আল্লাহর সালাম পেতেন যে নারীরা

ওয়াহাবিদের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগে বিবি খাদিজার (সা) পবিত্র মাজার ও বর্তমান যুগে তাঁর পবিত্র কবরের ছবি।

আল্লাহর সালাম পেতেন যে নারীরা

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

মানবজাতির চার শ্রেষ্ঠ নারীর মধ্যে অন্যতম হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (সালামুল্লাহি আলাইহা)।

অন্য তিনজন হলেন নিজ কন্যা হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.) যিনি সব যুগের নারী জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, হযরত মরিয়ম (সা.), ফেরাউনের স্ত্রী তথা মুসা (আ.)'র মাতৃতুল্য লালনকারী হযরত আসিয়া (সা.)।

আজ হতে ১৪৪২ বছর আগে এই দিনে (১০ই রমজান) ইন্তিকাল করেন খাদিজা।

হযরত খাদিজা ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুসলমান।

বিশ্বনবীর (সা.) পেছনে প্রথম যে দুইজন জামায়াতে নামাজ আদায় করেছেন তারা মধ্যে উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.) একজন। অন্যজন হলেন- বালক আলী (আ.)। খাদিজা (সা.) মহান আল্লাহর এতটা নৈকট্য লাভ করেছিলেন। আর এজন্য যখন হযরত জিবরাইল (আ.) ওহী নিয়ে বিশ্বনবীর (সা.) কাছে নাজিল হতেন তখন তিনি প্রথমে মহান আল্লাহর সালাম পৌঁছে দিতেন এই মহীয়সী নারীর কাছে।

মহানবীর (সা.) সঙ্গে বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর কাটিয়েছেন মহীয়সী নারী হযরত খাদিজা (সা.)। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন বিশ্বনবী (সা.) অন্য কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি।

রাসূল (সা.)-কে বিয়ের আগেও হযরত খাদিজা(সা.) ছিলেন একত্ববাদী ও হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র ধর্মের অনুসারী এবং আরব জাতির মধ্যে সবচেয়ে ধনী মহিলা। হাজার হাজার উট তাঁর মালিকানাধীন বাণিজ্য-সম্ভার দেশ থেকে দেশে বহন করত বলে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বনবীর (সা.) সঙ্গে বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ৪০ বছর।

বিশ্বনবীর (সা.) সঙ্গে বিয়ের ১৫ বছর পর মহান আল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর স্বামীকে নবুওত দান করেন। তখন থেকেই উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.) নিজের সব সম্পদ বিশ্বজনীন ধর্ম ইসলামের প্রচার-প্রসার ও নির্যাতিত নও-মুসলিমদের ভরণ-পোষণের কাজে ব্যয় করতে থাকেন। ইসলামের পেছনেই ব্যয় হয়ে যায় তাঁর সমস্ত সম্পদ। ফলে তাঁর ইন্তিকালের পর ইয়াতিম কন্যা ফাতিমা (সা.) একটি মুদ্রা পরিমাণ সম্পদও উত্তরাধিকারসূত্রে (মায়ের কাছ থেকে) লাভ করেননি।

বিশ্বনবীকে (সা) বিয়ে করার কারণে মক্কার কাফির সম্প্রদায়ের মহিলারা বিবি খাদিজাকে বয়কট করেছিল। ফাতিমার (সা) জন্মের প্রাক্কালে কাফির সম্প্রদায়ের অভিজাত মহিলারা তাঁর সেবার জন্য কোনো নারীকে পাঠায়নি। কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ ও কুদরতের ছায়ায় তিনি ফাতিমা (সা.)-কে প্রসবের সময় দেখতে পান যে তাঁর সেবা করার জন্য বেহেশত থেকে এসেছেন ইসহাকের (আ) মা বিবি সারা, ঈসার (আ) মা বিবি মারইয়াম, ফিরআউনের স্ত্রী আছিয়া এবং হযরত মূসার বোন উম্মে কুলসুম।

উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা. আ) বলেছেন, ‘ফাতিমার জন্মগ্রহণের সময় সাহায্য করার জন্য আমি কুরাইশ নারীদের ডেকেছিলাম। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। বলে আমি মুহাম্মাদকে বিয়ে করেছি এজন্য তারা আসবে না। আমি কিছুক্ষণের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ দেখলাম চারজন উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় দীর্ঘকায়া বিশিষ্ট নারী আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।

আমাকে আতংকিত দেখে তাঁরা বললেন, হে খাদীজা! ভয় পাবেন না। আমি ইসহাকের মা সারা (হযরত ইব্রাহিম আ. এর স্ত্রী), আর অপর তিনজন হলেন ঈসার মা মারইয়াম, ফিরআউনের স্ত্রী আছিয়া এবং মূসার বোন উম্মে কুলসুম। আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে সাহায্য করতে। এ বলে সেই জ্যোতির্ময় নারীরা আমার চারপাশ ঘিরে বসলেন। আমার মেয়ে ফাতিমা জন্মগ্রহণ করা পর্যন্ত তাঁরা আমার সেবা করলেন। ’ কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) যখন হযরত খাদিজার (সা. আ) গর্ভে ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে মা খাদিজা কথা বলেছেন বলে বর্ণনা রয়েছে।

মক্কায় জান্নাতুল মোয়াল্লা কবরস্তানে ওয়াহাবিদের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগে বিবি খাদিজার (সা) ও রাসুল-(সা) ছেলে  কাসিমের (আ) পবিত্র মাজার
ইসলামের শৈশবে এর শত্রু কাফির-মুশরিকরা যখন মুসলমানদের ওপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ আরোপ করে তখন শো'বে আবু তালিব উপত্যকায় দিনের পর দিন অনাহারে থাকতে হয়েছিল উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.)-কে।

ইসলাম প্রচারের প্রথম দিনগুলোতে যখন রাসূল (সা.)-কে নানাভাবে অপমান ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের শিকার হতে হতো এবং তাঁর মাথায় ছাই বা পশুর নাড়ীভুঁড়ি চাপানো থেকে শুরু করে দাঁত-মুবারক পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলেছিল শত্রুরা তখন সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী হিসেবে পাশে ছিলেন জীবন-সঙ্গী উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.)।

উম্মুল মুমিনিন খাদিজার (সা.) পবিত্র স্মৃতি যখনই স্মরণে আসত বিশ্বনবীর (সা.) পবিত্র দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ত অশ্রুধারা। অন্য কোনো স্ত্রীই হযরত খাদিজার (সা.) সমকক্ষ নন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) খাদিজা (সা.) বান্ধবীদেরকেও শ্রদ্ধা করতেন।

একবার বিশ্বনবীর (সা.) কোনো এক স্ত্রী নিজেকে হযরত খাদিজার (সা.) চেয়ে উত্তম বলে দাবি করেন। এসময় আল্লাহর রাসূল তাকে তিরস্কার করেন। বলেন, ‘আল্লাহর কসম, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর চেয়ে কোনো উত্তম স্ত্রী দান করেননি। তিনি আমার প্রতি তখনই ঈমান এনেছিলেন যখন অন্যরা আমাকে বিদ্রূপ করত, তিনি আমাকে তখনই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যখন অন্যরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তিনি তার সম্পদ ব্যয় করেছেন আমার জন্য এবং তাঁর মাধ্যমেই আমি সেইসব সন্তানের অধিকারী হয়েছি যা অন্য কোনো স্ত্রীর মাধ্যমে আমার জন্য নির্ধারিত হয়নি। (বুখারি শরিফ)

বলা হয়ে থাকে বিশ্বনবীর (সা.) চারিত্রিক সুষমা ও মহানুভবতা, আলীর (আ.) তরবারি এবং খাদিজার (সা.) অঢেল সম্পদ ছাড়া ইসলাম কখনও এতটা বিকশিত হতে পারত না।

যে বছর হযরত খাদিজা (সা.) ইন্তিকাল করেন সেই বছর ইন্তিকাল করেন রাসূলের (সা.) প্রিয় চাচা ও অভিভাবক হযরত আবু তালিব(রা.)। তাই এ বছরটিকে ইসলামের ইতিহাসে 'আমুল হোজন' বা 'দুঃখের বছর' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর