রাজনীতি কারও চিরস্থায়ী জমিদারি নয়

রাজনীতি কারও চিরস্থায়ী জমিদারি নয়

Other

‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বল তো’ ছবির নাম সপ্তপদী। উত্তম-সুচিত্রার দারুণ রোমান্টিক ছবি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানটি গেয়েছেন হেমন্ত ও সন্ধ্যা মুখার্জি। পথ শেষ হতে দিতে না চাইলেও একসময় শেষ হয়ে যায়।

বেলা শেষে ফিরতে হয় বাড়ি। আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো পাখিরাও নীড়ে ফেরে অন্ধকার নামলে। এই তো জীবন। এর বাইরে আমরা যাই কী করে? প্রকৃতি অনেক নিয়ম-কানুন বেঁধে পাঠিয়েছেন জগৎ-সংসারে।
এ নিয়মের ব্যত্যয় হয় কখনো কখনো। এ কারণে হয়তো কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, সব ঠিক আছে তো? জবাবে বলি, কীসের মাঝে কী, পান্তা ভাতে ঘি! সব ঠিক না থাকার কোনো কারণ তো দেখি না। দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়। রাজনৈতিক সরকারের একটা আলাদা হিসাব-নিকাশ থাকে। জনসম্পৃক্ততা রেখে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ওয়ান/ইলেভেন-মার্কা সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকার সময় যা মনে আসে তা-ই করে। দূরত্ব তৈরি করে সবার সঙ্গে। আপন-পর বলে কিছু থাকে না। জনসম্পৃক্ততার ধার ধারে না। অকারণে সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী সবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। নতুন নতুন উইং খোলে। সরকারের ভিতরে তৈরি হয় সরকার। কে কোথায় কী কাজ করছে সমন্বয় থাকে না। পরে কঠিনভাবে ধরা পড়লে কেউ পাশে থাকে না। মইন-ফখরুদ্দীনের খবর এখন কেউ নেয় না। অথচ একসময় তাদের অনেক তোষামোদকারী ছিল। অভাব ছিল না চাটুকারের।

এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। বাস্তবতা আলাদা। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাংলাদেশ দিয়েছেন। তাঁর মেয়ে দেশকে এগিয়ে দিচ্ছেন। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ নতুন উচ্চতায়। উন্নয়ন -সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশালত্ব অর্জন করেছে। দেশ-বিদেশে প্রশংসা হচ্ছে। সে সমৃদ্ধি অনেকের পছন্দ নয়। উন্নয়ন ব্যাহত করতেই চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। বাইরের শত্রু নিয়ে চিন্তা নেই। ভয় ঘর নিয়ে। অনেক মানুষের অতি উৎসাহ নিয়ে। বাইরের মানুষদের বোঝা যায়। ঘরেরগুলো চেনা যায় না। সরকারের ভিতরে ঢুকে পড়েছে উইপোকা। দেশ-বিদেশে সরকারবিরোধী কুৎসা রটানোর উৎসব চলছে। মিথ্যাচারের রেকর্ড অতীতের সব সময়কে হার মানিয়েছে। কিন্তু কুৎসা রটনাকারীদের নিয়ে সরকারি উইংগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। দেখার, ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। জাগতিক সমস্যাহীন জগতে তারা অকারণে খুলছে নতুন নতুন উইং। কারা খুলছে, কেন খুলছে জানি না। শুধু জানি অকারণে আপনজনদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানি না। নিয়তি বলে একটা কথা আছে। চাইলেও আমরা কেউ নিয়তির বাইরে যেতে পারি না। ইতিহাস তা-ই বলে। অসুস্থতার জগৎটা সাময়িক দাবিয়ে বেড়ায়।

নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিটলারের ডান হাত ছিলেন মিথ্যার রাজা গোয়েবলস। তার কাজই ছিল মিথ্যা প্রচারণা চালানো। তার বিখ্যাত থিওরি ছিল- ‘একটি মিথ্যাকে বারবার প্রচার কর। একসময় সবাই সত্য বলে ধরে নেবে। বিশ্বাস করতে শুরু করবে। ’ আসলেও তাই। আজকাল সত্যকে বিশ্বাস করানো কঠিন। মিথ্যা আর গুজবের প্রতি বাঙালির একটা মমত্ব আছে। ফিসফাঁস শুনতে ভালো লাগে। আড়ালে কথা বলে আনন্দ পায়। হিপোক্র্যাসি মানুষের অন্দরে লুকিয়ে থাকে। নিজের অপকর্মের খবর নেই, অন্যকে নিয়ে গুজবে কান দেয় সবাই। ফেসবুক, ইউটিউবে এ কাজটি গভীর মনোযোগ দিয়ে করছে। মিথ্যাচারে কিছু মানুষ লাইক শেয়ারে ডলার কামাচ্ছে। সুস্থধারার রাজনীতি না থাকায় মিথ্যাচারকে উৎসাহিত করছে সবাই লাইক, শেয়ার দিয়ে। বঙ্গবন্ধু পরিবার ও সরকারের বিরুদ্ধে কতটা মিথ্যাচার হচ্ছে তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ভাবখানা এমন- সরকার ডুবলে কারও কোনো দায়ভার নেই। জবাবদিহি নেই। ভাবতে অবাক লাগছে সরকারের গোপন কাগজপত্র, ডকুমেন্ট সাইবার ক্রিমিনালদের কাছে চলে যাচ্ছে! কীভাবে যাচ্ছে, কারা পাঠাচ্ছে সেসব নিয়ে কারও জবাবদিহি নেই। অনেকে বুঝতেই পারছে না- ‘এই দিন দিন না, আরও দিন আছে’।

স্বার্থপরদের একটা যুগ চলছে। আওয়ামী লীগের খেয়ে-পরে কেউ কেউ বারোটা বাজাচ্ছে দলটির। কোথায় যেন একটা অসংগতি চলছে। সুর-তাল-লয়ের ঘাটতি আছে। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। সরকারের পৌনে তিন বছর চলে গেছে। আগামী দুই বছর সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই সময়ে অনেক কিছু দৃশ্যমান করতে হবে। উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার বাস্তব চিত্রের প্রকাশ ঘটাতে হবে। কথামালার রাজনীতি ভুলে বাস্তবতার নতুন গতিপথে ফিরে আসতে হবে। দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারিত মিথ্যা ও কুৎসার জবাব দিতে হবে। বিভিন্ন খাতের হারানো ইমেজ জাগিয়ে তুলতে হবে। নতুন ধ্যান-ধারণার সময়কে অস্বীকার করা যায় না। সময়কে আড়াল করা যায় না। ইতিহাস সব সময় আপন মহিমায় একই তালে ঘুরে-ফিরে আসে না। অনেক সময় উল্টো স্রোতেও ভেসে যায়। চিরদিন ভোট একই কায়দা-কৌশলে হয় না। ১৯৭০ সালে যেভাবে হয়েছে ’৭৩ সালে একইভাবে হয়নি। আবার ’৭৯, ’৮৬, ’৮৮ ছিল আলাদা। ’৯১, ’৯৬, ২০০১ হয়েছিল ভিন্নমাত্রায়। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লোক দেখানো স্বল্প সময়ের একটি ভোট দেখেছে দেশবাসী। সে ভোটের কোনো আগামাথা ছিল না। বিএনপি একই ধরনের আরেকটি ভোট করতে চেয়েছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। পারেনি। স্বপ্ন তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ধরা পড়েছিল নিজেদের তৈরি ফাঁদে। বিএনপিকে এখনো কঠিন খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে সেসব কান্ডের।

