বিমানবন্দর যেন সোনার খনি
এক সপ্তাহে ২৩ কেজি উদ্ধার

বিমানবন্দর যেন সোনার খনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বিমানবন্দরগুলো যেন সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। প্রায় নিয়মিতই বিমানবন্দরগুলোতে সোনা আটক ও উদ্ধার হচ্ছে। গত এক সপ্তাহেই ২৩ কেজির বেশি সোনা উদ্ধার করেছে কাস্টমস গোয়েন্দারা। সবশেষ ৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেলাল উদ্দিন নামে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক নিরাপত্তাকর্মীর দেহ তল্লাশি করে ৮০টি সোনার বার জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা।

 

এসব সোনার ওজন ৯ কেজি ২৮০ গ্রাম, বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর আগে গত ৫ অক্টোবর দুবাই থেকে ঢাকায় আসা বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটের টিস্যু বক্স থেকে ১২০টি সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)। ১৩.৯২ কেজি ওজনের বারগুলোর মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ধরা যাচ্ছে না।

বিমানবন্দর কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পাচারকালে যে পরিমাণ সোনা উদ্ধার হচ্ছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বাইরে চলে যাচ্ছে। বারবার ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। বাংলাদেশকে সোনা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা।   

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সব রুটে ফ্লাইট বন্ধ ছিল। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক রুটে যে কটি ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে তাতেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ছয় মাসে এক মণের বেশি সোনা জব্দ করা হয়েছে। চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একাধিক কর্মীকে আটকও করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। সবশেষ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেলাল উদ্দিন নামে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক নিরাপত্তাকর্মীর দেহ তল্লাশি করে ৮০টি সোনার বার জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা।

গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের উপ-পরিচালক সানজিদা শারমিন জানান, সোনাসহ আটক হওয়ার পর জোর-জবরদস্তি করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বেলাল উদ্দিন। বিমানবন্দরে উপস্থিত এনএসআই কর্মকর্তাদের সহায়তায় অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তার দেহ তল্লাশি করে কোমরে বেল্টের নিচ থেকে তিনটি প্যাকেট জব্দ করা হয়। প্যাকেটগুলো হলুদ স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তিনটি প্যাকেটে ৮০টি সোনার বার পাওয়া যায়।  

এসব সোনার ওজন ৯ কেজি ২৮০ গ্রাম, বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়-চলতি অর্থবছরে (২০২১-২০২২) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এখন পর্যন্ত ৫৪ দশমিক ১১ কেজি সোনা জব্দ করেছে, যার আনুমানিক দাম প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৭৪ দশমিক ৪৯ কেজি এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৮০ দশমিক ৩৫ কেজি সোনা জব্দ করা হয়।  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা বিমানবন্দরের ডিপারচার নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। যাতে কোনো ধরনের অবৈধ মালামাল আনা-নেওয়া না হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি আমরা। তারপরও প্রায়ই অবৈধ সোনার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে। ’

বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের রুট : 
সূত্র জানায়, ভারতের বাজারে সোনার দাম বেশি থাকায় বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে একের পর এক চালান আটক করে শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা এমন তথ্য দিয়েছেন। আর এ কাজে জড়িত রয়েছেন এ দেশেরই বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। তাদের সঙ্গে আছেন বেশ কিছু অসাধু সোনা ব্যবসায়ীও। শুধু ভারতে পাচারই নয়, রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ কিছু এলাকার সোনা ব্যবসায়ী চোরাকারবারিদের কাছ থেকে সোনার বার সংগ্রহ করছে। এ চক্র দেশের অভ্যন্তরে সোনা পাচারের পর সড়কপথে ভারতেও উচ্চমূল্যে পাচার করছে। সম্প্রতি কয়েকটি চালান আটকের পর পুলিশ, র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দারা এ তথ্য জানিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে চোরাই সোনা কেনাবেচা করছে একটি চক্র। এ কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। দিনের পর দিন প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসাধু সোনা ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে সোনার বার নিয়ে আসছে। চোরাই সোনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ও আর্মড পুলিশের কিছু অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে।

আরও পড়ুন:


মমতার ভাগ্য নির্ধারণ আজ

চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় বোমা হামলা মামলার রায় আজ

টুইটার অ্যাকাউন্ট ফিরে পেতে আদালতে ট্রাম্প

করোনা প্রতিরোধে টিকার বিকল্প কোভিড পিলের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সাফল্য


 

বিচিত্র জায়গায় মেলে সোনা : সোনা পাচার মামলার এক তদন্ত কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি দুবাই থেকে এ দেশে সোনা পাঠানোর কাজ করেন। এই পাচারকারী চক্রের লোকজন সিঙ্গাপুর, দোহায়ও সক্রিয়। এসব রুটের যাত্রীকে দিয়ে টাকা অথবা বিমান টিকিটের বিনিময়ে কখনো ফুলদানির ভিতর, কখনো বা জুতার ভিতর কার্বন পেপারে মুড়িয়ে সোনার বার এ দেশে পাচার করা হয়। গত ৬ অক্টোবর দুবাইফেরত বিমানের শৌচাগারে টিস্যু পেপারবক্স থেকে ১৩.৯২ কেজি ওজনের সোনার বার উদ্ধার করেছিল শুল্ক গোয়েন্দারা। দুবাই থেকে ঢাকায় আসা বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটের টিস্যু বক্স থেকে ১২০টি সোনার বার উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)।  

এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুবাই থেকে আসা ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটের ময়লার বাক্স থেকেও পাওয়া গেছে ৬০টি সোনার বার। যার মূল্য সাড়ে ৪ কোটি টাকা। বারগুলো লুকানো ছিল ওই ফ্লাইটের ময়লার বাক্সের নোংরা খাবারের নিচে। এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি ১৭ কেজির বেশি ওজনের ১৫০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয় আবুধাবি থেকে আসা বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট বিজি১২৮-এ। ১০ কোটি টাকা মূল্যের ওই সোনাগুলো রাখা হয়েছিল ২৬এ ও ১৮এফ সিটের পাশের এয়ার কন্ডিশন প্যানেলের মধ্যে।  

চলতি বছরের ৩১ মার্চ সাড়ে ৪ কেজি ওজনের ৩৯টি সোনার বার উদ্ধার করা হয় বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট বিজি০৪৮-এর আসন ৩এ-এর নিচ থেকে। ওই একই দিনে ৩ কেজি ওজন ও ২.০৬ কোটি মূল্যের ২৮টি সোনার বার উদ্ধার করা হয় দুবাই থেকে আসা বিমান বাংলাদেশের আরেকটি ফ্লাইটের আসনের নিচ থেকে। ১ এপ্রিল দুবাই থেকে আসা ফ্লাইট বিজি৫০৪৬ থেকে ঝন্টু চন্দ্র বর্মণ নামে বাংলাদেশ বিমানের একজন এয়ারক্রাফট টেকনিশিয়ান হেল্পারকে আটক করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পাওয়া তথ্য অনুসারে ওই বিমানের সিটের হাতল থেকে ১.১ কেজি ওজনের ৭০ লাখ টাকার সোনা উদ্ধার করা হয়।  

এর আগে ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর সোনা পাচারের জন্য টয়লেট পেপার বক্সও ব্যবহৃত হয়েছিল। সেদিন ফ্লাইট বিজি২৪৮-এর একটি ওয়াশরুমের টয়লেট পেপার বক্সের নিচ থেকে ৪.৭৩ কোটি টাকা মূল্যের ৬৮টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ২ জুলাই কাস্টমস কর্মকর্তারা একটি প্যাসেঞ্জার সিটের পেছনের টিস্যু পেপার বক্স থেকে ৬.৩৮ কোটি মূল্যের সোনার বার উদ্ধার করেন।

news24bd.tv/আলী