ব্রিটিশ রাজপরিবারে এক ভারতীয়র প্রভাব, যে ইতিহাস লুকানো ছিল

ব্রিটিশ রাজপরিবারে এক ভারতীয়র প্রভাব, যে ইতিহাস লুকানো ছিল

Other

রাণী ভিক্টোরিয়ার উর্দু হাতের লেখা। তিনি উর্দু শিখছিলেন তা ভৃত্য মুন্সি আব্দুল করিমের কাছে। মুন্সির সাথে রাণী ভিক্টোরিয়ার একটা গভীর প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিলো বলে অনেকে ধারণা করতো। এনিয়ে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে নানা সমস্যার জন্ম হয়েছিলো।

হলিউডের সিনেমা ভিক্টোরিয়া এন্ড আব্দুলে এই উর্দু লেখার সিকোয়েন্সটা আছে। আমার লেখার সাথে সংযুক্ত করে দিলাম।

ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘতম শাসনকর্তা হিসাবে রাণী ভিক্টোরিয়ার নাম বৃটিশ রাজতন্ত্র তথা পৃথিবীর ইতিহাসে জ্বলজ্বল। তাঁর শাসনকালের সময়কাল এতটাই বিখ্যাত হয়ে আছে যে, কেবল বৃটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসেই নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসের ওই সময়টাকে ইংরেজীতে বলা হয়ে থাকে ‘Victorian era’,

মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জীবনের খুব বেশি কাছের এবং তাঁর সাথে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্কের এক পুরুষ হলেন ভারতীয় এক যুবক, নাম মুন্সি আব্দুল করিম।

news24bd.tv

শান্তা আনোয়ার

রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্ম ১৮১৯ সালের ২৪ মে লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদে। পুরো নাম আলেকজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া। তাঁর মা সোহাগ করে ডাকতেন দ্রিনা। তিনি ছিলেন ডিউক অব কেন্ট, প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ডের একমাত্র সন্তান। অ্যাডওয়ার্ড ছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ পুত্র।

আরও পড়ুন


৭৫টি বিয়ে করে মনির, স্ত্রীদের বিক্রি করে পতিতালয়ে

আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরের দেওয়ালে পানি দিতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যু

২১ জনের মৃত্যুর দিনে বাড়ল শনাক্ত

৫ দিনের রিমান্ডে কনক সারোয়ারের বোন


১৮২০ সালে ভিক্টোরিয়ার বয়স যখন একবছরও পূর্ণ হয়নি তখন বাবা অ্যাডওয়ার্ড মারা যান।

ভিক্টোরিয়া কখনো স্কুলে যাননি; কিন্তু তাঁর জন্য একজন জার্মান গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়েছিল। ছোট থেকেই জার্মান ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি।

রানী ভিক্টোরিয়ার পিতা প্রিন্স এডওয়ার্ডের বড় তিন ভাই যখন মারা যান, তখন তাদের কোন সন্তান ছিলো না, আর সেজন্যই ভিক্টোরিয়া ১৯৩৭ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বৃটিশ রাজসিংহাসনে আরোহন করেন।

যাই হোক, রানী ভিক্টোরিয়ার ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে আরোহণের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষ থেকে দুজন কর্মচারীকে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত হয়। সেই দুজনকে বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেল পরিদর্শক জন টাইলারকে।
জেলের পরিদর্শক জন টাইলারের সাথে আব্দুল করিমের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। আব্দুল করিম যখন আগ্রা জেলের একজন কেরানী হিসেবে কাজ করতেন তখন জেল পরিদর্শকের সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো। জন টাইলার বাছাই করেন আব্দুল করিম আর মোহাম্মদ বকশ নামক দুজনকে।

সময়টা ছিল ১৮৮৭ সাল। সমগ্র ভারতের পক্ষ থেকে রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহনের স্বর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে একটা মোহর। মোহরটি রাণীর হাতে তুলে দিবে দু’জন ভারতীয় কর্মচারী আর সে দুজন হলো আব্দুল করিম ও মুহাম্মদ বখশ।