সাদা চোখে সবকিছু গতিশীল ও স্বাভাবিক মনে হয় ক্ষমতায় থাকলে। কিন্তু অতি ভালো অনেক সময় ভালো হয় না। এমপি-মন্ত্রী সাহেবরা এখনো ব্যস্ত ভাই লীগ, আত্মীয় লীগ, শ্যালক লীগে। দলের কর্মীদের মূল্যায়ন নেই। হাইব্রিডদের উৎপাতে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কর্মীরা অনেক এলাকায় এতিমের মতো দিন কাটান। মন্ত্রী-এমপিরা এলাকায় যান না ঠিকমতো। ভাবেন ভোট ও জনগণ কোনোটারই দরকার নেই। সবকিছু একতালে যাবে। তাই অনেকে রাজনীতিটা করেন শুধু পরিবার আর চামচা লীগ নিয়ে। বঞ্চিত হচ্ছেন কর্মীরা। সুবিধাবাদী লীগ ব্যস্ত বাণিজ্য নিয়ে। আওয়ামী লীগের সত্যিকারের মাঠের কর্মীরা আছেন আগের মতোই। আবার দুঃসময় এলে এরাই থাকবেন। সুবিধাভোগীরা খারাপ সময়ে থাকে না। কেউ একবার সুবিধা পেলে বারবার চান। আক্ষেপ করেন একটি ব্যবসা পেয়েছেন আরও কেন পাননি। যিনি একবার মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন তার দুঃখ- বারবার কেন হন না। প্রেষণে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্তদেরও কষ্টের শেষ নেই। তাদের দুঃখ- বারবার কেন পান না। কেউ বুঝতে চান না এই দলে নেতা-কর্মীর অভাব নেই। সবারই চাওয়া-পাওয়ার হিসাব আছে। দুঃসময়ের অনেক কর্মীই সরে গেছেন, সরে আছেন। অভিমানী মনে অন্ধকার মেঘ জমেছে। আলো-আঁধারির খেলার দিনেও কুমিল্লা-৭ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। ভালো মানুষ। ভদ্রলোক। এই কঠিনতম সময়ে একজন প্রাণ গোপালের মূল্যায়ন দেখে ভালো লাগছে। প্রয়াত এমপিদের শূন্য আসনে মনোনয়ন নিয়ে শেখ হাসিনার সঠিক একটি অবস্থান প্রশংসিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসছে প্রয়াত এমপি পরিবার থেকে। দুঃসময়ের মানুষদেরও চাওয়া-পাওয়া আছে। রাজনীতি জমিদারতন্ত্র নয়। কোনো আসনই কারও জন্য চিরস্থায়ী নয়। ভালো-মন্দ কাজের হোক মূল্যায়ন। দুঃসময়ে অবদানের স্বীকৃতি পাক সবাই। আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসুক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রয়াতদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের মনোনয়নের ধারাবাহিকতা থেকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, শেখ হাসিনার স্বাপ্নিক যাত্রা এগিয়ে চলুক বাস্তবতার নিরিখে। চলার পথে কখনো কখনো সংসারের হিসাবের খাতায়ও পরিবর্তন আনতে হয়। চিরদিন এক হিসাবের খাতায় চলতে পারে না। সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকার তিনটিসহ বিভিন্ন আসনে এমপি পরিবারের বাইরে মনোনয়ন প্রদান ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা। শেখ হাসিনার আরেকটি শুভ উদ্যোগ। এ উদ্যোগ নেত্রীর প্রতি আস্থা আরও বাড়াবে কর্মীদের। কারণ এখনো তাদের বিশ্বাস-আস্থার ঠিকানা একজনই। এটাই কঠিন বাস্তবতা। এ বাস্তবতা নিয়েই টিকে আছে আওয়ামী লীগ। আগামী দিনেও টিকে থাকবে। যদিও এখন পাড়ায় আপনি মোড়ল-মার্কা লোকেরও অভাব নেই। হামবড়া ভাবসাবের হাইব্রিডরা নানামুখী দোকান খুলে বসেছে। খারাপ সময় এলে বানের পানির মতো ওরা ভেসে যাবে। চারদিকের কথার রাজারা হারিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন


