পুরনো দিন গেছে, পুরনো লোকেরাও কবরে

পুরনো দিন গেছে, পুরনো লোকেরাও কবরে

Other

বাসার সামনে একটা বিরাট আম গাছ, নারকেল গাছ। এখানে পাখি বসতো। বাসা বানাতো। মূল সড়কের শেষ বাড়িটা আমাদের।

অপার সুখে শান্তিতে ছিলাম। আব্বা চলে গেলো। পাশের বাড়ির আঙ্কেল, আন্টিও চলে গেলো দুনিয়া থেকে। পাশের বাড়ির বিরাট চারতলাটিও ভাঙা শুরু হলো।
রাস্তার ওপারে বাসার মুখোমুখি চারতলা দুটোও ভাঙা হয়ে গেছে। এখন সেখানে অট্টালিকা উঠছে। ঢাকা শহরে জমির দাম কোটি কোটি টাকা। সেই জমিতে চারতলা পুরনো বাড়ি মানায়? বিশেষত আগের দিনের ডিজাইনের। যারা বানিয়েছেন তারাও তো নেই।

অতএব বিদায় পুরনো স্মৃতি। নতুন করে সাততলা, আটতলা আর দশতলা উঠবে। ঠিক পাশে আর মুখোমুখি কাজ চলছে সারা দিনরাত। হ্যাঁ, সারাদিন রাত। দিনে বিশাল দালানটি ভাঙে, রাতে ট্রাক এসে এইসব ভাঙা টুকরা নিয়ে যায়। অন্যপাশে ট্রাক আসে ইট, রড নিয়ে। ধুমধাম শব্দে জব্দ থাকি সারাদিন রাত।

আরও পড়ুন: 


রাসেলের বাসায় র‌্যাবের অভিযান চলছে

স্ত্রী হত্যার অভিযোগ, স্বামী-শ্বশুর পলাতক

চীনে ১০ কি.মি. গভীরতার শক্তিশালী ভূমিকম্পের হানা

দুবলার চর থেকে খুলনা কাঁকড়া পরিবহনে বাধা নেই: হাইকোর্ট


মাথার ভেতরে সারাদিন রাত হাতুড়ি, গ্রিল কাটার, সিমেন্ট মিক্সার নানা রকম মেশিনের শব্দ। টনটন তরে মাথা ব্যথা করে। মনে হয় বাসা ছেড়ে পালাই। কোনো কোনো রাতে শব্দে মনে হয় পাগল হয়ে যাবো।

news24bd.tv

একরাতে ৯৯৯ এ ফোন দিলাম। ফোন দিতে চাইনি। কে যাবে ঝামেলায় জড়াতে। যারা এ সব দালানকোঠা বানায় মানে ডেভলাপাররা তারা বড় প্রভাবশালী। তবু না-থাকতে পেরে ভোর চারটায়  ৯৯৯ এ ফোন দিলাম। তারা সদয় হয়ে স্থানীয় থানার ডিউটি অফিসারের ফোন নাম্বার দিলো। কল করলাম, কেউ ধরলো না। সবাই তো আমার মতো ভোররাত নাগাদ জেগে থাকতে বাধ্য নয়। শব্দ দূষণের মতো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে কেইবা ভাবে।

আরেকরাতে ২টার দিতে পূর্বের সেই নাম্বারে ফোন দিলাম। এবার ডিউটি অফিসারের দয়া হলো। তিনি টহল পুলিশকে আমার নাম্বার দিলেন। টহল পুলিশ চলে এলো পাঁচমিনিটে। ধমক দিয়ে কাজ বন্ধ করলো। ট্রাক চলে গেলো। আমি আইনের শাসন দেখে তৃপ্ত মনে শুতে গেলাম। পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার বিকট শব্দ! আমি বারান্দায় এসে দেখি ট্রাক ফিরে এসেছে। পূর্ণোদ্যমে ভাঙা ইট, শুড়কি, ঢালাইয়ের চাপড় ধুমধাম ফেলা হচ্ছে। টহল পুলিশের নাম্বারে ফোন দিয়ে বললাম, ভাই, আপনারা চোখের আড়াল হতেই তো তারা আবারুরু করেছে। টহল পুলিশ বললেন, বেশিক্ষণ চলবে না। ওদের একটু কাজ জমে আছে। তাড়াতাড়ি করে সরে যাবে। ওরা তাড়াতাড়ি ভোর পার করেই চলে গেলো। আলহামদুলিল্লাহ। শুতে গেলাম। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। শুতে না শুতেই উঠে পড়লাম। দেয়াল, মেঝে ভাঙার শব্দ, আমার দালানটাও কেঁপে উঠছে। ওরা আমার মতো ফাঁকিবাজ নয়, ঠিক সকাল আটটায় কাজ শুরু করেছে। দিনরাত কাজ না করলে তো উন্নতি হয় না। আমার যেমন হয়নি।

কিন্তু আমি বোধহয় উন্নতির বিরুদ্ধে। আমি বোধহয় স্বাভাবিক নই। চলতি হাওয়ার নই। স্মার্ট নই। আমার ভালো লাগে না এই বাড়িগুলো ভাঙন দেখতে। কতো স্মৃতি এখানে। একসাথে এসব বাড়ির মানুষগুলো আমরা বড় হয়েছি। আমাদের বাড়িটাও ভেঙে ফেলবে। এতো এতো আধুনিক ফ্লাটের পাশে আমাদের ছোট্ট বাড়িটাকে বড় বেমানান লাগছে সবার। আমি বাদে সবাই চায় এ বাড়িটাও আধুনিক হোক।

ভাবছি, আমিও আধুনিক হয়ে যাবো। উন্নয়নের রসগোল্লা খাবো। চোখ, কান, মন বন্ধ রাখতে শিখবো। এই দেশে থেকে শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধা, বাড়ি নির্মাণ আইনকানুন ইত্যাদিকে বুড়ো আঙুল দেখাতে শিখে যাবো। বেঁচে থাকলে আমিও নির্বিকার জীবন বেছে নেবো। সে জীবনে একটা আমগাছ, একটা নারকেল গাছ, ছোট্ট বারান্দার কী মূল্যই বা আছে! আধুনিক মানুষের জীবন চলুক পার স্কয়ার ফিটের হিসেবে। এখন তো আর সামনের বাড়ি বা পাশের বাড়ি থেকে ইফতারি, হালুয়া, গোস্ত, রুটি আসে না। ও সব পুরনো দিন গেছে। পুরনো লোকেরাও কবরে।

নতুনরা পার স্কয়ারে কতো হাজার পাওয়া যাবে, গ্যােজ সহ ফ্ল্যাট কতো তাই নিয়ে ভাবছে। আমি ভাবছি আমার বাবা, পাশের বাড়ির কাকারা এতো উন্নয়নের ব্রেকিং নিউজ কী কবরে শুয়ে শুনতে পাচ্ছেন!

এ এলাকাটা পানিতে ডোবা ছিলো। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে আসতাম। এখানে জমি কেনায় আমার বাবাকে অনেকেই বেকুব বলতো। আব্বা, তুমি বেকুব ছিলে বলেই ঢাকা শহরে নিজের বাড়িতে বাস করতে পারছি। আর জাতি বুদ্ধিমান বলেই নিজের বাড়িতে আমি বিশ্রাম নিতে পারছি না, দুপুরে, রাতে, বিকেল।

নাদের আলি, আর কতো দালান উঠলে আমাদের উন্নতির শেষ হবে?

লেখাটি মুম রহমান-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।  (সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর