গুরুত্বপূর্ণ পদ জনপ্রিয় হওয়ার একটি উপায়

গুরুত্বপূর্ণ পদ জনপ্রিয় হওয়ার একটি উপায়

Other

গত ১০ বছরে ফেসবুক ব্যবহারের কল্যাণে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি-- তা হল, সম্পর্ক গড়ার অন্যতম মাধ্যম কর্ম নয় প্রশংসা। এছাড়াও জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম মাধ্যম ক্ষমতা বা কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচলিত এই নীতি আমি অনুসরণ করতে পছন্দ করি না।  

অনেক ঊর্ধ্বতন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, তাদের কেউ কেউ কখনো খুব ভালো পজিশনে থাকেন আবার কখনো পদচ্যুত হন অথবা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে চান।

এদের অনেকেই আবারও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন, মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে।  

তারা কি কখনো খেয়াল করেছেন, তারা যখন গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে অন্যত্র বদলি হন পদচ্যুত হন তখন কতজন মানুষ তাদের খোঁজ খবর নেন? ওই প্রভাবশালীরা ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিলে প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়। প্রশংসা পাওয়ার সময় তারা কী ভাবেন, মৌমাছিগুলো কোথায় ছিল ? হঠাৎ করে কেন এতো ভালোবাসা ?

বড় কোনো পোস্ট বা ছবি নয়, শুধু "হ্যালো" কথাটি লিখলেও- 
অনেক প্রশংসাবাণী ঝরতে থাকে, যেমন- 
—-‘হলো' বলার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, 
—আপনার অসাধারণ হ্যালোর মধ্যে মধু আছে, 
——আপনাকে স্বাগতম, 
—-আপনি অনেক বড় হৃদয়ের তাই আমাদেরকে হ্যালো বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।  
আবার ধরুন, একটা ছবি পোস্ট করা হয়েছে এবং হয়তো তার পাশে তারই স্ত্রী বসে আছে তখন দেখবেন - প্রশংসা করতে যেয়ে অনেকেই বলবে - 

—'বাহ আপনাদেরকে নায়ক নায়িকার মত লাগছে' (এতদিন কিন্তু মনে হয়নি কারণ তিনি এতদিন এই পদে ছিলেন না), 
—আপনাদেরকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে, 
—সেরকম মানিয়েছে, 
—সুন্দর জুটি,
—এমন স্বর্গীয় জুটি কখনো দেখিনি, 
—অদ্ভুত সুন্দর জুটি, 
—বেহেস্ত থেকে জনাব হুর এবং হুর পরী নেমে এসেছেন, 
—খোদার আশীর্বাদপ্রাপ্ত জুটি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু দুইদিন পরে ওই জায়গা থেকে বদলি হয়ে যখন অন্যত্র যাবেন তখন কিন্তু খোঁজ নেওয়া দূরের কথা তিনি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলে কেউ ফিরে দেখারও সময় পাবে না, একটি ফোন কলও করবে না, খুঁজে বেড়াবেও না।  

যেমন ধরুন, কোন একজন সাবেক সিনিয়র সচিব (যোগাযোগ, জ্বালানি, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) তিনি যখন যোগাযোগ থেকে পরিকল্পনা (IMED) মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হলেন তখন অনেক মানুষ তার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি যখন যোগাযোগ সচিব তার সাথে সুসম্পর্ক থাকা অবস্থায় দেখা করিনি তবে সেখান থেকে তিনি যখন একটু দুর্বল জায়গায় চলে গেলেন, ভাবলাম তার একটু খোঁজ নেই, হয়তো তিনি কিছুটা হলেও মানসিকভাবে আহত হতে পারেন। খুব ছোট মানুষ হলেও তাকে সাহস করে বলেছিলাম-' ইনশাল্লাহ আপনি আপনার নিজ যোগ্যতায় পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবেন'। তারপরে অবশ্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বেশি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন।

আমার মনে হয় তখন তার কাছে আমিই সবচেয়ে কম গিয়েছি। আর যারা অতীতে তাঁর খোঁজ নেয়নি তাঁরাই সবচেয়ে বেশি গিয়েছিল।
 