আবিদুল করিম রাণীকে প্রথমবারের মতো মুগ্ধ করেন তার হাতের রান্না দিয়ে। করিমের হাতের পোলাও, ডাল আর চিকেন কারির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে যান রাণী। রাণীর জীবনী রচয়িতা এ.এন. উইলসনের মতে, করিমের এই রান্না রাণীর এতটাই ভালো লেগেছিল যে এটিকে তিনি নিজের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ধীরে ধীরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন রাণী। এরই ধারাবাহিকতায় করিমকে তিনি আদেশ দেন তাঁকে উর্দু ভাষা এবং পবিত্র কোরান শেখানোর জন্য। তিনি আব্দুল করিমকে উপাধি দেন ‘মুন্সী’, অর্থাৎ নিজের শিক্ষক হিসেবে। এভাবেই আব্দুল করিমের নাম হয়ে যায় মুন্সী আব্দুল করিম।

news24bd.tv

রাণী ভিক্টোরিয়ার উর্দু হাতের লেখা

রাণীর স্বামী আলবার্ট মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর চারপাশে ঘুরে বেড়াতো প্রধানমন্ত্রী, অভিজাত বংশের সন্তান, রাজকীয় কর্মচারীরা; কিন্তু সকলকেই তাঁর স্বার্থান্বেষী বলেই মনে হতো, তিনি বুঝতে পারতেন ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির লোভে সবাই অন্ধ। কিন্তু ভারতের অধিবাসী আব্দুল করিম যেন তাদের চেয়ে ভিন্ন।

তাঁর সততা মুগ্ধ করতো রাণীকে। তিনি আব্দুল করিমকে নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী করে নিলেন।

রানীর সফরগুলোতেও সঙ্গী হিসেবে থাকতেন আব্দুল করিম। রানীর নির্দেশেই বালমোরাল ক্যাসেলের পাশে তার জন্য নির্মাণ করা হয় ‘করিম কটেজ’। সেই সুসজ্জিত কটেজেই থাকতেন আব্দুল করিম। পাশাপাশি রানীর বিশেষ আদেশে তাকে ভারত বিষয়ক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই ভারত সংক্রান্ত রাজসিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে রানী ভিক্টোরিয়া তার পরামর্শ চাইতেন।

আব্দুল করিমকে সচিব নিয়োগ দেওয়া নিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে চাপা অসন্তোষও ছিলো। সাধারণ এক ভারতীয় খিদমতগার থেকে রানীর পরামর্শক হয়ে উঠায় রাজপরিবারে অনেকের চক্ষুশুলে পরিণত হয়েছিলেন আব্দুল করিম।

১৮৯৯ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মুন্সি আব্দুল করিমকে রাণী ‘Commander of the Order (CVO)‘ উপাধিতে ভূষিত করেন।

এখানে উল্লেখ্য, কমান্ডারদের সম্মানের অবস্থান মূলত নাইট উপাধিধারীদের পরেই। ‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ফলে আব্দুল করিম রানীর দেয়া তলোয়ার বহন করার অনুমতি পেয়েছিলেন। সেই সাথে রাজদরবার এবং প্রাসাদে রানীর স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্র ছাড়াও দেখা করার অনুমতি লাভ করেন।

রাণী ভিক্টোরিয়া মারা যান ১৯০১ সালে। তখন সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র প্লেবয় স্বভাবের অধিকারী রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড। মুন্সী আব্দুল করিমের প্রতি চেপে রাখা ক্ষোভ তখনো তার মনে প্রবল। তিনি প্রথমেই আদেশ করলেন আব্দুল করিমের সাথে রাণীর সংশ্লিষ্ট সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে। রাণীর উর্দু শেখার খাতা, করিমের উপহার দেওয়া জিনিসপত্র, সবকিছু। আব্দুল করিমকে শুধু অনুমতি দেওয়া হয় রাণীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের। ওই বছরই আব্দুল করিমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে।

ভারতে এসে তিনি বসবাস করতে থাকেন সেই জায়গাতে যা রানী তাকে উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন। মুন্সী আব্দুল করিম মারা যান ১৯০৯ সালে, আর এভাবেই মুন্সি আব্দুল করিম হারিয়ে যান ইতিহাসের পাতা থেকে। কিন্তু দীর্ঘদিন  চাপা পড়ে যাওয়া এই ইতিহাস ২০১০ সালে রাজ পরিবার বিষয়টিকে সবার সামনে নিয়ে আসে।

(সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর