উনি আমাকে বললেন, টিউবের টিকিট কেটে পয়সা নষ্ট করার কোনো দরকার নাই। টিকিট লাগে না।  

আমি তো অবাক! বললাম, লাগে না মানে? আমাকে তো অফিস থেকে পয়সা দিছে কেনার জন্য! 

উনি বলল, টিউবের গেটগুলি অনেক বড়। আর এক টিকিটে খোলাও থাকে অনেকক্ষণ। তুমি চিকনাচাকনা মানুষ, অন্য কেউ যখন টিকিট স্ক্যান করবে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াবা, আর ওর টিকিটে গেইট খুলে গেলে এক দৌড়ে ওর পিছে পিছে ঢুকে যাবা। কোনো পয়সাই লাগবে না। অফিসের টাকা দিয়ে তুমি নিজের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেও।  

আমি বললাম, পুলিশ ধরলে?

উনি বলল, পুলিশ সাধারণত ধরে না। ধরলে বলে দিবা তুমি এইদেশে নতুন। তাই টিকিট কাটার নিয়ম জানো না।  

বলে উনি উনার মার্সিডিজ বেঞ্জ নিয়ে সরসর করে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ সেখানে গাধার মত দাঁড়ায়ে থাকলাম। ঠাহর করার চেষ্টা করলাম লণ্ডনের প্রথম প্রহরে আসলে আমার সাথে এইটা কী ঘটে গেল!

আমি কিন্তু পরে টাকা দিয়ে টিউবের পাস কিনে নিছিলাম। বাংলাদেশে বড় হইছি তো! 

লেখাটি সাংবাদিক পারমিতা হিম-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  

news24bd.tv নাজিম

এই রকম আরও টপিক