আবার যখন একবার গুঞ্জন ছড়ালো তিনি কোন এক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন তখন অনেক মানুষ তার বাসার সামনে ভিড় জমানো শুরু করলেন। আমি একদিন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তার গেটের সামনে গিয়ে দেখি অনেক ভিড়, তা দেখে পরে ফিরে চলে আসি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তিনি চেয়ারম্যান হলেন না তখন আমি আবার গিয়েছিলাম এবং দেখি সে মানুষগুলো কেউ নেই।
 
আরেকটি ঘটনা বলি, কোন একজন প্রভাবশালী জেনারেল, তার নাম বললে আপনারা সবাই চিনবেন, যার কথা মোটামুটি সবাই বলতো যে তিনি হয়তো পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন। আমার সাথে তার সুসম্পর্ক থাকার কারণে তার সাথে অনেক কথা হতো। এমন হয়েছে যে, তিনি একদিন আক্ষেপ করে বলছিলেন- 'দেখো আমি কিছুই জানি না অথচ মানুষ আমাকে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাচ্ছে'! তখন আমি তাকে বললাম-'স্যার এরা আজ ঝড়ে বক মারছে-যদি লেগে যায় থিওরির প্রয়োগ, এবং আপনি যদি সেনাপ্রধান না হন তখন দেখবেন এরা কেউ আপনার খোঁজ নিবে না। কিছুদিন আগে অনেকটা মজা করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- 'স্যার ওই মানুষগুলো কি আপনাকে এখন ফোন করে?'
তিনি উত্তর দিলেন- 'করবে কেন?  আমিতো তা হতে পারিনি। '

আমার অতি প্রিয় একজন অফিসার (মৃত) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যিনি RAB- এর গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন। তাকে আমি এতোটাই ভালোবাসি যার মৃত্যুর পরও প্রতিটা মুহূর্তে তাকে মনে করি এবং তিনি হচ্ছেন একমাত্র অফিসার যার মৃত্যুর পরে আমি তার জন্য নফল নামাজ আদায় করেছি। তার মৃত্যুর পরে সাতদিন পর্যন্ত আকাশের দিকে চেয়ে নিরবে কেঁদেছি। তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় যারা তাকে প্রশংসায় ভাসাতো বা যারা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করত তাদের কাউকে দেখিনি কর্নেল আজাদকে নিয়ে একবারের জন্যও স্মৃতিচারণ করতে।  

আমি আরো তিনজন ব্যক্তির কথা এখানে উদাহরণ সহকারে বলি- এক সময় RAB-এর লিগাল মিডিয়া উয়িং এর ডাইরেক্টর Mufti Mahmud Khan ছিলেন এবং গোয়েন্দা শাখার ডারেকটার কর্নেল Mahabub Alam এবং তারপরে সরোয়ার বিন কাসিম ছিলেন এরা তিনজনই অতি চমৎকার অফিসার। আমার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অসম্ভব ভালো ছিল এবং এখনো আছে।
 
কিন্তু তারা যখন উক্ত পদে বহাল ছিলেন তাদের প্রতি মানুষের প্রশংসা দেখে মাঝে মাঝে ভাবতাম আমি কি বোধহয় প্রশংসা না করে অপরাধ করছি!
 
আসলে আমি মনে করি- যদি প্রশংসা করতে হয় তবে সব সময় করব শুধু এখন করবো কেন? কিন্তু দেখেন সেই মানুষগুলোই জায়গা ছেড়ে যখন অন্যত্র চলে গেলেন তখন হয়তো আমার মত অতি অল্প সংখ্যক মানুষ আছেন যারা এখনও নিঃস্বার্থভাবে তাদের খোঁজ নেয়। কিন্তু তাদের সেই সময় কিন্তু প্রশংসা করিনি তবে এখন খোঁজ নেই আর তাছাড়া যারা প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতেন তারা কেউ কিন্তু খোঁজ নেয় না।

তবে একটু ব্যতিক্রমও আছে, যেমন- কেউ যদি বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বা পদ পজিশন পেয়ে থাকেন তাহলে কিন্তু উল্টোটাও হতে পারে! আবার কেউ যদি পদ/রাজনীতি থেকে অবসরে যান বা দল থেকে বহিষ্কার হন তাহলে তার নাম মুছে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।  

তাই বলছি, প্রকৃত বন্ধুদেরকে চেনার চেষ্টা করুন। আর যদি চাটুকারদের প্রশংসায় গা ভাসিয়ে দেন একসময় আফসোস করবেন এবং মনোরোগে আক্রান্ত হবেন, নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হবে, হিসাব মেলাতে পারবেন না- আপনার জীবন টাই ক্ষণস্থায়ী, আপনার চেয়ার, পদ,পজিশন তার চেয়েও বেশি ক্ষণস্থায়ী। জীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি সকল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেসব সৈনিক/কর্মচারী/কর্মকর্তা আমার অধীনে চাকরিরত ছিল বা এখনও যারা আছে তারা জানে আমি কি তাদের পাশে বেশি ছিলাম নাকি সিনিয়রদের বেশি তোষামোদ করার চেষ্টা করতাম। আর তাই তার সুফল এখন ভোগ করছি-বিপদ আপদে অনেক মানুষকেই পাই!

সবাই যা করে আমি তা করবো না- কারণ ছোটবেলা থেকেই আমি স্রোতের বিপরীত দিকে চলতে অভ্যস্ত। আমার মনে আছে ছোটবেলায় যখন আমার সমবয়সী খেলার সাথীদের নিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদী তে ঝাঁপ দিতাম তখন অধিকাংশ ছেলেই একটি কলা গাছ নিয়ে স্রোতের অনুকূলে ভাসতে চাইতো আর আমি স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে দেখতে চাইতাম-আমার সাঁতারের জোর বেশি নাকি নদীর স্রোতের শক্তি বেশি? কে কাকে পরাজিত করতে পারে? কখনো নদীর স্রোত কে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতাম আবার কখনো পেছনে চলে যেতাম, তখন একটু রেস্ট নিয়ে আবার চেষ্টা করতাম। এই দক্ষতাটা তখন খুব কাজে লেগেছিল যখন অ্যাডভান্স কমান্ডো কোর্স করতে গিয়েছিলাম। এখনো মনে পড়ে যখন অ্যাডভান্সড কমান্ডো কোর্সের ( ACC-17) সময় 1000 মিটার সুইমিং করি তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জিয়া স্যার (তৎকালীন মেজর বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার), তার মন মত performance দেখানো অনেক কঠিন কাজ ছিল, তিনি সহজে কাউকে very good বা খুব ভালো হয়েছে বলতেন না কিন্তু সেদিন তার মুখে সেই অমুল্য শব্দ দুটি শুনে ছিলাম। শৈশবের সেই দক্ষতার কারণে খুব সহজেই সেই প্রশিক্ষন পর্বটা শেষ করতে পেরেছিলাম।  

যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ জনপ্রিয়  হওয়ার প্লাটফর্ম হয় তখনই সেখান থেকে ভালো ফল আশা করা যায় না কারন জনপ্রিয়তার আড়ালে তেলবাজরা সরব হয়ে কাজের গৌরব নষ্ট করে । মানুষকে অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্য প্রশংসা করুন; চাটুকারিতা বা তেলবাজির জন্য নয়। কারন প্রথমটা কাউকে উপরে উঠতে সহায়তা করবে আর দিতীয়টা তাকে নিচে নামাতে বা ধ্বংস করতে সহায়তা করবে।

মেজর (অব.) রেজাউল করিম, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

(মত-ভিন্নমত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

আরও পড়ুন


লন্ডনের বিলাসবহুল হোটেলে মরিয়ম নওয়াজের ছেলের বিয়ে

বারবার রিমান্ডে পরীমণি: ক্ষমা চাইলেন দুই বিচারক

বছর না ঘুরতেই অন্তঃসত্ত্বা কাজল!

বাণিজ্য মেলা হবে এবার নতুন স্থানে, ১ জানুয়ারি থেকে শুরু


NEWS24.TV / কামরুল