ইভ্যালী-পঞ্জি স্কীমস: কই এর তেলে তিমি ভাজা!

ইভ্যালী-পঞ্জি স্কীমস: কই এর তেলে তিমি ভাজা!

Other

ইভ্যালীর রাসেল দম্পতি যা করেছে ঠিক ১০০ বছর আগে সেটি প্রথম করে দেখিয়েছিল Charles Ponzi নামের এক প্রতারক।

১৯২০ সালে নিউ-ইংল্যান্ডে ৯০ দিনের মধ্যে ফোরটি পার্সেন্ট রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবসা শুরু করে Ponzi যখন পারিপার্শ্বিক সুদের হার ছিল 5% মাত্র।  

তারপর পঞ্জির বিরাট বিত্ত-বৈভব, জেলখাটাসহ আরও অনেক ইতিহাস। সেদিকে যাচ্ছি না।

Ponzi র মতো করে যে প্রতারণা ব্যবসা মডেল দাঁড় করানো হয় তাকে বলে Ponzi scheme। ইভেলি ভিন্ন চেহারায় প্রায় হুবহু সেই পঞ্জি স্কিম প্রতারনাটা নকল করেছে।

সোজা বাংলায় পঞ্জি স্কীমস একটা পিরামিড আকৃতির ফন্দি যার মূল মন্ত্র হলো Robbing Peter to pay Paul অর্থাৎ পিটারের টা চুরি করে পল কে pay করা। প্রতারক প্রমোটররা যদি প্রথমদিকের বিনিয়োগকারীদের বিরাট লাভ দিয়ে চমক সৃষ্টি করে তাতে আকৃষ্ট পরের দিকের ইনভেস্টরদের টাকা মেরে দেয় তবে তা পঞ্জি স্ক্যাম এর আওতায় পড়ে।

তাদের কোন টেকসই বিজনেস মডেল থাকে না, নিজেদের কোনো বৈধ বা যুক্তিসঙ্গত প্রফিটও থাকে না। তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে নতুন নতুন বিনিয়োগকারীদের প্রবাহমান টাকার উপর। সেই টাকার প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে পুরো চিটিং process টাই কলাপ্স হয়ে যায় কারণ তাদের নিজেদের কিছু থাকে না।

প্রতারক প্রোমোটারদের ধূর্ততা ও কৌশলের উপর পঞ্জি স্কীম ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও চেহারার হতে পারে। তবে প্রত্যেকেরই মূল মোক্ষ শুরুর দিকের বিনিয়োগকারীদের একটা বড় অংকের লাভ দিয়ে কৌশল ও ছলচাতুরি করে পরের বিনিয়োগকারীদের বিরাট অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া। লাভ দেখে বিরাট জনগোষ্ঠী বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে। যদি ছলা-কলা করে পরবর্তী বিনিয়োগকারীদের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা না করে তখন তার প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পুঞ্জিভূত হতে থাকে।  

দুঃখজনকভাবে অনেকে ধরা খেলেও চুপ থাকে এজন্য যে কোম্পানির ক্ষতি হলে তার টাকা ফেরত পাবার বাকি আশাটুকুও আর থাকবে না। এর ফলে আরও বেশি দিন প্রতারক প্রমোটররা তার ধূর্ততা চালিয়ে যেতে পারে। লোকজন তাকে বোকা ও লোভী ভাববে এ জন্য অনেকে ফুঁসে উঠতে বিলম্ব করে। কেউ কেউ লজ্জায় একেবারেই চেপে যায়। অনেকেই বিনিয়োগ ফিরে পাবার ক্ষুদ্রতম আশার উপর ভিত্তি করে বরং প্রতারকের জন্য শুভকামনা বজায় রেখে প্রতারকের পক্ষে নেয় যাতে কোম্পানি টাকা শোধ করার সক্ষমতা অর্জন করে। এ-সবই পঞ্জি স্ক্যাম এর বৈশিষ্ট্যাবলী (Universal criteria) আপনি যখন কোথাও টাকা খাটাবেন তখন যে ব্যাপারগুলি মাথায় রাখবেন তার একটা ছোট বর্ণনা দিচ্ছি।  

আরও পড়ুন:


অবশেষে ব্রিটেনের লাল তালিকা থেকে বাদ পড়ছে বাংলাদেশ

বেড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত মদ পানে দুই ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যু

ছাত্রকে যৌন হয়রানি ২৭ বছরের তরুণীর, ২০ বছরের কারাদণ্ড

ইভ্যালির সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই তাহসানের


১. অস্বাভাবিক মাত্রার লাভ, ছাড় বা রিটার্নের ঘোষণা পঞ্জি স্ক্যাম এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট লক্ষণ।