সূরা বাকারা: আয়াত ৮০-৮৪, ইহুদীদের ধারণাকে আল্লাহর মিথ্যা ঘোষণা

বিদ্যুৎ উৎপাদনের মেগা হাব হচ্ছে মহেশখালীর মাতারবাড়ী

ইভ্যালীর এমডিকে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ঢাবির হল খুলছে ৫ অক্টোবর


নিজেকে ভাবেন বিশাল লেখক কেউ কেউ, তাদের লেখা কেউ পড়ে না। বিশাল রাজনীতিবিদ ভাবেন অথচ কোথাও কোনো অনুসারী নেই। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। কথায় আছে- অতি ঘরনি ঘর পায় না। অতি সুন্দরী বর পায় না। বড় বড় কথা বলা সহজ। বড় কাজ করা কঠিন। সবকিছুতে খুঁত ধরলে চলে না। বাস্তবতায় থাকতে হয়। নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা বলে লাভ নেই। জোর করে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয় না। ষাটের দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নেতৃত্ব আর প্রত্যাশা করি না। সাহস সবার নেই। রাজনীতিতে সাহস, সততা দুটোই দরকার। ষাটের দশক ইতিহাস হয়েছে। এ কারণে হয়তো মতিয়া চৌধুরী একজনই। বারবার ঘুরে-ফিরে আসেন না। এ যুগে, নষ্ট সমাজে প্রত্যাশাও করা যায় না। আমার ভাতিজিদের নিয়ে বাবা বলতেন, নাতনিরা বড় হয়ে মতিয়া চৌধুরীর মতো অগ্নিকন্যা হবে। দুঃসাহস নিয়ে চলবে। কাউকে তোয়াক্কা করবে না। ইতিহাসের সবাই সাহসী হয় না। সবাই পথ দেখায় না। এখন উপমা দেওয়ার মতো নেতা-নেত্রী নেই রাজনৈতিক দলে। সারা দেশের মানুষ চেনে এমন ছাত্র নেতৃত্ব নেই। সুস্থধারার সংস্কৃতি এগিয়ে নেওয়া মানুষও চলে গেছেন। নতুন করে চেতনার কেতন জাগিয়ে তোলার সংস্কৃতিসেবী তৈরি হয়নি। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। মানুষ এখন আর জটিলতা চায় না। চায় না বলেই সিনেমা হল নয়, ঘরে বসে নেটফ্লেক্স দেখছে। প্রাণবন্ত সংসদ নেই, ইউটিউবে অন্যের কুৎসা দেখে বিকৃত আনন্দ নিচ্ছে। আলাপ-আলোচনা করছে কুৎসা রটনাকারী বিকৃতদের নিয়ে। ছোটকালে শুনেছি কলিকালে জগৎ-সংসারে ভালো মানুষগুলো চুপসে যাবে। খারাপদের উল্লাস চলবে। হৃদয়ের আকুলতা নিয়ে ভালো কাজে মানুষ মনোনিবেশ করবে না। খারাপ দেখবে, শুনবে প্রতিবাদী হবে না। পথচলার মানুষগুলোকেও চেনা যাবে না। ভালো-মন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আলাদা করে সামনে আসবে না।

কঠিন এক সময় অতিক্রম করছি। কেউ বলছে না দেশকে এগিয়ে নিতে সাহসী মানুষের দরকার। সুস্থধারার সংস্কৃতি দরকার। মানুষ ধরেই নিয়েছে কোনো ধরনের সুস্থতা আর আসবে না, অসুস্থতাই টিকে থাকবে সবখানে। কেউ বুঝতে চাইছে না মানুষের মধ্যে আছে শয়তান, আছে ফেরেশতা। হিসাব-নিকাশ দিন-দুনিয়াতেই হয়ে যায়। পরকালের অপেক্ষা করতে হয় না।   ইহকালের বিচারটা অন্যভাবে হয়। অনেক সময় সাদা চোখে তা ধরা পড়ে না। আবার কখনো কখনো শেষ পরিণতিটা সবাই দেখে যায়।

লেখক: সিইও, নিউজ টোয়েন্টিফোর ও সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

news24bd.tv এসএম