চেহারা যাই হোক অন্য যে কোন ব্যবসার তুলনায় তারা আপনাকে বেশি লাভ বা ছাড় দিবে- এব্যাপারটা থাকবেই। "অতি লাভ বিপদজনক" কোথাও বিনিয়োগের আগে সেটা আপনাকে মন্ত্র হিসাবে মেনে নিতে হবে। সুষ্ঠু বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় শত্রু আপনার লোভ। প্রতারকদের পক্ষে আপনাকে ঠকানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্রও আপনার লোভ। (শেয়ার মার্কেট দ্রষ্টব্য)

২. আপনার মনের গভীরে প্রোথিত লোভকে উস্কে দেওয়ার দারুন টেকনিক হলো লাভের গ্যারান্টি দেয়া। শতভাগ লাভ হবেই একেবারেই ফুল গ্যারান্টি, নো রিস্ক, এমন অঙ্গীকার যারা করবে খুব সম্ভবত তারা ফ্রড।

৩. পতনের আগ পর্যন্ত কোন ব্যবসা যদি স্বাভাবিক বেগ বা সময়ে সময়ে মন্থরতার পরিবর্তে ত্বরণের উপর থাকে তথা খুব দ্রুত বর্ধনশীল হয়, পরের দিন পরের সপ্তাহ আগের দিন আগের সপ্তাহকে ছাড়িয়ে যেতেই থাকে তবে ধরে নিবেন ঘাপলা ইজ দেয়ার। সবাইকে হুমড়ি খেয়ে পড়ানোর এটা একটা ট্র্যাপ।

বাজার পরিস্থিতি, নিজেদের সক্ষমতা যাই হোক তারা যদি আপনাকে লাভের অফার দিতেই থাকে, দৌড় দিন- একেবারে পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

৪. পাচ মিনিট চিন্তা করে আপনি যদি তাদের বিজনেসটা কিভাবে বা কোন মডেলের উপর চলছে বা চলবে তার কূল-কিনারা করতে না পারেন- একে গুডবাই বলুন। বিজনেস মডেলটা বুঝতে যদি বেগ পেতে হয় লাভের টাকাটা কোথায় জেনারেট হচ্ছে সেটা যদি আপনার কাছে পরিস্কার না হয় আপনি ভুলেও তার কাছে ঘেষবেন না।

৫. প্রতারক প্রমোটররা নানাবিধ জটিল মোহনীয় চাতুর্যপূর্ণ শব্দ ও বাক্য দ্বারা আপনাকে আবিষ্ট করতে নটরিয়াসলি চতুর। যেমন offshore investment program, Future Amazon, From loss to global brand, high yield investment, তারুন্যের ঝুঁকি- এসব বাক্যবাণে তারা আপনাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলবে। তারা অন্যসব বড় ব্যবসা কিভাবে দাঁড়িয়েছে তার উদাহরণ দেবে মিথ্যা তথ্য সমেত। যাদুবিদ্যার মতো আড়ালে বড় কিছু হচ্ছে এমন একটা ইলুশান ও কনফিউশনে সবাইকে মজিয়ে রাখবে আসলে কিন্তু ভেতরে কিছুই হচ্ছে না। শুধু কই এর তেলে কই ভাজা হচ্ছে। এই smoke & mirror পঞ্জি প্রতারকদের অন্যতম টেকনিক। এ জন্য ওয়ারেন বাফেট বলেছিলেন, never invest in a business you can not understand (যে ব্যবসাটা তুমি বুঝতে পারছো না সেখানে বিনিয়োগ করিও না)।

৬. এই পঞ্জি স্ক্যাম এর টিকে থাকার প্রাণভোমরা হলো নতুন নতুন বিনিয়োগকারী। এজন্য তাদেরকে আকৃষ্ট করতে প্রয়োজন হয় নতুন নতুন ধামাকা অফার। নতুন বিনিয়োগকারী না আসলে এই প্রতারকরা পুরাতন বিনিয়োগকারীদের দায় শোধ করতে পারে না। অবশ্য দায় শোধ করাটা প্রতারকদের উদ্দেশ্যও নয়। একেবারে প্রথম পর্বের বিনিয়োগকারীদের লাভালাভের উদাহরণকে পুঁজি করে পরবর্তীদের যত বেশি সম্ভব বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করে যত বেশি সম্ভব টাকা মেরে দেয়া যায়- এটাই পঞ্জি মডেল বিজনেস। যদি এক পর্যায়ে আপনাকে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে দেয়ার শর্ত দেয়া হয় বা নতুন বিনিয়োগকারী জুটিয়ে দিতে পারলে পুরষ্কার দেয়া হবে বলা হয় বা আপনাকে পুনরায় বিনিয়োগ করলে আগের চেয়ে বেশি লাভ দেওয়া হবে এমন অফার দেয়া হয়- আপনি জাস্ট অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের চেয়েও বেশি গতিতে দৌড় দিবেন।

৭. প্রতারক প্রমোটাররা যদি কোন কৃত্রিম urgency  তৈরি করে, Once in a life time, আর মাত্র দু'দিন, রাত বারোটায় সুযোগ শেষ- এরকম তড়িঘড়ি আবহ তৈরি করে তবে ধরে নিবেন এটি সুস্থ প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। একে বিবেচনা করুন red flag হিসাবে।

৮. পঞ্জি স্কীমস প্রতারকরা মূল পদগুলিতে তাদের ক্লোজ সার্কেল ও পরিবারের সদস্যদেরকে রাখে। দেখা যাবে ঘুরেফিরে নিজেরা নিজেরাই। এতে তারা নির্ভয় থাকে এবং ভাগাভাগিটা নিজেদের মধ্যেই হয়। শিয়াল কখনো নিজের ঢেড়ায় শিকার করেনা, চোর কখনো নিজের ঘরে চুরি করে না- এ হলো তাদের নিরাপত্তা কৌশল।

৯. তাদের আরেকটা পাওয়ারফুল সাইকোলজিক ট্যাকটিক হল সমাজের গণ্যমান্য, সেলিব্রিটি, নামকরা লোক ও লেখকদের সাথে এসোসিয়েশন বা জোটবদ্ধতা দেখানো। এতে করে তাদের গ্রহণযোগ্যতা, ক্রেডিবিলিটি বাড়ে, স্বল্পবুদ্ধির লোকদেরকে সহজেই সেলিব্রেটির ইমেজের ফাঁদে ফেলানো যায়। পঞ্জি মডেল স্কিমে বাংলাদেশের বাইরেও দেখা গেছে কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি যদি বাহিরে ভালো ভেতরে অসৎ হন তবে তার ইমেজ fraud দের ফেভারে কাজে লাগাতে দেন। বিনিময়ে fraud দের কাছ থেকে আর্থিক ভাবে লাভবান হন। একে বলে win-win সিচুয়েশন, ধরা খাবে শুধু পাবলিক। যেমন ইভ্যালির পক্ষে কথা বলা তাহসান, এহসান গ্রুপের পক্ষে ওয়াজ করা হেলিকপ্টার হুজুর ইত্যাদি।

১০. একশত বছর পিছিয়ে থাকার কারণে পঞ্জি যে কাজটা করতে পারে নাই বা পঞ্জি স্কীমস বাংলাদেশের বাইরে যে ব্যাপারটা চোখে পড়ে নাই অথচ ইভেলি করে দেখিয়েছে তা হল হাজার হাজার ফেইক ফেসবুক আইডি খুলে "আমি লাভবান" প্রচার করে অন্যদের আকৃষ্ট করা ও কোন প্রতিবাদকারীর উপর অনলাইনে দলেবলে হামলে পড়া। একজন ক্ষতিগ্রস্থের কমেন্ট এর বিপরীতে যদি দশজন ফেইক ফেসবুক ইউটিউব আইডি "কই আমিতো লাভবান হলাম" প্রচার করে তাহলে মূল সত্যটা চাপা পড়তে বাধ্য। এ কাজটা ইভেলি মারাত্মক সফলতার সাথে করেছে। আমি বিশ্বের যতগুলি পঞ্জি স্ক্যাম এর উপর টুকটাক পড়েছি তার কোথাও এই টেকনিকটা চোখে পড়ে নাই। এটা পঞ্জি স্কীমে নতুন সংযোজন।

১১. পঞ্জি স্কীমে বাংলাদেশ আরেকটা নতুন ব্যাপার সংযোজন করতে পেরেছে তা হল মাওলানার ওয়াজ এর মাধ্যমে মুনাফিকির ভয় দেখিয়ে বিনিয়োগ বাড়বাড়ন্ত করা। দেশ বলদে ভর্তি বলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে পঞ্জি স্কীমে এই ইউনিক ব্যাপারটি সংযোজন করা।

আসলে হঠাৎ বড়লোক, বিরাট লাভবান করে দেওয়ার যে হাতছানি সেটা সবসময়ই প্রতারকদের হাত। আমাদেরকে সত্যিকারের কিছু পেতে হলে মাথা ও শ্রম খাটিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবেই তা পাবার আশা করতে হবে। তা না হলে কিছুদিন পরপর ডেসটিনি, শেয়ার মার্কেট, যুবক, ইউনিপে, ইঅরেঞ্জ, এহসান গ্রুপ, ইভ্যালি এসব প্রতারক চক্র নানা নামে, নানা চেহারায়, নানা বেশে এসে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যাবে।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

NEWS24.TV / কামরুল